ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কমলাপুর স্টেশন ঘিরেই জীবন কাটে ওদের

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

কমলাপুর স্টেশন ঘিরেই জীবন কাটে ওদের

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ কমলাপুর। নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটি রেলওয়ে স্টেশনের দৃশ্য। মূলত স্টেশনটার নাম-ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন। এখান থেকেই শুরু হয় সারাদেশে যাত্রা আর সারাদেশ থেকে এই স্টেশন হয়ে রাজধানীতে আসেন অনেকে। আসা-যাওয়ার এই স্থানটি ঘিরেই চলে অনেকের জীবন-জীবিকা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে মুখরিত এই স্টেশন। যারা ঢাকা থেকে দেশের কোন গন্তব্যে যেতে চান তারা টিকেট কাটেন এবং ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় থাকেন। আর যারা দেশের কোন স্থান থেকে রাজধানীতে আসেন তারা ট্রেন থেকে নামার পর হয়ে ওঠেন ব্যতিব্যস্ত। দীর্ঘক্ষণ ট্রেন ভ্রমণের পর থাকে গন্তব্যে পৌঁছার তাড়া। তবে কিছু মানুষ আছেন, যারা না যান দেশের কোন স্থানে, না যান অন্য গন্তব্যে। কারণ, এই স্টেশনই তাদের গন্তব্য। জীবন-জীবিকার জন্য সারাদিনই পড়ে থাকেন এই স্টেশনে। এখানে বসেই মেলান জীবনের সব হিসাবনিকাশ। বুধবার বেলা বারোটার দিকে দেখা যায়, ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কাটা এক শারীরিক প্রতিবন্ধী বসে আছেন তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের রেললাইনে। তার চোখেমুখে নিদারুণ কষ্ট আর অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট। নাম রাব্বি। তিনি ছিলেন এই স্টেশনের হকার। আর ভাগ্যের খেলায় তিনি আজ ভিক্ষুক। রাব্বি জানান, তার বাড়ি নরসিংদী জেলার খাউরিয়াপাড়া গ্রামে। বাবা নেই। মা রেখা বেগম গার্মেন্টসে কাজ করেন। চার ভাইবোন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সংসারে এখন মা আর ছোট ভাই। তারা নরসিংদীতেই থাকেন। কমলাপুরে একাই থাকেন রাব্বি। তিনি জানান, নয় বছর আগে থেকে এই কমলাপুর স্টেশন তার বাড়িঘরে পরিণত হয়। তখন তিনি হকারি করতেন। ট্রেনে পানি বিক্রি করতেন। রাতে ঘুমাতেন প্ল্যাটফর্মের বাইরে। যা আয় হতো তা দিয়ে নিজে চলতেন এবং মায়ের জন্যও কিছু টাকা পাঠাতেন। বিপত্তি ঘটল সাত বছর আগের কোন একদিন! হকারি করার সময় নরসিংদীর আড়িখোলায় চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে যান। পায়ে গুরুতর আঘাত পান। ভর্তি করা হয় রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। এরপর হাঁটুর নিচের অংশ কেটে ফেলা হয়। এখন সেই কাটা পা নিয়েই তিনি ভিক্ষা করেন। যা পান তা দিয়ে নিজে চলেন এবং মায়ের জন্য পাঠান। শুধু রাব্বি নয়; অনেক মানুষের জীবনজীবিকা নির্ভর করে এই স্টেশনের ওপর। কেউ পানি বিক্রি করেন, কেউ ঝালমুড়ি, কেউ জুস, কেউ বিড়ি-সিগারেট-পান, কেউ পত্রিকা, কেউ মানচিত্র বিক্রি করে উপার্জন করেন। কেউ বসে থাকেন ট্রলি নিয়ে কখন আসবে ট্রেন। ট্রেন এলেই বেড়ে যায় ব্যস্ততা। কিছুক্ষণ পর পর কোথাও না কোথাও থেকে ট্রেন এসে পৌঁছায় আবার ছেড়ে যায়। এই স্টেশনের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের পরিবারপরিজনও অপেক্ষায় থাকে কখন তাদের অভিভাবক টাকা পাঠাবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাকার বিনিময়ে যাত্রীদের মালামাল আনানেয়ার জন্য সাড়ে তিন শ’ শ্রমিক (কুলি) রয়েছে। এরা দেশের কোন না কোন জেলা থেকে জীবিকার জন্য এসেছেন। কাদের নামের এক শ্রমিক (কুলি) জানান, তার বাড়ি নওগাঁ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই স্টেশনে কাজ করছেন। ট্রেন এলেই ট্রলি নিয়ে ট্রেনের কাছে চলে যান। এর পর দরদাম ঠিক করে মালামাল প্ল্যাটফর্মের বাইরে পৌঁছে দিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে মালামালের ওপর দরদাম নির্ভর করে। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে প্ল্যাটফর্মে আসে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। ওই ট্রেনের দুই-এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তারা জানান, এখন শুধু বাসায় ফেরার তাড়া। এখন আর কথা বলার সময় নেই। তবে অলস সময় পার করেন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য স্টেশনে অপেক্ষারতরা। দীর্ঘক্ষণ প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় থাকা সালমান আহম্মেদ জানান, তিনি এগারোটা থেকে অপেক্ষা করছেন। যাবেন নরসিংদী। বেলা একটায় চট্টগ্রামগামী চট্টলা এক্সপ্রেস ছাড়বে। সেই ট্রেনে তিনি যাবেন। তিনি বলেন, আমি বেশিরভাগ সময় ট্রেনে যাতায়াত করি। কারণ, ট্রেন যাত্রা সহজ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ। সড়কপথে যেমন দুর্ঘটনা ঝুঁকি বেশি থাকে ট্রেনে তেমন বেশি ঝুঁকি থাকে না। সালমানের সঙ্গে কথা বলার সময় মানচিত্র নিয়ে আসেন এক বৃদ্ধা। দেশের মানচিত্র, বিশ্বের মানচিত্র। এর পর দেখা মিলল এক তরুণীর। তিনিও মানচিত্র বিক্রি করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর পত্রিকা বিক্রির জন্য আসেন আরও দুই তরুণী। এরা চলে যাওয়ার পর সালমান বলেন, জীবনের জন্য জীবিকা আর জীবিকার জন্য জীবন; দুটোই কারও না কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ঠিক এ সময় দেখা যায়, অপেক্ষারত এক নারীর মোবাইল নিয়ে দৌড় দেয় মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। অবশ্য বেশিদূর যেতে পারেননি। পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হয়েছে। কত নানান ঘটনাই না ঘটে এই স্টেশনে। এখানে ভালমন্দ সব ধরনের মানুষেরই আনাগোনা।
×