ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জনজীবন বিপর্যস্ত ঘন কুয়াশায় যান চলাচল, ফেরি পারাপার ব্যাহত এ মাসে আরও শৈত্যপ্রবাহ

শীতে কাঁপছে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

শীতে কাঁপছে দেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শীতে কাঁপছে সারাদেশ। অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীতের তীব্রতা বাড়ার পাশাপাশি ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চল। এতে যান চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। হিমেল হওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তবে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শুক্রবার আগের দিনের চেয়ে তাপমাত্রা একটু বেড়েছে। কিন্তু শীতের তীব্রতা কমেনি এতটুকুও। এদিনে দেশের সর্ব নিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৭.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এদিকে ঘন কুয়শার কারণে ফেরি পারাপার এবং বিমান ওঠানামাও ব্যাহত হয়। আবহাওয়া অধিফতর জানিয়েছে, দুদিনের উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের কারণে মেঘ কেটে গেছে। ফলে শীতল বায়ু দেশের অভ্যন্তরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তাই হঠাৎ করে শীত বেড়ে গেছে। এই অবস্থা আরও কয়েকদিন থাকতে পারে। তারা আরও জানায়, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমী লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়ার আভাস দেয়া হয়েছে। তা দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে জানানো হয়েছে, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, শ্রীমঙ্গল ও বরিশাল অঞ্চলসহ রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগসমূহের ওপর দিয়ে হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ বইলেও এই মাসে আরও একাধিক শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। আবহাওয়াবিদরা উল্লেখ করেন, শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭.২ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে এসেছে। সাধারণত মাঝারি মানের শৈত্যপ্রবাহে তাপমাত্রা এই পর্যায়ে নেমে আসে। তবে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে শৈত্যপ্রবাহ তীব্র আকার ধারণ করবে। এদিকে অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহের কারণে উত্তরের পাশাপাশি সারাদেশে শীতের তীব্রতা অনেক বেড়েছে। স্থানীয় জনসাধারণ বলছেন শীত নয়, বরফ পড়ছে। গরম কাপড়েও শীত মানছে না। তীব্র শীতের কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছে না বেশিরভাগ মানুষ। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলো বেশি বিপদে পড়েছে। শ্রম দিয়ে যাদের জীবন চলে তাও যেন স্থবির করে দিয়েছে শীত। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা দেখা গেছে অনেকের। কনকনে শীতে জবুথবু হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষসহ প্রাণিকুলও। দেশের অনেক এলাকায় সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। কুয়াশায় ঢেকে আছে রাজপথ। যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। এবারের শীতের প্রকোপ এতই বেশি যে খোদ রাজধানীবাসীও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অফিস-আদালতের জরুরী তাড়া ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। সন্ধ্যা হলেও রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার রাজধানীতে সকাল থেকে রোদের দেখা মিললেও তাতে উত্তাপ যেন একটু কমই ছিল। সকাল এবং সন্ধ্যায় শীত যেন ঘিরে ধরছে। ফলে সন্ধ্যা হলেও ঘরে ফেরার তাড়া বাড়ছে মানুষের। শিশু এবং বৃদ্ধরা পড়েছে সব চেয়ে বেশি বিপদে। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে তারা। এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে যান চলাচল যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি বিমান ওঠানামাও বন্ধ রাখতে হয়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে শুক্রবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টা সব আন্তর্জাতিক বিমান ওঠানামা বন্ধ ছিল বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তারা জানায়, ঘন কুয়াশার কারণে বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৪৫ মিনিট থেকে শুক্রবার সকাল ১০টা ১১ মিনিট পর্যন্ত বিমান ওঠানামা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ সময় শারজাহ থেকে এয়ার এরাবিয়ার দুটি এবং বাংলাদেশ বিমানের একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কলকাতায় পাঠানো হয়। এছাড়া দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি এবং কুয়ালালামপুর থেকে আসা ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইট চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। তারা জানান অবস্থা একটু ভাল হলে সকাল ১০টা ১১ মিনিটে অভ্যন্তরীণ এবং ১০টা ৩৫ মিনিটে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়। বিমান চলাচল বাতিল করায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট কলকাতা ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট ব্যাঙ্কক যেতে দেরি হয়। ঘন কুয়াশার কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ছাড়াও নভোএয়ারের চারটি, ইউএস বাংলার তিনটি, বাংলাদেশ বিমানের দুটি ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বিলম্বে ছেড়েছে এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া ফেরি চলাচল ব্যাহত হয়। ভোর ৬টা থেকেই ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া মাঝ পদ্মায় আটকে পড়ে ৫টি ফেরি। তীব্র শীতে ফেরিতে আটকে থাকা যাত্রীরা পড়ে চরম দুর্ভোগে। ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ঘাট এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র শীতে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। তবে সারাদেশ শীতে কাঁপলেও আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবারের চেয়ে শুক্রবার দেশের অনেক স্থানে আগের চেয়ে তাপমাত্রা বেড়েছে। কিন্তু শীতের তীব্রতা আগের মতো রয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন ৫.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেখানে শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৭. ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এছাড়া শুক্রবার ঢাকায় তাপমাত্রা বেড়েছে। আগের দিন ঢাকায় তাপমাত্রা ১০.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। শুক্রবার ঢাকায় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রা এক লাফে ৮ থেকে ১০ ডিগ্রী পর্যন্ত কমে গেছে। এ কারণে হঠাৎ করেই শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। এর আগে শীত আছে তো শীত নেই অবস্থা বিরাজ করছিল। আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, সাধারণত কয়েকটি কারণে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে তাপমাত্রা কমে যায়। গত দুই দিনে উপমহাদেশীয় উচ্চ চাপবলয়ের কারণে মেঘ কেটে গেছে। ফলে শীতল বায়ু দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তাই হঠাৎ শীত বেড়ে গেছে। আগামী দু-এক দিন এ শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে যশোর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে যশোরের জনজীবন। গত দুদিন ধরে কনকনে শীতে জবুথবু হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষসহ প্রাণিকুল। সূর্যের দেখা মিললেও ঠান্ড বাতাসে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শুক্রবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যশোরে। এদিন এ জেলায় ৭ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যশোরসহ খুলনাঞ্চলে দুদিন আগে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়। কমতে শুরু করে তাপমাত্রা। যশোর আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, শুক্রবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করছিল যশোরে। এদিন যশোরে সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এ তাপমাত্রার সঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় এবং বাতাসের কারণে শীত অনুভূতও হচ্ছে খুব বেশি। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, খুলনা বিভাগজুড়ে এখন হাল্কা থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলেছে। শুক্রবার ভোরও ছিল কুয়াশায় ঘেরা। সকালে কুয়াশা ভেদ করে ওঠে সূর্য। ক্ষীণ আলো কুয়াশাকে ভেদ করে মাটি ছুঁয়ে নিলেও গায়ে উষ্ণতা জাগাতে পারেনি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা সরে যায়। রোদের দেখা দেয়। কিন্তু তাতে ছিল না তেজ। ফলে মানুষজনের স্বাভাবিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয়। মোটা জ্যাকেট, মাফলারে ঢেকে মানুষজনকে জবুথবু হয়ে পথ চলতে দেখা যায়। হাড় কাঁপানো শীতে ঘর থেকে বের হননি অনেকে। খুব সকালে ক্ষেতে প্রতিদিনের মতো চাষীদের দেখা মেলেনি। বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোকে। প্রতিদিন শহরের লালদীঘির পাড়ে শ্রমিক জনগোষ্ঠীর বহর বসলেও, কাল তা ছিল কম। বিকেলের দিকেও শীতের প্রকোপ দেখা দেয়। রোদ পড়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হয় অসহ্য শীতের কাঁপুনি। রাস্তায় রিক্সা, অটোরিক্সা কম থাকায় অফিস থেকে ঘরে ফেরা মানুষগুলোর অনেককেই ধীর পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে দেখা যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়ে শীতের তীব্রতা। শহরের রেলস্টেশন, বাসটার্মিনাল, অফিস-আদালতের বারান্দায় রাত কাটানো মানুষগুলো জবুথবু পড়ে থাকতে দেখা যায়। শীতের ‘জাঁতাকলে’ এসব মানুষ এখন তাকিয়ে আছেন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও প্রশাসনের দিকে। প্রতিবারের মতো হয়ত সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় তাদের গায়ে চড়বে গরম কাপড়, কম্বল। নিজস্ব সংবাদদাতা নওগাঁ থেকে জানান, মৃদু শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন কাহিল হয়ে পড়েছে। কনকনে ঠান্ড বাতাসের দাপটে জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। অনেকেই প্রচ- শীতের কারণে ঘরের বাইরে কাজে যেতে পারছে না। বাড়ির বাইরে রাস্তায় বা খলিয়ানে মানুষ খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শরীর তাপাতে চোখে পড়ে। এই কনকনে ঠান্ড বাতাসের সঙ্গে ঘন কুয়াশাও চারদিকে আচ্ছন্ন করে আছে। গত ৩/৪ দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে বিকেলে। টানা শৈত্যপ্রবাহ আর কনকনে শীতে আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা সড়কে যানবাহন চলাচল করতে দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। শিশু-বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা মাগুরা থেকে জানান, শৈত্যপ্রবাহে তৃতীয় দিনের মতো জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুক্রবার শীতের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকছে। ফলে যানবাহন চলাচলে মারত্মক ব্যাঘাত হচ্ছে। শিশু ও বৃদ্ধরা নিউমোনিয়া, জ¦র ও কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে শিশু রোগীদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১০ বেডের মাগুরা সদর আধুনিক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শতাধিক শিশুরোগী ভর্তি রয়েছে। বোরো বীজতলা ও বোরো চাষে ব্যাঘাত ঘটছে। শীতের কারণে কৃষক ও শ্রমিকরা সকালে জমিতে প্যাক দিতে পানিতে নামতে পারছেন না।
×