ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনের বাদ্যি বাজে দেশজুড়ে -জাফর ওয়াজেদ

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

নির্বাচনের বাদ্যি বাজে দেশজুড়ে -জাফর ওয়াজেদ

ভোটের দামামা বেজে উঠেছে। ২০১৮ নির্বাচনের সাল। শুধু জাতীয় সংসদ নয়। সিটি কর্পোরেশন, এমনকি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনের বছর। সেই ভোটের ঢাক-ঢোল-বাদ্যি বাজা শুরু হয়ে গেছে। আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদের শব্দ শোনা যায় শহরে, নগরে, গ্রামে-গঞ্জে। নির্বাচন জীবনের ধর্ম। অসত্যকে, অসুন্দরকে মানুষ বর্জন করে। গ্রহণ করে সত্যকে, সুন্দরকে। এই গ্রহণ-বর্জন পালার মধ্য দিয়েই চলে জীবন ও জগতের ক্রমবিকাশ। রাষ্ট্রিক অবয়বেরও পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এই নির্বাচন। নির্বাচন যেখানে নিষিদ্ধ, প্রাণ সেখানে প্রতিরুদ্ধ। সেখানে একনায়কতন্ত্র (যা পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশ অবলোকন করেছে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত)। গণতন্ত্রে মুক্তি। গণতন্ত্র সার্বিক বিকাশের অঙ্গীকার। নির্বাচন এই গণতন্ত্রের প্রাণ। তাই বলে নির্বাচন মানে গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশ দুই জান্তা শাসকের দুঃশাসনের ভুক্তভোগী হিসেবে দেখেছে একনায়কতন্ত্র সাধকের সর্বাঙ্গে নির্বাচনী নামাবলী। সামরিক শাসকের ইউনিফরমের ওপরে চাপানো গণতন্ত্রের আলখাল্লা। বলা যায়, ‘মার্শাল গণতন্ত্র’। মানবাধিকারের সর্বোত্তম প্রতীক গণতন্ত্রকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করা অসম্ভব বলেই জান্তা দুর্বৃত্তদের নিতে হয়েছে ছলনার আশ্রয়। তখন হয় সীমায়িত গণতন্ত্র, বুনিয়াদি গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, সামরিক গণতন্ত্র ইত্যাদি অভিধার আঁধি সৃষ্টি। গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়েই বারে বারে রাষ্ট্রজীবনের উজ্জীবন ঘটে নির্বাচনে। দেশে নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনী আমেজ দেখা দিলেও নির্বাচনকেন্দ্রিক সভা-সমাবেশ তেমন শুরু হয়নি নির্বাচনী এলাকাগুলোতে। কিন্তু কানাঘুষো চলছে, তবে একাধিক প্রার্থীদের গণসংযোগ, ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ চলছে। সাধারণের মধ্যেও শুরু হয়েছে মেরুকরণ। চলতি বছরের শেষ দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের ঢাকে কাঠি পড়বে। ধাঁই কুড় কুড়, ভোটের বাদ্যি বেজে উঠবে। নির্বাচনী হাওয়া বইছে শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এই নির্বাচন মানে আর কিছু নয়, জনতার কাছে যাওয়া, তাদের মনের কোটরে প্রবেশ করে মন জয় করা। জনগণই জানে বিজয়ের ভাষা। সেই ভাষা আয়ত্তে আনার জন্য অনেক কসরত করে যেতে হয়। ভোটের বাদ্যের যেমন শোনা যাবে অচিরেই সুর, তেমনি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে অসুরও। সুরাসুরের এই হলাহলে ভোটার নাস্তানাবুদ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় অনেকখানি। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেগা সূচাগ্র্য মেদিনী’ বলে ভোট লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়বেন ভোট ভিক্ষুকরা অচিরেই। ভোট ভিক্ষার মাজেজা অন্যতর। কত পথ ও পদ্ধতি রয়েছে ভোটারের মন জয় করার। সে সব যথাযথভাবে হলে ভোটের বাক্স উপচে ভোট পড়ার সম্ভাবনা থাকে শতভাগ প্রায়। ভোটের জন্য প্রার্থীদের পরিশ্রমের অন্ত থাকে না। প্রতিটি ভোটারের কাছে যাওয়ার উদগ্র বাসনা থাকে। সব প্রার্থী কামিয়াব হতে পারেন না। তবু হেরে যায় অনেকে। জিতে শুধু একজনই। নির্বাচনের আরও প্রায় এগারো মাস বাকি রয়েছে সরকারী দলের হিসাব অনুযায়ী। তাই কাড়নাকাড়ার ধ্বনি বেজে উঠতে যাচ্ছে। ক্রমশ তা ধারণায় থেকে দ্রুতলয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাকযুদ্ধে নেমে পড়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ভাষার তুবড়িতে নানা রকম জজবা তোলা হচ্ছে। ভাষার মারপ্যাঁচে কত কি বয়ান ছড়িয়ে পড়ছে। একে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করার কাজে সবিশেষ মনোযোগ ও আত্মনিয়োগে মাতোয়ারা নেতারা। বাকশিল্পের তরবারি শাণিয়ে নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হরেক কিসিমের তৎপরতা চলছে। সীমিত পরিসরে হলেও। ক্রমশ তা বিস্তৃত হবে। বাগ্যুদ্ধ আরও তীব্র হতে থাকবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসতে থাকবে। এখনই এই যুদ্ধের মৃদু উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহের এই সময়েও। তবে এই বাগ্যুদ্ধ পরিণত হতে পারে মল্লযুদ্ধে। বিপজ্জনক আবহাওয়ার ঘূর্ণিপাকে খড়কুটোয় পরিণত হতে পারে অনেক কিছুই। জনমনে আশঙ্কা বাড়ার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে পারে। প্রাণঘাতি এই যুদ্ধে প্রাণহানির সংখ্যা হয়তো বাড়তে থাকবে। মার্কিন নির্বাচনী লড়াইয়ে ট্রাম্প ও হিলারির বাগ্যুদ্ধে রসালো, ধারালো, কুরুচিপূর্ণ, শালীনতা বিবর্জিত এবং বিষোদগারের যেসব ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে সারা বিশ্বের মানুষ হতভম্ব, বিস্মিত আজও প্রায়। সে সব ভাষা ডালপালা ছড়িয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে। ব্যক্তিগত আক্রমণ, পারিবারিক জীবন, আয়, ব্যয় হিসাবগুলো প্রকটিত হতে থাকবে। আর কুৎসা, গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা বেশ পল্লবিত হয়ে উঠবে। নিম্নরুচির এমনতর প্রকাশ উন্নত দেশে যদি ঘটে, তবে এদেশে সেসব ব্যবহৃত হতে বাধা কোথায়? যেখানে পরস্পরের সম্বোধনে নেই মাধুর্য, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, সেখানে রুচি-কুরুচি তফাত কে আর খুঁজতে যায়। নির্বাচন মূলত গণতন্ত্রের প্রাণ। গণতন্ত্রকে সজীব রাখে। নব রসে সতেজ করে নির্বাচন। তাই নির্বাচনকে নিরপেক্ষ নিষ্কলুষ রাখার দায়ও আছে সকলের। এতবার দেশে যে নির্বাচনগুলো হয়ে গেল, তা থেকে অনেক অভিজ্ঞতাই তো সঞ্চিত হয়েছে। আবার আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কেও সতর্ক হওয়া যায়। যে সব অশুভ শক্তি অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বিঘিœত করতে চায় বা পারে। নির্মূল করতে হবে সেই শক্তিগুলোকেও। নির্বাচন মানেই এদেশে এক ধরনের উৎসব। ভোটাররা যেমন প্রাণ পায়, তেমনি নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ বুঝি উদ্দীপিত করে তাদের। কিন্তু দেশবাসী যে ধরনের নির্বাচন আশা বা কামনা করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো বা নির্বাচন কমিশন প্রায়ই তা দিতে না পারায় গণমানুষের মনে নির্বাচনের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকে ভোটের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। এক সময় বিস্তর স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গেছে সকল স্তরের মানুষের মধ্যে। ভোটের মূল্য তারা উপলব্ধি করত। যেমন করেছে ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৭৩, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে। পাঁচত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসকরা ও তাদের উত্তরসূরিরা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভোট কেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি। বরং নিপীড়ন চালানো হয়েছিল। জাল ভোটের মাত্রা এমনভাবে বেড়েছিল যে, নব্বই ভাগ ভোট পড়েছে ব্যালট বাক্সে, যা অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব। ‘মিডিয়া ক্যু’, ‘মার্শাল ক্যু’-এর দাপটে ভোটের নামে প্রহসনই অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রার্থীদের পেশিশক্তি সম্পন্ন ক্যাডারদের দৌরাত্ম্যে বা ভোটকেন্দ্রে গোপনে টাকার খেল ঘটে যাওয়ার ঘটনা স্বাভাবিকে পরিণত হয়েছিল। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা পদ্ধতি ও বিধিমালা গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশে বর্তমানে পরিপূর্ণভাবে সহায়ক হয়ে উঠলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা সেখানে মেলে না। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন সে অবস্থা ও অবস্থান থেকে মুক্ত হয়ে উঠবে এমন আশাবাদ ভোটারদের। নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাশীল থেকে একটি সুন্দর ও উৎসবমুখী নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে চাইবেন। যেমনটা করেছেন রংপুর ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে। এবারও তারা সেই পথেই এগুচ্ছেন। ভোটের দামামা যতই বাজবে, কমিশন ততই শক্তিশালী ভূমিকা নেবে বলে প্রতীয়মান হয়। রাজনীতি মূলত সম্ভাবনার পাটিগণিত। রাজনীতি হচ্ছে গতিশীল। আচলায়তন নয়। আর গণতন্ত্র তখনই সফল হয়, যখন জনগণ সচেতনভাবে নিজেদের বিচার বিবেচনা মতো তাদের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই মানুষের চাহিদার উপযুক্ত হয়ে উঠতে হয় রাজনৈতিক দলকে। মানুষের চাহিদা পূরণ না হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। ঘরের মধ্যে বসে দল কী সিদ্ধান্ত নিল, সেটাই শেষ কথা নয়। গণতন্ত্রের পরিবেশকে আত্মস্থ করতে হয়। সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ নেয়ার পরে কেতাবি ‘বিপ্লব’ এর ধারণা আঁকড়ে নেই কেউ আর একালে। তা থাকলে হয় অসঙ্গতি। নেতা কে হবেন, নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, গণতন্ত্র তা নিজেই খুঁজে নেয়। গণতন্ত্রে নাগরিকই বেছে নেন নিজের ভবিষ্যত। নির্বাচনের ফলাফলে নাগরিক শেষ পর্যন্ত যে বিষয়টির পরিচয় দেন, সে হলো তার বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু ভারসাম্যহীন, একতরফা কোন আন্দোলনে যদি সেই বুদ্ধিমত্তা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তা হলে গণতন্ত্রের ধারণারই মৃত্যু ঘটে। যে কোন গণতান্ত্রিক রণাঙ্গনেই নাগরিকের স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন কাক্সিক্ষত। তবে সেই স্বাধীন চিন্তা বা বুদ্ধির প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও জরুরী। সে পরিবেশ তখনও সুনিশ্চিত হয়, যখন শাসক এবং বিরোধীর রাজনৈতিক সক্ষমতায় ন্যূনতম ভারসাম্যটুকু অন্তত থাকে। নির্বাচনের ময়দানে সংগ্রামের উপস্থিতি চিরন্তন। সংঘাত তীব্রতর হয়ে ওঠাও অস্বাভাবিক ঘটনা নয় মোটেই। কিন্তু সংঘাতের পথ বেছে নেয়ার নামে নৈরাজ্যকে ছাড়পত্র দেয়ার অধিকার কারও নেই। প্রচার এবং পাল্টা প্রচার সংঘাতকে ডেকে আনে। দেশের বিরোধী দলের বিগত বছরগুলোতে সন্ত্রাসী ও মানুষ হত্যার কর্মকা- রাজনৈতিক প্রতিহিংসাজনিত কিনা, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। এই মীমাংসার পথ দু’টি। আইনী লড়াই এবং রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে। বিএনপি নেত্রী সপুত্র বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুর্নীতির যেসব মামলা হয়েছে, তা রাজনৈতিক নয়। বরং ক্ষমতার অপব্যবহার। এই মামলাকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে প্রায়শই। গাড়ি ভাংচুর ও সম্পদ বিনষ্টের ঘটনা ঘটছে। এটা কোন রাজনৈতিক লড়াই নয় বরং পুরোদস্তর নৈরাজ্যকে ছাড়পত্র দেয়ার নামান্তর। প্রতিবাদের নামে বে-লাগাম আক্রোশ চরিতার্থ করা কোনও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে পড়ে না। শাসানি দেয়াও রাজনৈতিক রুচিবোধের পরিচায়ক নয়। বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দুরারোগ্য ব্যাধির নাম। তার সহিংস আচরণ শুধু রাজনৈতিক রুচিবোধের ক্ষতি হচ্ছে বা নৈতিকতার বিসর্জন ঘটছে, এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয় বিষয়টি। তাদের হিংসার মাঝে অতীতে ও বর্তমানে আটকে পড়া সাধারণ নাগরিকের সন্ত্রস্ত মুখটাও ভেসে ওঠে দৃশ্যপটে। নৈরাজ্যের দরোজাটা খুলে যাচ্ছে দেখেও অর্গল বন্ধ করার প্রচেষ্টা নেই। সরকারী দল ব্যবস্থা নিতে গেলে বলা হয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চালানো হচ্ছে। কিন্তু বেগম জিয়া বুঝতে নারাজ যে, যদি হাট হয়ে খুলে যায় নৈরাজ্যের দরোজাটা, তা হলে রাজনীতির ময়দানটা ভবিষ্যতে কতখানি বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে, তিনি যদি তা অনুভব না করেন তবে বিপদটা সর্বাগ্রে হানা দেবে রাজনীতিকদেরই ঘরে। অবশ্য বিএনপির কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা খুঁজতে যাওয়া বোকামি। বিএনপির ক্ষয় চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। সংগঠন ও বোধবুদ্ধি পরস্পর পাল্লা দিয়ে বিলীয়মান। দলের দুধার অধোগতি তারই অনিবার্য পরিণাম। এই দলটি মানুষের আস্থা হারিয়েছে, হারাবারই কথা। নিজের ওপর কোনও বিশ্বাস নেই যার, তাকে কে বিশ্বাস করবে? দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সহ্য করতে না পারার বিষয়টিকে তিনি সব সময় আমলে নিয়ে আসেন। তাই পদ্মা সেতু নিয়ে যে বিরূপ অর্থহীন ভাষ্য রেখেছেন জনগণের উদ্দেশে, তাতে তার পরশ্রীকাতর মনোভাব ফুটে উঠেছে অবশ্যই। প্রয়াত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলি, এ বয়সে পরনিন্দা সহজ হয়েছে, পরনিন্দায় মনের স্বাস্থ্য ভাল থাকে। সেজন্য অস্থিরতার কারণ নেই। কিন্তু ওজস্বী আলোচনার পেছনে স্বাস্থ্যোদ্ধারের সমস্ত চেষ্টাকে ছাপিয়ে, গভীর একটা হতাশা, তীব্র একটা দুশ্চিন্তাও মুখর হয়ে উঠেছে বেগম জিয়ার। এই দুশ্চিন্তার পাড় আছে কিনা ভেবে দেখা দরকার। ব্যর্থকাম মানুষ অনেক সময় অনেক অনর্থ ঘটান। বেগম জিয়া তা-ই করছেন। পেট্রোলবোমায় জীবন্ত মানুষ হত্যা করেও নির্বিকার থাকতে পারেন। দোষ অবশ্য বেগম জিয়ার ভাষারও নয়, ধর্মেরও নয়। দোষ তার মনের। মনের বিকার সব জিনিসকেই বিকৃত করে দেখে। তাই পদ্মা সেতু কিংবা এই সরকারের কোন উন্নয়নকে তিনি স্বাভাবিকতায় মূল্যায়নে গররাজি। বেগম জিয়ার রাজনীতি হয়েছে সর্বপ্রকার দুর্নীতির পরিপোষক। নগরীর রাস্তায় যেমন পুঞ্জীভূত জঞ্জাল, তার সময়ের সমাজের সমস্ত স্তরে তেমনি পুঞ্জীভূত ছিল দুর্নীতি। এ শুধু বেগম জিয়ার একার নয়, তার পুত্র এবং দলের প্রায় সবার মধ্যে ছেয়ে গিয়েছিল দুর্নীতির বিষ। কিন্তু তিনি এই গর্হিত কাজকে যেমন মনে করেন না অন্যায়, তেমনি বোমা মেরে মানুষ হত্যাকেও অপরাধ হিসেবে ধর্তব্য নয় ওনার কাছে। জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি জনগণকে নিপীড়ন করতে পিছপা হন না। বিচ্ছিন্নতা যে মানুষকে অসহায় করে, সে কথা জেনেও মানুষ আলাদা হতে চায়। বেগম জিয়ার আস্থাও তাই। তার নিকটজন পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি, স্বামী ও পিতৃপুরুষের স্বজন থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন। যা শুধু বেদনাদায়কই নয়, বিপজ্জনকও। স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মানুষ সহায় সম্বলহীন শক্তিহীন হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের একলা হবার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার রিপু। সত্যভাবে মিলিত হবার সাধনাই কল্যাণ। স্বতন্ত্র হয়ে থাকলে বঞ্চিত হবে।’ এ মুহূর্তে বিএনপি নামক দলটি ও তার নেত্রী এই রিপুটাকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছে। এটি একটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু শত্রু ওঁৎ পেতে আছে, বিশেষত আইএসআই, রিপুগ্রস্তদের অস্ত্র দিয়ে সলাপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছে। রিপুগ্রাসে পড়লে যে রাহুগ্রাসে পড়তে হয়, সে বোধ বিএনপির নেই। সংহতি বোধের অভাব গণবিচ্ছিন্নতাবাদের প্রভাব নামক সমস্যা বিএনপিরই সৃষ্টি। নিজ স্বার্থটাই লক্ষ্য বলে দেশের শুভাশুভ নিতান্তই গৌণ বেগম জিয়ার কাছে। ক্ষমতায় থাকাকালে যে পরিমাণ দুর্নীতি করেছে, সে তুলনায় মামলা হয়েছে কম। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বলে বিএনপি দাবি করছে। কিন্তু এই কথিত সঙ্কট তো তাদেরই তৈরি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তা প্রতিহত করার জন্য কি-না করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিনাশ চায়, আর উত্থান চায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের। তাই সেদিন ভোট কেন্দ্র পুড়িয়েছেন, প্রিসাইডিং অফিসারকে হত্যা করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভোট কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া, পুলিশের ওপর হামলা, এমনকি সন্ত্রাসের চূড়ান্ত পথে নেমেই বোমায় মানুষ হত্যা করেছেন। এখন তিনি চান তার সঙ্গে আলোচনা ছাড়া নির্বাচন হবে না। আলোচনা করে সমঝোতায় যেতে হবে। এখানেও সেই শাসানি। কিন্তু কেন তার সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে? অতীতে এসব নাটক রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বহুবার অভিনীত হয়েছে, যার ফলাফল শূন্য। আর আলোচনার পথ তিনি নিজেই বন্ধ করেছেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে। শেখ হাসিনা ফোনালাপে আলোচনার আমন্ত্রণ জানালেও বেগম জিয়া রুঢ় ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন আবার জজবা তুলেছেন সহায়ক সরকারের। এসবই রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজি। নির্বাচনে হেরে যাবার ভীতি তাকে দিয়ে নানা উলোটপালট কথা বলাচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি যেসব হুমকি ধমকি দিচ্ছেন, তা অক্ষমের আর্তনাদের নামান্তর। তিনি না এলেও নির্বাচন হবে যথারীতি। জনগণ তা-ই চায়।
×