ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকারভোগীর সংখ্যা ৫১ লাখ

স্থায়ী দারিদ্র্য বিমোচনের টেকসই মডেল ॥ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

স্থায়ী দারিদ্র্য বিমোচনের টেকসই মডেল ॥ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প

ফিরোজ মান্না ॥ ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ সরকারের একটি সফল প্রকল্প। ৪৯০ উপজেলায় ৩০ লাখ মানুষ এই প্রকল্পে সরাসরি উপকার ভোগ করছেন। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকল্পে উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫১ লাখ। দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধিসহ দারিদ্র্যমুক্তি ঘটছে। দরিদ্র পরিবারের মানব ও স্থানীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাও সম্ভব হয়েছে। সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি শুরুতে সমালোচনার মুখে পড়লেও এখন এর সুফল ঘরে উঠছে। এখন দেশের প্রতিটি উপজেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রকল্পটির আলো ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশে ১৭ হাজার ৩শ’ গ্রাম সমিতি গঠন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি উপজেলার গ্রামকে প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকারমূলক জীবিকাভিত্তিক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন-প্রসূত একটি উদ্যোগ। এটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব তহবিল, জীবিকা এবং স্থায়ী দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করার একটি প্রয়াস। সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য স্থায়ী দারিদ্র্য বিমোচনের টেকসই একটি মডেল। গত ৮ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৭) একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পভুক্ত হয়েছে দেশের ৩০ লাখ দরিদ্র মানুষ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বহু মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত জীবনযাপন করছেন। তাদের জীবনযাত্রার মানে উন্নয়ন ঘটেছে। দারিদ্র্যের দুষ্টু চক্র থেকে তারা বের হয়ে এসেছেন। দেশ ২০২০ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পভুক্ত সদস্যদের টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে উন্নততর জীবনমান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকল্প কার্যক্রম পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। আরও বেশিসংখক মানুষের কর্মসৃজনসহ জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। গ্রাম পর্যায়ে এখন এই জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে উদ্যোক্তা গড়ে উঠছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আকবর হোসেন বলেন, প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন প্রসূত। এটি সরকারের শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অন্তর্নিহিত যে চিন্তা ও চেতনা রয়েছে তা জনগণ ইতোমধ্যে আগ্রহ ও প্রশংসার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’ নামক ঋণের অত্যাচার ও অভিশাপ থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে। গ্রামীণ জনপদে অধিকসংখ্যক উপকারভোগীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হবে এক নতুন বিপ্লব। প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রকল্পটি আরও সফলতা লাভ করতে পারত যদি স্থানীয় পর্যায়ে যেসব কমিটি রয়েছে এবং কমিটিগুলো সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করত। মাঠ, পর্যায়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে সব শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিনিধি সদস্য রয়েছেন। সূত্র জানিয়েছে, শুরুতে প্রকল্পটি ছিল মূলত একটি বাড়িকে ঘিরে একটি খামার করে কোন দরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তৈালা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হওয়ার পর বিভিন্নস্থান থেকে প্রকল্পে সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ওই ধারণা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে গ্রামভিত্তিক সমিতি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। এতেই দেখা মেলে সফলতার। ২০১০ সালের জুন থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পে গ্রাম সমিতি গঠন করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩ শ’ টি। যাতে উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা ১০ লাখ ৩৮ হাজার। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকল্পে উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫১ লাখ। সমিতির প্রতিটিতে সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০ জন ও সর্বনি¤œ ৪০ জন। প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, সমিতিগুলোতে সদস্যরা নিজেরা যে সঞ্চয় করেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ঠিক সমপরিমাণ অর্থ সমিতিগুলোতে জমা দিয়ে তহবিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকার ঘূর্ণায়মান ঋণ হিসেবে সমপরিমাণ টাকা দিয়েছে প্রতিটি সমিতিকে। এই হিসাবে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে’র আওতায় সমিতিগুলোতে এখন পর্যন্ত সঞ্চয় জমা হয়েছে ৩৫৫ কোটি টাকা। আবার সরকারের পক্ষ থেকে আরও ৩৫৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে সমিতিগুলোকে। আর ঘূর্ণায়মান ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে ৪৯০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষের মোট তহবিলের পরিমাণ এক হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। গ্রামে গ্রামে জীবিকাভিত্তিক ক্ষুদ্র খামার গড়ে উঠেছে ছয় লাখ ৮০ হাজারটি। প্রকল্পের আওতায় এক বছরে দরিদ্র পরিবারপ্রতি আয় বেড়েছে ১০ হাজার ৯২১ টাকা করে। এই হিসাব ২০১৬ সালে প্রকল্প এলাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারের সংখ্যা ১৫ শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য হ্রাসের পাশাপাশি অধিক আয়ের পরিবারের সংখ্যা আগের চেয়ে ২২ দশমিক আট শতাংশ থেকে ৩১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭ সালের হিসেব আরও কয়েক দিন পরে পাওয়া যাবে। প্রকল্পের পরিচালক আকবর বলেন, যে উদ্দেশে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল তাতে শতভাগ সাফল্য এসেছে। প্রথম দিকে মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতায় পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে প্রকল্পের ভবিষ্যত নিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মনে নানা প্রশ্ন ছিল। এখন আর এ প্রশ্ন নেই। বরং এই প্রকল্পের মাধ্যমে দিন দিন উপকার ভোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। মানুষগুলো দারুণ খুশি। সূত্র জানিয়েছে, আগে একটি পরিবারকে অর্থায়ন করে স্বাবলম্বী করার পরিকল্পনা নিয়ে কর্মসূচী গ্রহণ করা হলেও, দুর্নীতি-অনিয়ম এড়াতে এখন সেটি সামষ্টিকভাবে অর্থাৎ সমিতির মাধ্যমে করা হচ্ছে। ৬০ সদস্যের সমিতি থেকে কয়েকজনকে নিয়ে গ্রুপ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপ নিজেদের সুবিধা বা পছন্দ অনুযায়ী এবং যে এলাকায় যে ধরনের জীবিকা গ্রহণ করা সম্ভব সেটা করতে পারেন। এক্ষেত্রে হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, দুগ্ধ উৎপাদন, মৌমাছি পালন, শস্য উৎপাদন, বনায়ন, উদ্যান সৃজনসহ নানা ক্ষুদ্রশিল্প। দ্বিতীয় পর্যায়ে জুলাই-২০১৩ থেকে জুন ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৪০ হাজার ৫২৭টি গ্রাম সমিতি গঠন করা হয়েছে। এ হিসেবে এখন নতুন সমিতি গঠনের লক্ষ্য হচ্ছে ২৩ হাজার ২২৭টি। এখন ২৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৪০টি পরিবারকে প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার হয়েছে। যাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকারভোগীর সংখ্যা হবে এক কোটি ২১ লাখ। চলতি বছরে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭০০ ব্যক্তিকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পল্লী ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মানুষকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে ও লেনদেন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার একটি ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ গঠন করেছে। বর্তমানে ৩ শ’ উপজেলায় এই ব্যাংকের কার্যক্রম চলছে। চলতি বছরের মধ্যে ৪৯০ টি উপজেলায় ব্যাংকের শাখা স্থাপন করা হবে। ব্যাংক পরিচালনার জন্য ‘ইরা ইনফো টেক লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি চুক্তি করা হয়েছে। তারা আর্থিক লেনদেন নিরাপদ রাখতে ব্যাংকের সফটওয়্যার দেবে। আগামী মাসে এর উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ৪৮৫ টি শাখার লাইসেন্স দিয়েছে। লাইসেন্স প্রাপ্ত অনেক শাখাই এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে ৩ শ’টি শাখায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কাজ হচ্ছে।
×