ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ ভয়ের সংস্কৃতি ও জননিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ ভয়ের সংস্কৃতি ও জননিরাপত্তা

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতার যেমন ক্রমেই উন্মেষ ঘটেছে, তেমনি নিরাপত্তার ঘাটতি, ভয়ের সংস্কৃতি ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা’, ‘জাতীয় নিরাপত্তা’- অবশেষে ব্যক্তি নিরাপত্তায় নিমগ্ন হয়েছে প্রতিটি মানুষ। তাই আমরা দেখতে পাই ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ মানুষের ‘মর্যাদার সঙ্গে বসবাস’কে নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ ঐঁসধহরঃধৎরধহ জবংঢ়ড়হংব উবঢ়ড়ঃ (ঐজউ) প্রণয়ন করে। ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘মানব নিরাপত্তা’-এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর এই সংজ্ঞাকে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনের সকল প্রতিনিধিরা অনুমোদন দেয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তার ধারণাকে জীবনযাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত করেছে। এসব ক্ষেত্র হচ্ছে- অর্থনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্য, খাদ্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অর্থ রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ব্যক্তিকে যেভাবে ভীতিমুক্ত দেখতে চেয়েছেন, জাতিসংঘের ওই সব কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের প্রয়াস রয়েছে। সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়া এবং সমাজে আতঙ্কের বিস্তার যে স্বাভাবিক ঘটনা নয় তা আমরা জানি। যে কোন সমাজে, যে কোন সময়ে আতঙ্ক হচ্ছে একটি তৈরি করা বিষয়। যদি কোন সমাজে আতঙ্ক সর্বব্যাপী রূপ নেয় তাহলে বুঝতে হবে সেই সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আতঙ্ক যারা তৈরি করে তাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে ভীত করা, নিঃসঙ্গ করা, প্রতিরোধের শক্তিকে দুর্বল করা প্রভৃতি। মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারের তরফ থেকে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সরকারী বাহিনী বা প্রতিষ্ঠান। এসবের মধ্যে রয়েছে- প্রতিরক্ষা বাহিনী, সীমান্ত রক্ষাবাহিনী এবং পুলিশবাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায়িত্ব পুলিশের। যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অনুপস্থিত সেখানে নিরাপত্তা বা যে কোন কল্যাণ সৃষ্টির প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। অর্থবহ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ব্যতীত যেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; সেরূপ জনগণের সক্রিয় জাগরণ বা অংশগ্রহন ব্যতীত নিরাপদ রাষ্ট্র নির্মিত হতে পারে না। নাগরিক সাধারণকে তাদের নিরাপত্তা, সম্পদ ও সম্মান লাভের জন্য অবশ্যই সংগঠিত, প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী হতে হবে। জনগণের নীরব ভাষাকে সরব করার দায়িত্ব গণতান্ত্রিক শক্তির। গণতন্ত্র ও নিরাপত্তার মতো বিষয়াবলীর সুষ্ঠু তদারকি নিশ্চিত করার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্রের নাগরিকের। নাগরিকদেরই নাগরিক নিরাপত্তার জন্য অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। জনগণ যদি ক্ষমতার উৎস হয় তাহলে তাদের বিজয় অনিবার্য। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সমাজকে বিভিন্ন বলয়ে বিভক্ত করে ফেলার যে প্রবণতা দৃশ্যমান, তা সমাজে কেবল অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে তা-ই নয়, একই সঙ্গে মানুষের অধিকারকেও সঙ্কুচিত করেছে এবং তৈরি করেছে ভয়ের সংস্কৃতি। এই বিভক্তির বলয় থেকে যারা সুবিধা নিচ্ছে, তারা ভেবে দেখতে আগ্রহী নয় ভবিষ্যতে দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু তাদের আগ্রহ-অনাগ্রহ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করবে না, সেটা নিশ্চিতভাবে অনেকেই বলতে পারবে। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও বিশ্বাস থাকা না থাকার কোনটিই নাগরিকের বেঁচে থাকার বা ন্যায়বিচার পাওয়ার শর্ত হতে পারে না। সবার উচিত ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সরব এবং সক্রিয় হওয়া। যদি সেই আতঙ্কের পরিবেশ, সেই ভয়ের সংস্কৃতিকে পরাস্ত না করা যায় তবে নাগরিকদের কেউই নিরাপদ হবেন এমন আশা করার কারণ দেখা যায় না। তাই আসুন ভয়ের সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে সাহসী হয়ে নিজেদের অধিকার বুঝে নেয়ার পাশাপাশি দেশকে তথা দেশের পরিবেশকে জননিরাপত্তায় সহায়ক হিসেবে গড়ে তুলি। তাহলেই রাষ্ট্রসহ রাষ্ট্রের নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×