ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

গণমানুষের নেতা বেঁচে থাকুন

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

গণমানুষের নেতা বেঁচে থাকুন

সাম্যবাদের গান গাইতেন তিনি। চাইতেন ঘুণেধরা সমাজকে বদলে দিতে। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত জনতার জয়, শোষিত মানুষের একতার জয়ের লক্ষ্যাদর্শকে বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে করেছেন নিবেদিত। মানুষ অন্তঃপ্রাণ তিনি। নিরন্ন, অসহায়, বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকে তাদের জন্য শুভদিন নিয়ে আসার সংগ্রামে থেকেছেন অবিচল। পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত সহায়-সম্পদকে জনকল্যাণের জন্য করেছিলেন দান। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজের জীবন-যৌবনকে উৎসর্গ করেছেন অবলীলায়। ‘আমরা করবো জয়’ বলে উচ্চাশার পর্বতশিখরে আরোহণ করার জন্য সার্বক্ষণিক সচেষ্ট থেকেছেন। মানুষের অধিকার যারা ক্ষুণœ করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দুর্গ গড়ার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন বিশ্বাসবোধে, মানবিক তাড়নায়। চাষা-ভূষা, ক্ষেতমজুরদের সঙ্গে কাটিয়েছেন, তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। কিন্তু বয়সের ভারে যখন ন্যূব্জ, তখন তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি সেইসব সহকর্মী, সেইসব কমরেড, যাদের হাতে হাত রেখে দৃঢ় পায়ে গেছেন এগিয়ে। দীপ্ত আলোকবর্তিকা হাতে মুক্তিকামী মানুষের অধিকার আদায়ে মিছিল স্লোগানে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সর্বাগ্রে এগিয়ে যেতেন। রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বহারাদের দলে তিনি আজ। পায়ে দগদগে ঘা। নানাবিধ অসুখে-বিসুখে আক্রান্ত দেহ। চিকিৎসার শরণাপন্ন হওয়ার নেই সামর্থ্য। তাই অপেক্ষা মৃত্যুর জন্য। মরণের পথ ধরে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং জনপ্রতিনিধিও। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন সাধারণ মানুষের প্রগাঢ় ভালবাসায়। হারিয়েছিলেন ডাকসাইটে, বিত্তবান, প্রভাবশালী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীকে। গণমানুষের নেতা ছিলেন বলেই গণবিরোধী কোন ভূমিকায় দেখা মেলেনি তার। বরং নীরবে নিভৃতে মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য কাজ করেছেন। বিত্তের প্রতি ছিল না মোহ। তাই ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল না। তিনি প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ ইউসুফ। জন্মেছিলেন পাহাড়, সমুদ্র, নদী; বনবেষ্টিত চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। ছাত্র জীবনেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বেও হয়েছিলেন আসীন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন। তারপর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ওতপ্রোতভাবে। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা সিপিবির নেতা ছিলেন। নির্লোভ ও জনগণনন্দিত এই রাজনীতিককে চিনেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরিবর্তে আট দলীয় জোটের শরিক সিপিবির এই নেতাকে মনোনয়ন দেন। একাত্তরের পরাজিত শত্রুকে (পরে ফাঁসিতে দ-িত) হারিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। আর্থিক সচ্ছলতা কখনই ছিল না কিংবা এই বিষয়ে ছিলেন অমনোযোগী। ১৯৯৫ সালে সিপিবি জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কা নিয়ে জয়লাভ করা ৫ জন সংসদ সদস্যকে তাদের দলের কেউ নয় বলে স্পীকারের কাছে আবেদন করেন। সদস্যপদ বাতিলের জন্য দাবি জানান। তাদের কেউ কেউ বিএনপি, গণফোরামে চলে গেলেও মোহাম্মদ ইউসুফ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পঞ্চম জাতীয় সংসদের এই সদস্যের চট্টগ্রাম বা ঢাকা শহরে কোন আবাস ছিল না। নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে থাকতেন। পোশাক-আশাকে ছিল না বাহুল্য। পরবর্তীকালে দলীয় মনোনয়ন লাভের জন্য আর সচেষ্ট হননি আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায়। অথচ এলাকায় তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। সাধারণ মানুষের ইউসুফ ভাই। নির্বাচনের সময় সাংবাদিক হিসেবে তার এলাকায় গিয়েছিলাম। তার বাড়ি কোন আলিশান বাড়ি নয়, থাকতেন টিনশেডের একটি ঘরে। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন ভোট প্রার্থনায়। মানুষ তাকে বুকের গহীনে ঠাঁই দিয়েছিল। তারপর তিনি চলে যান অন্তরালে। রাজনীতির নিষ্ঠুরতায় তিনি হয়ে যান যে কোন সাধারণ জন। দলীয় লোকজনও আর নেয়নি খোঁজখবর। যেন ‘এ জগতে কে কাহার’। পড়ন্ত বেলায় অসহায়ত্ব আর অসচ্ছলতাকে ধারণ করে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন বুঝি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পায়ের দগদগে ঘা-সমেত ময়লা পোশাকের মানুষটির চিত্র প্রচারিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসে। তার এই করুণ অবস্থার কথা দীর্ঘদিনেও কেউ জানায়নি নেত্রীকে কিংবা সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। গণমানুষের নেতা অন্তরালে থেকে গেলেন যেন। অবশেষে জননেত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন এই জননেতা আবার সুস্থ্য হয়ে উঠবেন, রাজনীতির ময়দানে নেমে জনগণের পাশে দাঁড়াবেন, সেই আশা স্বাভাবিক। মানবতার বাতিঘর শেখ হাসিনা আছেন বলেই বাংলার মানুষ প্রাণ খুঁজে পায়। আমরা মোহাম্মদ ইউসুফের সর্বাঙ্গীন সুস্থতা কামনা করি।
×