ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফেলনা নয় কচুরিপানা

জৈব সার কাগজ ও আসবাবপত্রের উপকরণ

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

জৈব সার কাগজ ও আসবাবপত্রের উপকরণ

সমুদ্র হক আগে যা ছিল নৌপথের প্রতিবন্ধকতা এবং ভয়, তাই এখন জৈব জ্বালানি, জৈব সারসহ কাগজ ও আধুনিক আসবাবপত্রের বড় উপকরণ। গত শতকের প্রথম ভাগে জলাশয়ের এই উদ্ভিদ (যাকে জলজ আগাছাও বলা হয়) নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মাথা ব্যাথার অন্ত ছিল না। নির্বাচনী ইশতেহারে এবং পরবর্তী সময়ে আইনপাশ করে এই জলজ উদ্ভিদ উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছিল। একবিংশ শতকে এই জলজ উদ্ভিদ দেশে দেশে উন্নয়নের অন্যতম অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও এই যাত্রায় পিছিয়ে নেই। এগিয়ে চলেছে। জলজ এই উদ্ভিদের নাম কচুরিপানা। এমন কেউ নেই যে কচুরিপানা চেনে না বা দেখেনি। কচুরিপানা বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনাআপনি জন্মে। যে কোন জলাশয়ই কচুরিপানার উর্বর ক্ষেত্র। উদ্ভিদতত্ত্ববিদ মাসুদুর রহমান জানান, কচুরিপানার জাত আছে সাতটি। খালি চোখে সব জাতের ধরণ একই মনে হবে। পার্থক্য অতি সূক্ষ্ম। কচুরিপানার উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে ব্রাজিলিয়ানরা প্রথমে কচুরিপানার পরিচিতি ঘটায়। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রাজিলিয়ান কোন পর্যটক ১৮ শ’ সালের দিকে ভারত উপমহাদেশে এসে কচুরিপানা দেখে তার আদ্যপান্ত তুলে ধরেন। কচুরিপানা একসময় জলাশয়ের কর্মকা-ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। লোকজন এই জলজ উদ্ভিদকে ক্ষতিকর বলতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা নিধন আইন পাশ করে। ব্রিটিশরা জেলা কালেক্টরদের কচুরিপানা নিধনের নির্দেশ দেয়। বাড়ির আশপাশে জলাশয়, পুকুরে, বিলে ও নদীতে কচুরিপানা নিধন অভিযান চলে। ১৯৩৭ সালে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে কে কতভাবে কচুরিপানা নিধন করতে পারবে তার ফিরিস্তি তুলে ধরে। রাতে কচুরিপানায় আলোর ঝলকানি দেখে বলাবলি হতো ‘ভূত’ আছে। কচুরিপানায় আর ভূত নেই। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, ট্রপিক্যাল এই জলজ উদ্ভিদে মিথেন গ্যাসের সৃষ্টি হয় এবং সেখান থেকেই কথিত ভূতের আলোর উৎপত্তি। কচুরিপানার বিজ্ঞান নাম ‘ইকরোনিয়া ক্রাসিপিস’। ইংরেজিতে বলা হয় হায়াসিন্থ। জলজ এই উদ্ভিদ ভাসমান। পানির ভেতরে পালকের মতো থাকে। প্রতিটি পাতা এক মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। পাতা সবুজ রঙের স্পঞ্জের মতো। প্রতিটি ফুলে থাকে ১ শ’টি করে বীজ। শক্তিশালী এই বীজ জলাশয়ে ৩০ বছর পর্যন্ত জীবন্ত থাকে। সকালে যে জলাশয়ের কচুরিপানার বিস্তার শুরু দু’ দিনের মধ্যে তা ভরে যায়। সহজে উপড়ানো যাবে না। এর শিকড় ঝুলানো। যা সহজে বের করা যায় না। কচুরিপানা জীববৈচিত্রের বড় একটি অংশ হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কচুরিপানা শুধু জৈব সারই নয় এর জৈব জ্বালানি ক্ষমতা অনেক বেশি। কম্পোজিট সার হিসেবে ব্যবহার করলে বাড়তি ফলন মেলে। রাসায়নিক সারের কোন প্রয়োজন পড়ে না। আগে কৃষক গোবর সার যেভাবে সংরক্ষণ করে জমিতে প্রয়োগ করতেন কচুরিপানাও তুলে এনে সেভাবে একটা জায়গায় মাটি খুঁড়ে সংরক্ষণ করে প্রয়োজনমতো জমিতে প্রয়োগ করা যায়। যা জৈব সারের চাহিদা পূরণ করে। কৃষি বিভাগ কচুরিপানার জৈব সার প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে। এই সারে মাটির উর্বরতা বেড়ে যায় দ্রুত। ফসলের ফলন বাড়ে। কচুরিপানার জৈব জ্বালানি শক্তি অনেক। বর্তমানে গোবর দিয়ে যে বায়োগ্যাস তৈরি হচ্ছে তা কচুরিপানা দিয়েও সম্ভব। গোবর সংরক্ষণের মতোই কচুরিপানা সংরক্ষণ করে বায়োগ্যাস তৈরি করা যায়। এই গ্যাসের প্রজ্জ্বলন ক্ষমতা বেশি। পরীক্ষা করে দেখা গেছে কাগজের কাঁচামাল কচুরিপানা। বিশ্বের দেশে দেশে আধুনিক আসবাবপত্রের উপকরণ হিসেবেও কচুরিপানার ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ডে কাঠের আসবাবপত্রের বদলে কচুরিপানার ম- বানিয়ে রিসাইকেল করে আসবাবপত্র তৈরি হচ্ছে। কেউ কি কখনও ভেবেছে, জলজ আগাছা কচুরিপানা একবিংশ শতকে এসে তার প্রকৃত অবস্থান মেলে ধরবে! বাংলাদেশে কচুরিপানা নিয়ে এখনও জোরেশোরে কাজ শুরু হয়নি। প্রকৃতি জলাশয়ে কচুরিপানার ফুল ফুটিয়ে আহ্বান জানায়, কচুরিপানার শক্তিকে কাজে লাগাপনোর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। যত দ্রুত কচুরিপানাকে কাজে লাগানো যাবে জ্বালানি ও কৃষি ভূমি ততই শক্তিশালী হবে। কচুরিপানা খুলে দিয়েছে সৃষ্টির নতুন দুয়ার।
×