ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা আসার সঙ্গে বেড়েছে পাচার

মিয়ানমারে ৪৫ ইয়াবা ফ্যাক্টরি, মাসে আসে ৩০ কোটির চালান

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৭ জানুয়ারি ২০১৮

মিয়ানমারে ৪৫ ইয়াবা ফ্যাক্টরি, মাসে আসে ৩০ কোটির চালান

শংকর কুমার দে ॥ মিয়ানমারের ৪৫ ইয়াবা কারখানায় তৈরি ইয়াবার চালানে প্রায় প্রতিদিনই লাখ লাখ ইয়াবা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে প্রতিমাসে গড়ে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ইয়াবার চালান আসছে সাড়ে ৩ শতাধিক কোটি টাকার ইয়াবা। বাংলাদেশের বাজারকে টার্গেট করে মিয়ানমারের এসব ইয়াবা কারখানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে ১৩ ধরনের ইয়াব। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৭২ কিলোমিটারই অরক্ষিত। ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারাও। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মরন নেশা ইয়াবার চালান আসার ঘটনাও বেড়েছে। হেরোইন, বাংলা মদ, চরস, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদকের স্থান দখল করে নিয়েছে ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসা কোনভাবেই বন্ধ করতে না পারায় গোটা বাংলাদেশ গিলে খাচ্ছে মিয়ানমারের ইয়াবার চালান। শনিবার পুলিশ সদর দফতরে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমরা মাদক নির্মূল করতে পারিনি। মাদক একটি বড় সমস্যা। মাদকের মধ্যে বড় সমস্যা হচ্ছে ইয়াবা। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শুধু পুলিশ বা আইন দিয়ে কিছু হবে না। এগুলোর জন্য সামাজিক, পারিবারিক জনমত গড়ে তুলতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের উচ্চপর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে উঠেছে ৪৫ ইয়াবা তৈরির কারখানা। মিয়ানমার থেকে প্রায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে সীমান্ত দিয়ে সমুদ্রপথে ট্রলার ও নৌকাযোগে মরণ নেশা ইয়াবার চোরাচালান আসছে বাংলাদেশে। প্রতিমাসে গড়ে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। প্রতিবছর ইয়াবার চালান আসছে সাড়ে ৩ শতাধিক কোটি টাকার ইয়াবা। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করছে ইয়াবা চোরাচালান সিন্ডিকেট। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগর পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালানা কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই বাংলাদেশে আসা অব্যাহত আছে ইয়াবার চালান। বাংলাদেশের মাদকসেবীদের কাছে হেরোইন, ফেনসিডিলকে পেছনে ফেলে মরণ নেশা ইয়াবাই দখল করে নিয়েছে। এ জন্য ইয়াবা পাচার রোধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করার পরও কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার চোরাচালান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার কারখানাগুলো ও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার পরও ইয়াবা বন্ধ হচ্ছে না। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে দেশে ২ লাখ ৮৭ হাজার ২শ’ ৫৪টি মাদক মামলা হয়েছে। পুলিশের দাবি দিনদিন মাদক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। ফেনসিডিল, চরস, ভাং, গাঁজা হেরোইন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ইয়াবায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে দেশ। নগর মহানগর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চল এমনকি নিভৃত পল্লীতেও মুড়ি মুড়কির মতো পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা। এখন যুক্ত হয়েছে ‘হোম ডেলিভারি’ মোবাইলে অর্ডার দিলেও ঠিকানামত পৌঁছে দেয়া হচ্ছে ইয়াবা। জরুরী ভিত্তিতে টাস্কফোর্স গঠন করে মিয়ানমারে গিয়ে ইয়াবা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ গঠন করা উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গত ২০১৩ সালে সারাদেশে মাদকের মামলা হয়েছে ৩৫ হাজার ৮শ’ ৩২, ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ৪২ হাজার ৫০১। ২০১৫ সালে ৫৭ হাজার ৬শ’ ৬৯টি। ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ২৬৮। ২০১৭ সালে ৯৮ হাজার ৯৮৪। পরিসংখ্যানে দেখা যায়। প্রতিবছর মাদকের মামলা বেড়েছে। অর্থাৎ মাদক উদ্ধার বেশি হয়েছে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে তাদের দেশের সীমান্ত এলাকায় গড়ে উঠা ইয়াবা তৈরির কারখানার তালিকা দেয়া হয়। প্রদত্ত তালিকায় মিয়ানমারকে ৪৫টি ইয়াবা কারখানার বিষয়ে তথ্য দেয় বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৩৭টি কারখানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াব তৈরি হচ্ছে, যার বাজার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৭২ কিলোমিটারই অরক্ষিত। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। ইয়াবা চোরাচালানে ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগর পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মিয়ানমারের মংডু, সিটওয়ে, মইং, কুখাই, নামকখাম, শান, ওয়া, মংশাত, তাশিলেক, মংপিয়াং, মংইয়াং ও পাংশাং, কুনলং, টেংইং, সেন, লুই হুপসুর, কাইয়াং, মাহাজা এ্যান্ড হুমং, কেউও, মাওকমাই, কাকাং মংটন কাশিন ও আইক্কা এলাকায় ইয়াবা কারখানা বেশি। ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলোর মধ্যে ১০টি গড়ে উঠেছে মংডু এলাকায়ই। এখন নাফ নদী পার হয়ে নৌযানে ইয়াবার চালান টেকনাফ, কক্সবাজার হয়ে সরাসরি রাজধানীতে চলে আসে। এছাড়া সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে ইয়াবাসহ অস্ত্রের চালান আসছে। এই ইয়াবার চালান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিনা বাঁধায় চলে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। গত আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঢল নামার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মরণ নেশা ইয়াবা পাচার বেড়ে গেছে। মিয়ানমারের ইয়াবায় বিষাক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। বলা হতো শুধু রোহিঙ্গারাই ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীসহ তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই এখন ইয়াবা পাচারে সরাসরি জড়িত। দমনপীড়ন ও নির্যাতনের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নগদ টাকা পয়সাসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাদের হাতে ইয়াবার চালান তুলে দিচ্ছে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মিয়ানমার থেকে ইয়াবাসহ আটক রোহিঙ্গাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া এমন তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে র‌্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফর, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও গডফাদারের তালিকা তৈরি করা হয়। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সব জায়গায়ই ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। এতে সহজেই আসক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে নারী নির্যাতনসহ নৃশংসতা বাড়ছে। খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। মাদকাসক্ত সন্তান তার মা-বাবাকে হত্যা করছে, মাদকাসক্ত বাবা-মা’র হাত ধরে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনাও এখন ঘটছে। এটা দেশের জন্য এখন বড়ই বিপদ।
×