ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টিভি মিডিয়া এখন এজেন্সি ও দালাল চক্রে বন্দী ॥ মারুফ খান প্রেম

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

টিভি মিডিয়া এখন এজেন্সি ও দালাল চক্রে বন্দী ॥ মারুফ খান প্রেম

মারুফ খান প্রেম। এই সময়ের অন্যতম প্রযোজক, অভিনেতা ও পরিচালক। এক সময় সুভাষ দত্ত, শিবলী সাদিক এবং জাকির হোসেন রাজুর মতো গুণী পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ছোট পর্দায় নিয়মিত প্রযোজনার পাশাপাশি অভিনয়ও করছেন। এই বয়সেই প্রযোজক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। তার প্রযোজিত অসংখ্য ধারাবাহিক ও খন্ড নাটক জনপ্রিয় হয়েছে। দেশীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধি ও প্রসারে কাজ করছেন। সাম্প্রতিক মিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তরুণ এই মিডিয়া কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। প্রথমেই জানতে চাই এই বয়সেই প্রযোজনায় আসলেন কেন? মারুফ খান প্রেম : দেখুন ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়জুড়ে আমি সুভাষ দত্ত, শিবলী সাদিক এবং জাকির হোসেন রাজুর সঙ্গে কাজ করেছি। ওই সময়ই আমার মনে হয়েছে আমি তো টিভি নাটক নিয়ে কাজ করতে পারি। সেই চিন্তুা থেকেই আমার এই প্রযোজনায় আসা। বিশেষ করে টিভি মিডিয়ায় একটা পরিবর্তনের তাড়না থেকেই আমি এই কাজটি করছি। আমি মনে করি শিল্প সংস্কৃতির সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রযোজনা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নাটক প্রযোজনার মাধ্যমে এ অঙ্গনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে চাই। এ পর্যন্ত কয়টি নাটক প্রযোজনা করেছেন ? মারুফ খান প্রেম : আমার প্রথম প্রযোজনা ছিল নাটক ‘নীল চাদোয়া’। নাটকটি ২০০৫ বাংলাভিশনে প্রচার হয়। ম আ সালাম রচিত নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন কায়সার আহমেদ। এরপর ৩০টির অধিক নাটক প্রযোজনা করেছি। সর্ব শেষ ‘সহযাত্রী’, ‘ঘোমটা’ ধারাবাহিক প্রযোজনা করেছি। এক ঘণ্টার প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘৭১’, ‘মায়ার খেলা’, ‘সম্রাট শাহজাহান’, ‘মিশন ইরানী রয়েল রিসোর্ট’, ‘পুতুল রহস্য’ ‘জলছবি’, ‘রেড ড্রাগন রজনীগন্ধা’, ‘ফেরারী মেঘ’, ‘আমি নায়ক হব’ প্রভৃতি। এ ছাড়া ‘একটি ক্লিপের আত্মকাহিনী’ নামে একটি নাটক পরিচালনাও করেছি। নতুন ধারাবাহিক নাটকগুলোর খবর কী? মারুফ খান প্রেম: নতুন কয়েকটি প্রযোজনা হাতে নিয়েছি। কিছু শূটিংও শুরু হয়েছে। সামনে মাস থেকে সব প্রজেক্ট নিয়ে নামব। এগুলো পরিচালনা করবেন মনন আসাদ। এখন বাইরের কিছু বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত আছি। তার পরই নাটকে আবারও নিয়মিত হব ইনশাআল্লাহ। তবে বাস্ততবতা হচ্ছে মিডিয়ায় এখন যে অবস্থা তাতে খুব বেশি কাজ করতে ইচ্ছেও হয় না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কী? মারুফ খান প্রেম : দেখুন আমি মনে করি বর্তমানে টিভি মিডিয়া ক্রান্তিকাল পার করছে। এই মিডিয়া এখন এজেন্সির দালাল আর চামচাদের দখলে। তাদের কারণে ভাল কাজ খুব কম হচ্ছে। কোয়ালিটি এবং কোয়ান্টিটির কোন বালাই নেই বললেই চলে। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বলি। সম্প্রতি কোন এক চ্যানেলের কর্তা হাসপাতালে আছেন খবর পেয়ে আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম কোন একজন প্রযোজক চ্যানেল কর্তার শরীর ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। ঘটনা দেখে আমি অবাক হলেও ওই প্রযোজকের কিছু আসে যায় না বলেই মনে হয়েছে। ওই ম্যাসেজকারী প্রযোজক কিন্তু ওই চ্যানেলে রেগুলার কাজ করছে। আরও একজন প্রযোজককে জানি যিনি শীর্ষ ৫টা চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রধান বা চ্যানেলের প্রধান কর্মকর্তার কাছে কান্নাকাটি করে বলেন ভাই আমি আমার অফিস চালাতে পারছি না, সংসার চালাতে পারছি না। আমাকে একটা কাজ দেন। নইলে বাঁচতে পারব না। একই ভঙ্গিমায় সে সবার সঙ্গে কান্নাকাটি করে একই ডায়ালগ মারে। এখন কথা হচ্ছে একটা মাস্টার্স ডিগ্রীধারী শিক্ষিত মানুষ কখনই এতটা নিচে নামতে পারে না। ওই সব প্রচারমুখী মিডিয়াকর্মী বা প্রযোজকদের প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। এই দুই জনের মধ্যে একজন তো সব সময়ই গর্ব করে বলে আমি ঢাকা শহরে আসছি ১৭ টাকা নিয়ে। আজকে আমি এত টাকার মালিক। সেই প্রযোজকইছোটবেলায় আমার এক পরিচিত জনের বাসায় কাজের লোক হিসেবে ছিল। যেটা আমি পরে জেনেছি। তাহলে আমরা তাদের মতো মানুষের কাছে থেকে কি ভাল কাজটা পেতে পারি? মোট কথা মিডিয়ায় এখন শিক্ষিত, নৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন, দক্ষ এবং ভদ্র মানুষের অভাব। এই সঙ্কট নিরসনের উপায় কী বলে মনে করেন? মারুফ খান প্রেম: এ প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্টরাই ভাল বলতে পারবেন। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চ্যানেলগুলোতে দেমাগী এবং চৌকস অনুষ্ঠান প্রধান দরকার। যারা চ্যানেলের মালিকের অনৈতিক প্রেসার বা এজেন্সির দালালদের কাছে নিজের মেধা, যোগ্যতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নৈতিক শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দেবে না। নিজের স্বার্থে কিংবা চাকরি হারানোর ভয়ে চ্যানেল মালিকের অনৈতিক হুমকি বা অন্যায় সিদ্ধান্তের কাছে নত হবে না। অনুষ্ঠান প্রধান তার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় দর্শকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে অনুষ্ঠান নির্মাণ করবে এবং ভাল নির্মাতাদের সুযোগ দেবে। কারণ একজন চ্যানেলের মালিক বোঝে ব্যবসা। অনুষ্ঠান সম্পর্কে সে ইন্টারফেয়ার করবে কেন? চ্যানেল মালিক যখন অনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নি¤œমানের প্রডাকশন চালায় তখন অনুষ্ঠান প্রধানেরও কিছু করার থাকে না। অতএব অনুষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে মালিকদের প্রভাবমুক্ত হয়ে এজেন্সির দালালদের এড়িয়ে চলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এজেন্সির দালালরা বড় মাপের মোটিভেটর। তারা মিডিয়ায় প্রচলিত দুটি অনৈতিক উপায়ে চ্যানেলের মালিক বা অন্যতম প্রধান কর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে। দুই একজন প্রযোজক যেমন চ্যানেল কর্তার চামচামি করে, তেমনি চ্যানেল কর্তা আবার মালিকের চামচামি করে, মালিক আবার তার উপরের কর্তাদের চামচামি করে। এই ভাবে পুরো টিভি মিডিয়া এজেন্সি ও চামচা ও দালাল চক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে। এই চামচামি আর দালাল চক্রের কারণে চ্যানেলগুলোতে ভাল অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এই চক্র থেকে বের হয়ে নিরপেক্ষভাবে ভাল অনুষ্ঠান নির্মাণ এবং প্রচারের চেষ্টা চালাতে হবে। আশার কথা বাংলাদেশে এখনও ২-৪ জন অনুষ্ঠান প্রধান আছেন। তবে তাদের আরও সচেতন হতে হবে। যখন সব চ্যানেলে চৌকস এবং দেমাগী অনুষ্ঠান প্রধান নিজেদের মেধা মনন ও ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন আমার বিশ্বাস তখন ভাল ভাল প্রডাকশন বাড়বে। ভাল ভাল অনুষ্ঠান বেশি দেখা যাবে। আমাদের মিডিয়া সমৃদ্ধ হবে। মিডিয়া কর্মীদের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য কী? মারুফ খান প্রেম: দেখুন দেশের প্রখ্যাত সব ডিরেক্টর ও অভিনয় শিল্পীদের আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি। সেখান থেকে আমার উপলব্ধি এই যে এই জায়গাটা ক্ষণস্থায়ী। এখানে টিকে থাকতে হলে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে নিষ্ঠা, সততা, আন্তরিকতা, সময়জ্ঞান ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। তাহলে ওই সময়ের কারণেই সে টিকে থাকবে অনেক দিন। -সাজু আহমেদ
×