ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অপরিকল্পিত নগরায়ণেস্বাস্থ্যসেবায় নেতিবাচক প্রভাব

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

অপরিকল্পিত নগরায়ণেস্বাস্থ্যসেবায় নেতিবাচক প্রভাব

নিখিল মানখিন ॥ একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করেও নগর স্বাস্থ্যসেবায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় তৈরি হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যসেবার ওপর। এমন অভিযোগ তুলেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নগরীতে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার বহুগুণে বেড়ে গেছে। আবাসিক এলাকা, শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে একাকার। পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। নগরমুখী মানুষের সংখ্যা চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে । অপ্রতুল জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে নগরবাসী। চারদিকের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সরকারী এমনকি বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে সরকারী চিকিৎসা সেবার সীমাবদ্ধতা ও অব্যবস্থাপনা। নগর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও আধুনিকায়নের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে নগরায়ন। তবে দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নে জনসংখ্যার আধিক্য ও যত্রতত্র কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দালানকোঠা গড়ে ওঠার পাশাপাশি রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব, মানসিক ও স্নায়ুবিক চাপ বৃদ্ধি, সুপেয় পানির সঙ্কট, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা, পরিবেশ ও বায়ুদূষণ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিক, ধূমপান ও মদ্যপানের প্রবণতা বৃদ্ধিসহ মৃত্যু, সন্ত্রাস, সড়ক দুর্ঘটনা ও আঘাত ইত্যাদি বেড়ে যাবে। যার পরিণতি ভোগ করতে হবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে শহরের বস্তিবাসী বা নিম্ন আয়ের মানুষদের। তাই উন্নত নগর স্বাস্থ্যের জন্য উন্নত নগর পরিকল্পনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, পৃথিবীতে ইতোমধ্যে প্রায় ৩শ’ কোটি মানুষ নগরে বসবাস করছে এবং ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০৩০ সালে বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ শহরে অবস্থান করবে। বাংলাদেশের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। শহরে মানুষ বাড়লেও সেই তুলনায় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সুবিধা বাড়ছে ধীর গতিতে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে নগর জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ ও অস্বাস্থ্যকর। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বিদ্যমান সমস্যা দূর করার চেষ্টা করা দরকার। অপরিকল্পিত নগরায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যসেবার ওপর। অধিক জনসংখ্যার কারণে বিঘিœত হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা। নগর স্বাস্থ্যসেবায় একাধিক মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সিটি কর্পোরেশন এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনেই নগর স্বাস্থ্যসেবা দেখাশুনার একটি বিভাগ থাকে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার পাওয়ার বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের কর্মকা-ের উপরই নির্ভর করে থাকে। ইচ্ছে করলেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছাড়াও নগর স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে পরোক্ষভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটাতে হলে এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, রাজধানী সচল রাখার অন্যতম কাজ হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ থেকে পিছিয়ে থাকার উপায় নেই। কারণ বর্জ্য পচনশীল, দুর্গন্ধময়, রোগ-জীবাণু সংবলিত, আবার রোগজীবাণু জন্মও দেয়। রাজধানীকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে সিটি কর্পোরেশন যত তৎপর হবে, জনগণকে সচেতন করতে উদ্যোগ নেবে তাতেই ভাল ফল বয়ে আনবে। রাজধানীতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ হলেই শিশুরা বড় হবে উন্নত চিন্তাচেতনায়, সমৃদ্ধ হবে তাদের জীবন ও বেড়ে উঠবে সুস্থ সবলভাবে। হাসপাতাল বর্জ্যরে পর ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য হচ্ছে মলমূত্র। মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর মলমূত্র। মলমূত্র পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যে কারণে তাকে খোলা জায়গায় থাকতে দিতে নেই। দিলে মশা-মাছি রোগ-জীবাণু ছড়াবে। তাই নগরীর সবার জন্য নিরাপদ পায়খানা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা একান্ত কর্তব্য। এটা বস্তিবাসী বা ভাসমান লোকদের জন্য যেমন দরকার, বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের জন্যও দরকার। এই কাজটিকে অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নেই। লক্ষ্য করা যায়, এখনও শহরাঞ্চলের বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও ফুটপাথে যত্রতত্র মানুষ মল ত্যাগ করে। ফলে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ অন্যান্য রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। আর মলমূত্র ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি বাড়িতে সেপটিক ট্যাঙ্ক, সোকওয়েল স্থাপন জরুরী বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, স্বাস্থ্যসেবার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত না হওয়ায় পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আবাসিক এলাকা, শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে একাকার। পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। নগরমুখী মানুষের সংখ্যা চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে । অপ্রতুল জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে নগরবাসী। চারদিকের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ খন্দকার মোঃ সিফায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, নগর স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। হাসপাতালভিত্তিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের অধীনে নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। ওই সব কেন্দ্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। অনেকে না বুঝে নগরীর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় বলে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের শহর-নগরগুলোতেও জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। শহরের বস্তি এলাকায় গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অভিবাসন সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তারে প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা নিরসনে সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে শহর-নগরগুলোতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব প্রচেষ্টার তেমন কোন অর্থবহ ফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নগর জনসংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। ফলে পুরো জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। নগরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ করে হতদরিদ্র, বস্তিবাসী ও ভ্রাম্যমান জনগণ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এসব সমস্যার আশু সমাধানের জন্য বর্তমান সরকার সকলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
×