ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্বিষহ দিনের আলোকচিত্র

মানুষ পোড়ানোর নষ্ট রাজনীতি, নিষ্ঠুর খেলা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

মানুষ পোড়ানোর নষ্ট রাজনীতি, নিষ্ঠুর খেলা

মোরসালিন মিজান ॥ সুন্দর সাজানো গ্যালারি। শতাধিক আলোকচিত্র। একটির দিকেও তাকানো যায় না। নরম পলিমাটির বাংলাদেশে এত বর্বর এত পাষাণ কবে জন্ম নিল? ভাইয়ের দেশে মায়ের দেশে কোন মানুষ মানুষকে এভাবে আগুনে পোড়াতে পারে? নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। গা শিউরে ওঠে। এ অবস্থায় ছবিগুলো না দেখাই ভাল। স্বস্তির। কিন্তু অন্ধকারের ইতিহাসও ইসিহাস, একে জানতে হবে। ভবিষ্যতের আলোর পথ বিনির্মাণের স্বার্থেই মনে, মগজের কোষে পুষে রাখতে পুরনো দিনের দুঃসহ স্মৃতি। প্রদর্শনীর আয়োজন এ কারণেই। ভেন্যু- শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা। এখানে রবিবার প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। ইতিহাসটি স্মরণ করা যাক। ২০১৫ সালের ঘটনা। বিএনপি-জামায়াত জোট তখন বিরোধী দলে। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে তাদের নানা দাবি। দাবি পূরণে হরতাল অবরোধ ডাকা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচী বটে। বাস্তবে দেখা গেল অন্য রূপ। ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা গোপন আক্রমণ শুরু করল। দেশের বিরুদ্ধে, দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। নষ্ট রাজনীতি কথা বলল পেট্রোলবোমার ভাষায়। আগুনে পুড়িয়ে মারল মানুষ। গবাদী পশুও রক্ষা পেল না। ধ্বংস করা হলো যানবাহন। যানবাহন ভর্তি ফসল খাদ্যসামগ্রী ছুড়ে ফেলা হলো। জ্বালিয়ে দেয়া হলো। মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা? বিভীষিকাময় দিনের কথা বলতেই আয়োজন করা হয়েছে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর। আর সব প্রদর্শনী থেকে এটি একদমই আলাদা। এখানে কোন ছবি তৈরি করা নয়। বানানো নয়। যা ঘটেছে, হুবহু তা ক্যামেরায় বন্দী করা হয়। মূলত দৈনিক পত্রিকার আলোকচিত্রীরা এসব ছবি তুলেন। তাদের ছবিতে আগুনের লেলিহান শিখা। চলন্ত বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। বাস ডিপোতে আগুন। বিশাল ট্রেনের বগি জ্বলছে। জ্বলছে সিএনজি অটোরিক্সা। সবখানে মানুষ। মানুষ পুড়ছে। দগ্ধ শরীর নিয়ে ছটফট করছে। প্রদর্শনীতে বার্ন ইউনিটের বেশকিছু ছবি। এখানে দগ্ধ শরীর। আর্তচিৎকার। কারও দুই হাত পুড়ে গেছে। কারও দুই পা। ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে শুয়ে থাকা অনেকেই আর বেঁচে নেই। চিরদিনের জন্য ছবি হয়ে গেছেন! ভুল রাজনীতির আগুন কত ভয়ঙ্কর, কত বীভৎস হতে পারে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে সোহাগ হাওলাদারের পোড়া শরীরটি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তিনি। বাসের হেলপার। তার প্রতিও দয়া দেখানো হয়নি। ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে আক্রান্ত হন তিনি। পেট্রোলবোমা ছুড়ে তাদের বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ভেতরেই পুড়ে মরেন হেলপার। তার পুড়ে যাওয়া শরীরের কাঠামো এমনভাবে দৃশ্যমান হয়েছে যে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যায় না। ছবিটি একবার দেখা যায়। দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস হয় না। আগুন সন্ত্রাসের শিকার হন আরও অনেক বাস ও ট্রাক চালক। সিলেটের ওসামানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে তোলা ছবিতে এক ট্রাকচালকের সহকারী। মুখ হাঁ করে পানিটুকুও পান করতে পারছেন না। আগুন থেকে রেহাই পায়নি এমনকি শিশুরা। একটি ছবিতে ফুলের মতো ফুটফুটে শিশুমুখ। সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজ করা। মাত্র ৬ বছর বয়সী মেয়েটির নাম রূপা। মানুষের অধপতনের সাক্ষী হয়ে ফ্রেমবন্দী হয়েছে সে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্ষত বহন করে চলেছে। একই বছরের ১৮ জানুয়ারি মিরপুর থেকে বাসে উঠেছিলেন ইডেন কলেজের এক ছাত্রী। কলেজে আর পৌঁছা হয়নি তার। জায়গা হয় বার্ন ইউনিটে। কিছু ছবিতে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চেহারা। রক্তাক্ত। প্রদর্শনী মনে করিয়ে দেয়, বিএনপি-জামায়াতের দেয়া আগুনে পুড়েছে গবাদিপশু। একটি ছবিতে মুরগি ভর্তি খাঁচা। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণ। পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত করতে আগুন দেয়া হয়েছে চালের ট্রাকে। পেঁয়াজ ভর্তি ভ্যানে। অন্য ছবিগুলোতেও আগুন সন্ত্রাস। খন্ড চিত্রগুলোকে একত্রিত করলে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির চেহারাটি দেখা হয়ে যায়। রাজনীতিতে স্খলন ছিল। আছে। রাজনীতি খারাপ হয়। পথভ্রষ্ট হন নেতারা। কর্মীরা উচ্ছৃঙ্খল হন। পতনের এই ইতিহাস নতুন নয় বাংলাদেশে। তাই বলে যে মানুষের নামে রাজনীতি, সে মানুষকেই পুড়িয়ে মারতে হবে? এও সম্ভব? এতটা বর্বর কী করে হয় রাজনীতি? বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত প্রদর্শনী এমন বহু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় দর্শনার্থীদের। দুইদিনব্যাপী আয়োজন আজ সোমবার শেষ হবে।
×