ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

নতুন বইয়ের সুবাস

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

নতুন বইয়ের সুবাস

নাভেন এবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে। একে তো নতুন স্কুল! তার ওপর আবার ভর্তি হতে গেলে বড় ম্যাডাম জানিয়েছেন, প্রথম দিনই নতুন বই দেয়া হবে সবাইকে। সব মিলিয়ে ভীষণ খুশি নাভেন। আগে যখন সে তার বড় ভাইয়াকে স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যেতে দেখত, তখন আম্মুর কাছে জানতে চাইত- আম্মু, আমি কবে স্কুলে যাব? আমাকে কবে তুমি টিফিনে মজার মজার খাবার দেবে? নাভেনের কথায় আম্মু তখন ভীষণ আনন্দ পেত। বলত, তুমিতো এখনও অনেকটা ছোট বাবা। আরেকটু বড় হলেই তোমাকে ভাল একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। আর তখন তোমাকেও টিফিনে মজার মজার খাবার দেয়া হবে। স্কুলে ভর্তি হয়ে ফেরার পথেই স্কুল ড্রেস বানাতে দিয়ে আসা হয়েছিল নাভেনের। আজ বিকেলে আব্বু গিয়ে সেগুল নিয়ে এসেছে। আম্মু ওকে স্কুল ড্রেস পরে দেখাতে বললেও দেখায়নি ও। নতুন স্কুল ড্রেসের ভাজ ভাঙ্গতে কেমন যেন মায়া লাগছিল ওর! তাই শার্টটার ওপর কয়েকবার হাত বুলিয়ে আলমারিতে তুলে রাখল নাভেন। নতুন স্কুল ড্রেস, জুতা, স্কুল ব্যাগ সব মিলিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য নাভেনের আর তর সইছে না। তাছাড়া কাল আবার নতুন বইও দেবে স্কুল থেকে। বইগুল নিশ্চয় রঙ্গিন রঙ্গিন সব ছবিতে ঝকমক করবে! তবে ও ঠিক করেছে, নতুন বইগুল নিয়ে এসে ভাইয়াকে একটুও ধরতে দেবে না। গতবছর ভাইয়ার নতুন বইগুলো পাতা উল্টে দেখতে গিয়ে একটা পাতা সামান্য একটু ছিড়ে ফেলায়, অনেক বকাবকি করেছিল ভাইয়া ওকে। নাভেনের ভাবনায় এসে বাঁধ সাধল ওর আম্মু। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আজ একটু জলদিই ঘুমিয়ে পড়, বাবা। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। আম্মুর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল নাভেন- এখনই ঘুমাচ্ছি, আম্মু। আচ্ছা, তুমি কালকে আমাকে কি টিফিন বানিয়ে দেবে? ছেলের কথায় হেসে উঠল নাভেনের আম্মু। বলল, কাল তো স্কুলে বই উৎসব হবে। কোন ক্লাস হবে না। বই নিয়েই আমরা বাসায় চলে আসব। পরশু থেকে তোমাকে রোজ টিফিন বানিয়ে দেব স্কুলে যাওয়ার সময়। -আচ্ছা, ঠিক আছে। গুড নাইট, আম্মু। -গুড নাইট, বাবা। ঘরের আল নিভিয়ে দিয়ে চলে গেল নাভেনের আম্মু। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল নাভেন। পরদিন সকালে আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গল ওর। বিছানা ছেড়ে উঠে আসতেই আম্মু বলল, হাতমুখটা ধুয়ে নাও, বাবা। এরপর স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হতে হবে। তোমার আব্বুও আজ তোমার সঙ্গে স্কুলে যাবে বলে অপেক্ষা করছে। আম্মুর কথামত হাতমুখ ধুয়ে আসল নাভেন। এরই মধ্যে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল আম্মু। নাস্তা শেষে রেডি হওয়ার পালা। আলমারি থেকে স্কুল ড্রেস বের করে আম্মুর হাতে দিল নাভেন। এক এক করে শার্ট, প্যান্ট, টাই, জুতা সবকিছু পরিয়ে দিল আম্মু ওকে। এরপর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ওকে নাকি রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে! এমন সময় নাভেনের আব্বুর ডাক শোনা গেল। স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। আব্বু ওকে আর আম্মুকে স্কুলে নামিয়ে অফিসে চলে যাবে। আব্বুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে আসল নাভেন। পেছনে পেছনে ওর আম্মুও। বাসা থেকে নাভেনের স্কুল দশ মিনিটের পথ। রিক্সায় করে স্কুলের গেটে গিয়ে নামল ওরা তিনজন। স্কুল গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল ছোট থেকে বড় সব ক্লাসের ছেলেমেয়েরা লাইন করে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটা ক্লাসের এক থেকে দশ পর্যন্ত রোল যাদের, তাদের এখানে বই দেয়া হবে। বাকিদের যার যার ক্লাসে বই দেবেন ক্লাস টিচার। আর ক্লাস ওয়ানের সবাই যেহেতু নতুন, ওদের বইগুলো এখানেই দেয়া হবে এক এক করে। একজন টিচার এসে নাভেনকে লাইনে দাঁড়া করিয়ে দিলেন। ছোট হওয়ায় সবার প্রথমে ক্লাস ওয়ানের ছেলে-মেয়েদের কে বই দেয়া হবে বলে জানালেন বড় ম্যাডাম। শুনে নাভেনের আনন্দ আরও বেড়ে গেল। একে তো সবার আগে ওদের বই দেয়া হবে। তার ওপর সেই লাইনে সবার প্রথমে দাঁড়িয়ে আছে ও নিজে। এর মানে বড় ম্যাডাম সবার প্রথমে ওর হাতেই বই তুলে দেবেন। মাইকে ঘোষণা দিয়ে বই দেয়ার কাজ শুরু“ করলেন বড় ম্যাডাম। একসেট বই নিয়ে এসে তুলে দিলেন নাভেনের হাতে। এভাবে ধীরে ধীরে সকলের হাতে বই তুলে দিয়ে বই উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো। নাভেনও নতুন বই নিয়ে আম্মুর সঙ্গে বাসায় ফিরে আসল। আনন্দ যেন ধরছেই না ওর মনে। বাসায় এসেই ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল নাভেন। এখন আর কোন দিকে খেয়াল নেই ওর। সুন্দর সুন্দর রঙ্গিন ছবিতে সাজানো সবগুলো বই। আপন মনে ছবিগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে দেখছে ও। বইয়ের পাতায় থাকা ফুলের ছবি নিয়ে গালে মাখছে। আবার নাক দিয়ে নতুন বইয়ের গন্ধও শুঁকে দেখছে। মনে হচ্ছে, নতুন বইয়ের সুবাস যেন ওদের বাগানের ফুলগুলোর মতোই মিষ্টি। আম্মু আর ভাইয়া নাভেনের পাশে দাঁড়িয়ে ওর নতুন বইয়ের স্বাদ নেয়া দেখছে, আর হাসছে। একটু পর ভাইয়া নাভেনকে জিজ্ঞাসা করল, নতুন বই কি শুধু তুমি একাই দেখবে? আমাদের দেখাবে না? ভাইয়ার কথায় হুঁশ ফিরল নাভেনের। উত্তর দিল, হ্যাঁ, সবাইকেই দেখাব। কিন্তু খুব সাবধানে বইয়ের পাতা উল্টাবে তোমরা। যেন আমার বইয়ের কোন পাতা ছিড়ে না যায়। নাভেনের কথায় হাহা করে হেসে উঠল ওর ভাইয়া। জবাব দিল, ঠিক আছে। আমরা খুব সাবধানেই তোমার নতুন বই দেখব। তবে তুমি এখন বুঝতে পারছ তো, নতুন বইয়ের একটু ক্ষতি হলেই কেমন খারাপ লাগতে পারে? ভাইয়ার কথা শুনে আবারও মনে পড়ে গেল গতবছরের কথাটা। সত্যিই তো, বইগুলোর ওপর সে নিজেও কত যতœ করে হাত বুলাচ্ছিল, গন্ধ শুঁকে দেখছিল। নতুন বইয়ের কোন ক্ষতি না হয়ে যায় ভেবে, আম্মু আর ভাইয়ার কাছে বই দিতেও তার ভয় ভয় লাগছে। আর সে তো ভাইয়ার বইয়ের একটা পাতার খানিকটা ছিড়েই ফেলেছিল। নিশ্চয় ভাইয়ারও তখন খারাপ লেগেছিল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভাইয়াকে সরি বলে নিল নাভেন। আর ভাইয়ার হাতে বইগুলো দিতে দিতে দুষ্টুমির ছলে বলল, তুমি আবার যেন জেদ করে আমার বইয়ের পাতা ছিড়ে দিও না, ভাইয়া। ২য় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×