ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেনাপোল বন্দরের উন্নয়ন কাজে অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৭ জানুয়ারি ২০১৮

বেনাপোল বন্দরের উন্নয়ন কাজে অনিয়ম

আবুল হোসেন, বেনাপোল ॥ অবকাঠামো উন্নয়নে চরম অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বদলি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম চলছে দেশের বৃহত্তম স্থল-বন্দর বেনাপোলে। দীর্ঘদিন ধরে এসব চলে আসলেও দেখার যেন কেউ নেই। অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ স্থল-বন্দর কর্তৃপক্ষের বেনাপোল বন্দরে নিয়োজিত এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব কাজে জড়িত। আবার এদের নেপথ্যে কাজ করছে স্থল-বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী, সে কারণে কোনভাবেই এসব বন্ধ হচ্ছে না। সম্প্রতি বেনাপোলে ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে যেসব অবকাঠামোর কাজ চলছে তাতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেছেন বেনাপোলের ব্যবসায়ীরা। বেনাপোল স্থল-বন্দরের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, স্থলবন্দরের পণ্য উঠানামা ও যানজট নিরসনে ২টি আধুনিক সেড, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডের ছাউনি, ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল ইয়ার্ডসহ রাস্তা ও ড্রেনেজের নির্মাণ কাজ চলছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় নির্মাণ কাজে পুরাতন রড, ইট ও খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি সিডিউল মোতাবেক কাজ করা হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দরে যানজট ও পন্যজট নিরসনে ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার মনিকো লিমিটেড নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২টি আধুনিক সেড, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডের ছাউনি, ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল ইয়ার্ডসহ রাস্তা ও ড্রেনেজ নির্মাণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতর কার্যাদেশ প্রদান করেন। ২৬ সেপ্টম্বর ঠিকাদার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি সেড ভেঙ্গে দুইটি সেড নির্মাণ ও পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডের ছাউনি, ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল ইয়ার্ড, রাস্তা ও ড্রেনেজের নির্মাণ কাজ অত্যন্ত নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে করা হচ্ছে। বন্দরে ২০ বছর পূর্বে নির্মিত ভাঙ্গা আটটি সেডের ইটের খোয়া ও রড ব্যবহার করে বেজ ঢালাই দেয়া হয়েছে। আর ব্যবহার করা হয়েছে নি¤œমানের বালি, যা ব্যবহারের অনুপযোগী। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নির্মাণ কাজে পুরাতন ইট, ইটের খোয়া ও বালিসহ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত সকল উপকরণ অত্যন্ত নি¤œমানের। বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ঠিকাদার এ অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে বন্দরে গিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ইঞ্জিনিয়ার পার্থ প্রতিম কুন্ডুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি। বেনাপোল স্থল বন্দরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আমিনুল ইসলাম বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দরে ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৬০-৭০ ভাগ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বেনাপোল সিএ্যান্ডএফ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, প্রতিবছর এই বন্দর থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোর চিত্র বেহাল। এতে পণ্য খালাসে বিলম্ব ও অর্থনৈতিক ক্ষতিতে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আজ ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে কিছু কাজ শুরু হলেও সেখানে পুরানো আধলা ইটের ব্যবহার দুঃখজনক। আমদানি-রফতানি সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতি আমিনুল হক বলেন, এপথে বাণিজ্যের গুরুত্ব বাড়ায় ইতোমধ্যে বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে অত্যাধুনিক স্থাপনা তৈরি হয়েছে। সেখানে পুরো বন্দর এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন, রয়েছে উন্নত মানের সড়ক ব্যবস্থা, শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত এসি ওয়ার হাউজ, চোরাচালান প্রতিরোধে স্কানিং ব্যবস্থাসহ আরও অনেক আধুনিক ব্যবস্থা। কিন্তু বেনাপোল বন্দরে ওই একই সুবিধা থাকার কথা থাকলে ও আজ পর্যন্ত একটিও গড়ে ওঠেনি। বেনাপোলের একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেছেন, অবকাঠামো উন্নয়ন কাজে দুর্নীতির পাশাপাশি বন্দরের সর্বক্ষেত্রে চলছে নানা অনিয়ম। যেমন বন্দরের গেটপাশ শাখায় পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে প্রতিদিন ঘুষ আদায় করা হয় প্রায় ২ লক্ষ টাকা। আবার বন্দরের যেসব স্টোর কিপার (শেড ইনচার্জ) রয়েছেন তারা পণ্য চুরিসহ শুল্ক ফাকির কাজে সরাসরি জড়িত। এসব ইনচার্জরা কেউ কেউ দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই বন্দরে নিয়োজিত রয়েছেন। সহজে এরা এখান থেকে বদলি হয় না। এছাড়া যারা দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছেন, তাদের বদলি না করে এক সেড থেকে আরেক সেডে স্থানান্তর করেন চেয়ারম্যান নিজে। এই স্থানান্তরের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এই বন্দরে কর্মরত স্টোর কিপাররা তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রী প্রয়াত লে. কর্নেল আকবর হোসেনের(অব:) সময়ে চাকরিতে যোগদান করেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র ও যুবদলের এক সময়কার ক্যাডার। বর্তমানে বেনাপোল বন্দরে এরা দাপটের সঙ্গে চাকরি করে চলেছেন। মজার বিষয় হচ্ছে এরাই আবার বর্তমানে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তীর খুবই আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। বেনাপোল বন্দরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিম পুরানো আধলা ইট ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, বন্দরের পুরানো স্থাপনা ভাঙ্গার পর সেখান থেকে এক কোটিরও কিছু বেশি পরিমাণে আধলা ইট পাওয়া গেছে। বিস্তারিত কথা বলার জন্য পরামর্শ দেন ঢাকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হাসান আলী উন্নয়ন কাজে অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেন আমরা যে ইট ব্যবহার করছি এটার কোয়ালিটি অনেক ভাল। সে কারণে মেকাডামে এগুলো ব্যবহার করছি। তিনি আরও বলেন, নতুন পুরাতন এক সঙ্গে মিক্সড করেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া আমরা যখন টেন্ডার করি তখন এটা ব্যবহার করা যাবে এমন শর্ত ছিল। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদকের কাছে মোবাইল ফোনে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে সরাসরি তার সঙ্গে দেখা করে কথা বলার পরামর্শ দেন।
×