ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আনিসুল হকের মৃত্যুতে থমকে গেছে ১১ ইউটার্ন নির্মাণ প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

আনিসুল হকের মৃত্যুতে থমকে গেছে ১১ ইউটার্ন নির্মাণ প্রকল্প

মশিউর রহমান খান ॥ থমকে গেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র প্রয়াত আনিসুল হকের গৃহীত ১১ ইউটার্ন নির্মাণ প্রকল্প। রাজধানীর চলমান ভয়াবহ যানজট কমাতে আনিসুল হক প্রথমে ঢাকা উত্তর ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে মোট ২২ ইউলুপ নির্মাণের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে এসব স্থানে সময় ও অর্থের পাশাপাশি জমি সঙ্কট থাকায় ইউলুপের পরিবর্তে ইউটার্ন নির্মাণের কথা বলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিএনসিসি এলাকায় এগারোটি ইউটার্ন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এসব ইউটার্ন নির্মাণের কাজ শুরু করা হলেও শুধু অর্থের বিনিময়ে জমি কেনার কারণে বর্তমানে এ প্রকল্পের কাজ এক পর্যায়ে বন্ধ রয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ১১ ইউটার্নের মধ্যে মাত্র দুটি ইউটার্নের কাজ চলছে বাকি নয়টির নির্মাণ কাজ শুধু জমি না পাওয়ায় সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের সার্বিক বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে গত বছরের নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রকল্পটি সম্পর্কে মন্ত্রণালয় কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি ডিএনসিসিকে। এরপর থেকেই ইউটার্ন নির্মাণের কাজ বন্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প সূত্র জানায়, সাতরাস্তা থেকে উত্তরা হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত ১১ ইউলুপ নির্মাণ প্রকল্পটি ১ নবেম্বর ২০১৭ থেকে চলতি বছরের ২৯ এপ্রিলে শেষ হবে। প্রকল্প অনুযায়ী সাতরাস্তা, কোহিনূর কেমিক্যাল মোড়, মহাখালী বাস টার্মিনাল, মহাখালী ফ্লাইওভার, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি, বনানী কবরস্থান, বনানী ওভারপাস, কাওলা, উত্তরার র‌্যাব-১ অফিসের সামনের সড়ক এবং জসিমউদ্দীন সড়কের সামনে এই ইউটার্নগুলো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় বিপত্তি। প্রথম মাসেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শুধু জমি বুঝে না পাওয়ায় উত্তরার র‌্যাব-১ অফিস এবং রাজলক্ষ্মী এলাকায় জসিমউদ্দীন সড়ক বাদে বাকিগুলোর কাজ বন্ধ করে দেয়। বাকি ৯ ইউটার্নের কাজই শুরু করতে পারেনি। নক্সা অনুযায়ী জমি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য গত ৩০ নবেম্বর সরকারের সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ চিঠি দিলেও জমি প্রদানের বিষয়ে কোন প্রকার পদক্ষেপই নেননি সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। উপরন্তু তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব জমি অধিগ্রহণকৃত বিধায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জমির মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষেই কেবল জমি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা সম্ভব। সূত্র জানায়, ১১ ইউটার্ন প্রকল্পের সমাধানকল্পে গত ৩০ নবেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয় সিটি কর্পোরেশন। এতে বলা হয়, বিভিন্ন সংস্থার জমি হস্তান্তর বা ব্যবহারের অনুমতি না পাওয়ায় কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সংস্থাগুলোর অসহযোগিতায় ইউটার্ন নির্মাণ বন্ধ রয়েছে। জানা গেছে, এ প্রকল্পের ব্যয়ের ২৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকার মধ্যে ১৯ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা সরকারের, বাকি ৪ কোটি ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগানোর কথা। এসব ইউটার্ন নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালের শেষ দিকে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠায় উত্তর সিটি কর্পোরেশন। সেখানে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু করে ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার কথা থাকলেও অনুমোদন পেতেই এ বছরের ২৭ মার্চ পেরিয়ে যায়। পরে এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গত ২৯ অক্টোবর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এসএম কনস্ট্রাকশনকে কার্যাদেশ দেয় সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, ১১ ইউটার্ন নির্মাণের জন্য প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৫ কোটি টাকা। শুধু অবকাঠামো নির্মাণের জন্যই এই ব্যয় ধরা হয়। এতে নতুন করে জমি কেনার অর্থ প্রদান করা হয়নি। ফলে ঘটে বিপত্তি। সড়ক যোগাযোগ ও স্থানীয় সরকার দুই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই কোন প্রকার সিদ্ধান্ত না প্রদান করায় প্রকল্পের পরিচালক ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুবুর রহমান ঠিকাদারকে মৌখিক নির্দেশে বাকি ৯ ইউটার্ন নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রকল্প অনুযায়ী ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ সময়মতো জমি বুঝে না পাওয়ায় সরকার গৃহীত অতি গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কবে নাগাদ এই সমস্যার সমাধান হবে আদৌ হবে কি না তাও কেউ বলতে পারছেন না। জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মোট জমির মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ১ দশমিক ৩৬ একর, বাংলাদেশ রেলওয়ের দশমিক ২২ একর, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের দশমিক শূন্য নয় একর এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দশমিক শূন্য ছয় একর জমি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে। জানা গেছে, প্রকল্প শুরুর সময় প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে ইউটার্ন নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো জমি দিয়ে সার্বিকভাবে সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দিলেও তার মৃত্যুর পর প্রকল্প কাজ শুরুর পর এসব মন্ত্রণালয় কোন প্রকার সহযোগিতাই করছে না। ফলে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। এমনকি কবে নাগাদ এ সমস্যার সমাধান হবে কেউ তা বলতে পারছেন না। নবেম্বরের শুরুতে ঠিকাদার কাজ শুরু করলেও পরে জমি না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে একপ্রকারের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এরপর দুই মাসেও অগ্রগতি না হওয়ায় অবস্থাদৃষ্টে রাজধানীর যানজট নিরসনের জন্য সরকারের গৃহীত অতি গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সার্বিক অবস্থা জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও এ বিষয়ে কোন সুরাহা না হওয়ায় আমরা জমি প্রাপ্তি সম্পর্কে দুটি ইউটার্ন নির্মাণের কাজ চলমান রেখেছি। বাকি ইউটার্নগুলোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পর কাজ শুরু করা সম্ভব। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১১ ইউটার্ন নির্মাণ করতে মোট প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য পরিশোধ বা ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। যা প্রকল্পে আগে ধরা হয়নি। তাই বিষয়টি সরকারের দুই মন্ত্রণালয় ও জমির মালিক হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। ফলে আমরা এখনও ইউটার্ন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় নক্সার স্থানের ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রই হাতে পাইনি। তাই বাধ্য হয়েই আমরা নির্মাণকাজ আপাতত বন্ধ রেখেছি এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রাপ্তির পরই কেবল এসব ইউটার্ন নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব।
×