ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পলিথিনে ঘেরা ফুটপাথের খুপরিতে কাঁপছেন ছিন্নমূল মানুষ ॥ ওদের জন্য দ্রুত শীতবস্ত্র প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

পলিথিনে ঘেরা ফুটপাথের খুপরিতে  কাঁপছেন ছিন্নমূল মানুষ ॥ ওদের জন্য দ্রুত  শীতবস্ত্র প্রয়োজন

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাত নয়টা। রোজিনা আক্তার তার দুই বছরের মেয়ে ও সাত বছরের ছেলে নিয়ে শীতে জবুথবু হয়ে বসে আছেন ফুটপাথের ওপর পলিথিনে ঘেরা সামান্য একটু জায়গায়। ছেলে আর মেয়ের গায়ে একটা ছেঁড়া কম্বল জড়ানো থাকলেও নিজের গায়ে শীতের পোশাক জড়াতে পারেননি ত্রিশোর্ধ এই নারী। শীতে কাঁপছেন তিনি। পাশেই মাটির একটি ছোট্ট উনুনে ভাত বসিয়েছেন। উনুনে আগুন জ্বলছে, সেই তাপটুকুই ভরসা শীত নিবারণের। এই দৃশ্য রাজধানীর বীর উত্তম সি আর দত্ত রোডের পাবলিক টয়লেট সংলগ্ন ফুটপাথের ভাসমান পরিবারগুলোর। শীত থেকে রেহাই পেতে অনেকেই পলিথিন টাঙ্গিয়ে রাস্তার পাশে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। কেউ বা আগুন জ্বেলে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। শুধু রোজিনা নয় রাজধানীসহ সারাদেশে তীব্র শীতে বিপর্যস্ত ছিন্নমূল মানুষ। শীতের কবল থেকে আশ্রয়ের যেন কোন সম্বলই তাদের কাছে নেই। কোন রকমে দিন পার করলেও রাতে তাদের অবস্থান ফুটপাথের ধারে কিংবা কোন ভবনের ফটকে। খোলা আকাশের নিচে হাড়কাঁপানো শীত তারা পার করছেন। প্রায় দুবছর আগে নোয়াখালী থেকে মেয়েকে নিয়ে রাজধানীতে এসেছেন মরিয়ম। প্রথমে রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাথে দু’সন্তান নিয়ে বাস করলেও বর্তমানে তিনি এ ফুটপাথেই এক বছর ধরে বাস করছেন। গরমের সময় ফুটপাথে থাকতে সমস্যা না হলেও মৌসুমের শৈত্যপ্রবাহে পিতৃহারা পাঁচ বছরের মেয়ে নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন পঁচিশ বছরের মরিয়ম। তিনি জানকণ্ঠকে জানান, গরমের সময় এখানে থাকতে তেমন অসুবিধা না হলেও শীতকালে বেশি অসুবিধা হচ্ছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহ ধরে ঘুমানোই যাচ্ছে না। পাঁচ বছরের মেয়ে নিয়ে একরকম বসে বসেই রাত পার করছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় আসি। কিন্তু কোন আত্মীয়-স্বজন বা অর্থ সম্পদ না থাকায় বস্তিতে ঘর ভাড়া নিতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে ফুটপাথে শুয়েই রাত পার করি। তবে শীতকালে খুবই কষ্ট হয়। এখন নাকি আবার শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। কিভাবে যে ছোট এই মেয়েকে নিয়ে শীতকাল পার করব আল্লাহ জানে। রাস্তার একটি চায়ের দোকানে পানি টেনে দিনে দুইশ টাকা পাই। এই টাকা দিয়েই কোনমতে পলিথিন কিনে মাথার ওপর ছাউনি দিয়েছি। তাতেও শীত থেকে রক্ষা নেই। মেয়ের জ্বর ঠা-া লেগেই আছে।’ এভাবেই দুঃখের কথা বলতে গিয়ে মরিয়মের গলা ভার হয়ে আসছিল। ‘রাত বারোটার পর থেকে সকালে সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত শীত বেশি থাকে। কোন কাপড়-চোপড়ও নেই। শীত নিবারণের একমাত্র উপায় একটা সুয়েটার। সারারাত বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই কাটিয়ে দিই।’ শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলছিলেন আরেক ছিন্নমূল আকবর। তিনি ভাঙারি আলাদা করার কাজ করেন। ষাটোর্ধ এই বৃদ্ধ জানালেন, ‘এভাবেই শীত উপেক্ষা করে বেঁচে আছি এখনও। তবু কারও কাছে সাহায্য চাই না। আর এখন তো মানুষ রাস্তায় মরে থাকলেও দেখার কেউ নেই। সেখানে কে শীতবস্ত্র দেবে সেটা আশা করি না। বড়লোকরা আমাদের মতো ভাসমানদের চোখে দেখেন না।’ রাত দশটায় ফার্মগেট পার্কের পাশে ফুটপাথের ওপর পলিথিনের ছাউনির নিচে রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে কালাম শেখ ও জোসনা বিবি দম্পতি। একটা ছেঁড়া কাঁথা আর একটা চাদর গায়ে মুড়িয়ে ঘুমাতে যাচ্ছেন তারা। এ কাঁথা দিয়েই তারা পার করেছেন কয়েকটি শীত। ভিক্ষা করে চলে এ দম্পতির সংসার। জানালেন, ‘একটা কম্বল যদি পেতাম তাহলে শীতটা হয়ত কম লাগত। এমনিতেই বুড়ো মানুষের শীত লাগে বেশি। তার ওপর শীতবস্ত্রও নেই। মানুষের কাছে চেয়ে একটা পুরনো সুয়েটারটা পেয়েছি সেটাই ভরসা।’ সরেজমিনে কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা মেলে অসংখ্য ভাসমান লোকের। গভীর রাতে ছিন্নমূল এসব মানুষ লাইন ধরে শুয়ে থাকে। কারো গায়ে একটি পাটের বস্তা, কারো গায়ে ময়লা ছেঁড়া একটি কম্বল, কারো তাও জোটেনি। একটি মাত্র পাতলা কাপড় মুড়ি দিয়েই শুয়ে আছেন। দূর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে। ১১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রচ- শীতে কি সামান্য কাপড় দিয়ে রক্ষা পাওয়া যায়! তাদের একজন আতিক। সে জানায়, এত শীত মনে হয় কখনোই পরিনি। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত শরীরে একটুতেই ঘুম এসে যেত। কিন্তু কয়েকদিন ধরে এত বেশি শীত, যে ঘুমাতেই পারছি না। দিনটা কোন রকমে পার করলেও রাতটাই বেশি যন্ত্রণার। শুনেছি, অনেক জায়গায় শীতবস্ত্র বিতরণ করে; কিন্তু আমি পাই নাই। আমাদের খবর কে রাখে! রাত সাড়ে দশটার দিকে ফার্মগেটে যাত্রীর আশায় বসে থাকা রিক্সাচালক তবারককে বলেন, ‘চার ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার সংসার। ছেলে দুইটা পড়ে। মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আরেকটা ছোট। তাদের পড়াশোনা ও সংসার চালানোর জন্য দিনরাত রিক্সা চালাইতেই হয়।’ তিনি আরও বলেন, অন্য সময় রাত দুইটা-তিনটা পর্যন্ত রিক্সা চালালেও গত এক সপ্তাহ ধরে দশটার পর আর রাস্তায় নামতে পারি না। এ সময় ঠাণ্ডার জন্য রিক্সার হাতল ধরা যায় না। হাত জড়িয়ে আসে। তখন সুযোগ পেলেই অন্য রিক্সাওয়ালাদের নিয়ে আগুন পোহাতে শুরু করি। আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে। এ মাসে আরও কয়েকবার মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আর এতেই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন রাজধানীর ভাসমান মানুষগুলো। সামর্থ্যবানরা যেখানে লেপ, কম্বল এবং গরম কাপড় জড়িয়ে শীত উপভোগ করছেন অন্যদিকে সেখানে ভাসমান মানুষ শীতবস্ত্রহীন কষ্টের রাত পার করছেন।
×