ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আবদুল হাই

অভিমত ॥ ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য...

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৭ জানুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য...

‘ছাত্রলীগকে হতে হবে মেধাভিত্তিক সংগঠন’- স্বদেশ রায়ের জ্ঞানগর্ভ লেখাটি মনোযোগের সঙ্গে পড়লেই বুঝা যায় তার মনে যে আকুতি- ছাত্রলীগ দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্ব সর্বক্ষেত্রে দেয়ার জন্য ভবিষ্যত যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করুক তেমনি শঙ্কাও আছে যখন তিনি বলেন ‘আজ যারা ছাত্রলীগ করছে তারা নিশ্চয়ই চাইবে না যে, তারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে গিয়ে দেখুক, তার দেশের মানুষ এক সময়ে যে কাজগুলো ক্রীতদাস দিয়ে করানো হতো সেই কাজগুলোই এখন করছে’ আক্ষেপের করুণ সুর অনুরণিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ভিক্ষুকের জাতির কোন সম্মান নেই; আমি ভিক্ষুকের জাতির নেতা হতে চাই না’ তার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব আজকের যারা ছাত্র তারা যদি শিক্ষা-দীক্ষায় পারদর্শী হয়ে ভবিষ্যত নেতৃত্ব নেয়ার যোগ্য হয়ে গড়ে উঠে। কিন্তু আমরা সারাদেশে ছাত্র সংগঠনগুলোর যে অবস্থা দেখছি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে তাতে মেধাবিকাশে কাজ করার মানসিকতাই বিলুপ্তির পথে। সাংগঠনিক বিপর্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি ছাড়িয়ে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত হচ্ছে ছাত্র সংগঠন; কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। উপজেলা ছাত্রলীগ কেন হবে কিভাবে হবে যেখানে উপজেলা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি হলো একটি প্রশাসনিক ইউনিট। ছাত্রলীগের কমিটি নির্বাচনে আগে বিশ্ববিদ্যালয়র হল কমিটিগুলোতে চৌকস ছাত্রদের দলে আনা হতো; যাদের মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম শ্রেণী থাকত তাদের দলে ভেড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। ’৬৯-এর গণআন্দোলন; ’৭০-এর নির্বাচন পর্যন্ত ছাত্রলীগ নিজস্ব কর্মসূচী নিয়েই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল; কখন আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যায়নি। ৪৬ বছর পর কেন আজ ছাত্র সংগঠনগুলোর এ বেহাল অবস্থা? আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে লালিত একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে পেরেছি? ঘটা করে যে শিক্ষানীতি করা হলো; যা এখন চলমান তাতে কী আমাদের প্রাপ্তি শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ নয়? কোমলমতি ছাত্রদের গিনিপিগ বানিয়ে চমকদার বই বিতরণ উৎসবই কি সব? আমেরিকা-ইংল্যান্ডের শিক্ষানীতিতেও এত উদার বাণিজ্যিকীকরণ নেই; সেখানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সরকারী নিয়ন্ত্রণেই একই কারিকুলাম সকলের বেলা প্রযোজ্য; কোন বেসরকারী পাবলিক স্কুল হলেও তাকে সরকারী কারিকুলাম মেনেই স্কুল পরিচালনা করতে হয়। স্বাধীনতার পর পর আমরা চেষ্টা করেছিলাম গ্রামে-গঞ্জে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের; সফলকামও হয়েছিলাম অনেকটা; কিন্তু এরশাদের দোসর মাওলানা মান্নানের হাতে পড়ে স্কুল প্রতিষ্ঠার বদলে শুরু হয় বিভিন্ন নামের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার হিড়িক; এরপর আসে এনজিও; তারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দরাজ হস্তে দান করতে চায় তাদের নিজস্ব ঢং-এ। চলে কিন্ডার গার্টেন আর বিভিন্ন বিদেশী নামের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের রমরমা ব্যবসা। শেষ পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে পরীক্ষা আর সার্টিফিকেট বিতরণের এক জাতীয় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করে জিপিএ প্রাপ্তিকে ছাত্র অভিভাবকদের মূল টার্গেটে পরিণত করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করাকে অনৈতিক ব্যবসায় পরিণত করে ছাত্রছাত্রীদের জিপিএ-৫ এর ঘেরটোপে আটকিয়ে ফেলা হয়েছে। মানুষ গড়ার কারিগররা জড়িয়ে পড়েছেন কোচিং ব্যবসার পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারবারে; খোদ শিক্ষামন্ত্রীরই এ অভিযোগ। এ রকম শিক্ষাব্যবস্থায় ভবিষ্যত নেতৃত্ব গড়ে উঠা যে আদৌ সম্ভব নয় এতদিনে তা একরকম প্রমাণিত সত্য। কেবল শিক্ষাব্যবস্থা নয়; রাজনীতির অঙ্গনে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর তছনছ করে দেয়া হয় পুরো রাজনৈতিক পদ্ধতি। পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণে অপরাজনীতির বিকাশ এত বিস্তৃতি লাভ করে দু’দুটি সামরিক সরকারের সময়ে; ৯১ এ একরকমের মিলেঝুলে গণতন্ত্র যাত্রা শুরু হলে ও ছাত্র রাজনীতি তার পুরনো গৌরব পুনরুদ্ধারে এখনও সক্ষম হয়নি। ছাত্রলীগ যেহেতু পুরো প্রক্রিয়ারই অংশ; এ কারণে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ছাত্র রাজনীতি বলতে যা বুঝায় সেখানে ফিরে যেতে পারছে না। ১/১১ এর মইনউদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকার রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধি জারি করে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে কোন সহযোগী সংগঠন করা যাবে না বলে বিধান করলেও রাজনৈতিক দলগুলো; নিবন্ধন আইন পুরোপুরি মানা এবং ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে সংগঠন করা বন্ধ করেনি; ছাত্রলীগ-ছাত্রদল এখনও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনৈতিক দল দ্বারা। ছাত্রলীগকে সহযোগী সংগঠন না বলে এখন বলা হয় ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ সংগঠন। নিয়ন্ত্রণ এখনও রাজনৈতিক দলের হাতে। কমিটি গঠন থেকে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে রাজনৈতিক দল দ্বারা। তথাকথিত ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ সংগঠনের নামে রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে না পারলে ছাত্রলীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেয়া সুদূরপরাহত! লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব
×