ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রদীপ মালাকার

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের পরিণতির জন্য দায়ী কে?

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের পরিণতির জন্য দায়ী কে?

কিছুদিন পূর্বে আমার এক শিক্ষক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় নিউইয়র্ক সিটির ব্রঙ্কসের এক ম্যাকডোনাল্ডসে। আমরা দু’জনই এক সঙ্গে দীর্ঘদিন জন এফ কেনেডি হাই স্কুলে আমি গণিত শিক্ষক ও মি. ফিলিপ ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে কাজ করি। মি. ফিলিপের পিতা ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে মি. ফিলিপ ছোটবেলায় পিতার সঙ্গে অনেকবার ঢাকায় আসা-যাওয়া করেছে। বলতে গেলে তখন থেকেই ফিলিপ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহি ছিল। স্কুলে যখনই সময় পেতেন তখনই আমার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন। আজও দেখা হতেই কুশল বিনিময়ের পর নিউইয়র্ক সিটির টাইম স্কয়ারে আত্মঘাতী হামলাকারী জঙ্গী বাংলাদেশী তরুণের নিরীহ মানুষের ওপর হামলা এবং গত বছর হোলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় ১৭ জন বিদেশীসহ ২১ জনকে হত্যার জঙ্গী হামলার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ২৭ বছরের আকায়েদ উল্লাহর বিরুদ্ধে তদন্তকারীরা ম্যানহাটনের ফেডারেল কোর্টে বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তা, জনসমাগম স্থলে বোমা হামলা, ধ্বংসাত্মক ডিভাইস ও বিস্ফোরক ব্যবহার করে জনপদের ক্ষতির অভিযোগসহ হামলার কিছুক্ষণ আগে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে (উড়হধষফং ঞৎঁসঢ়) হুঁশিয়ারি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হবে। অন্যদিকে যুুক্তরাজ্যে নাইমুর জাকারিয়া রহমান (২০) ও মোহাম্মদ আকীব রহমান (২১) নামের দুই যুবককে লন্ডনের মেট্রো পুলিশ গ্রেফতার করে। ২০ বছর বয়সী বাংলাদেশী-ব্রিটিশ নাগরিক নাইমুরের বিরুদ্ধে ঘরে বসে তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগে বিস্ফোরক বেল্ট ও ছুরি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি অভিযোগ আনা ছাড়া ও পাকিস্তানী আকিবকে লিবিয়ায় আইএস যাওয়ার সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদেরও একই শাস্তি হতে পারে। মি. ফিলিপ বলেন, দেখুন গত বছের ২১ জুলাই ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বোস্টনে ২৬ বছরের যুবক রেজাউল ফেরদৌস পেন্টাগনে হামলার ষড়যন্ত্রে ১৭ বছরের জেল হয়। একই বছরের অক্টোবরে আরেক বাংলাদেশী কাজী নাফিস নামে ২১ বছরের যুবক নিউইয়র্ক সিটির ফেডারেল রিজার্ভ বিল্ডিংয়ে হামলার ষড়যন্ত্রে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তারও সাজা হয়। এতে আপনাদের দেশের দুর্নাম হয়। তিনি আরও বলেন, জঙ্গী হামলা গুলিতে প্রায়ই নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তারা কেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ল? বর্তমান সরকার তো গণতান্ত্রিক ও স্যেকুলার। এগুলো তো হওয়ার কথা নয়। বলুন তো আসলে আপনাদের দেশে কি হচ্ছে? আমি বললাম, যে গোষ্ঠীর মানুষেরা জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে চাঁদে দেখা গিয়েছে বলে বিশ্বাস করে তাণ্ডব চালায় এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সত্য মিথ্যা যাচাই না করে অন্যের উপাসনালয়ে আগুন দেয়, বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট চালায় সেই সমাজে আকায়েদ, নাইমুর গংয়ের জন্ম হবে না তো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আইনস্টাইনের জন্ম হবে? দেখুন, এক সময় আপনাদের সরকারই এই জামায়াতে ইসলামীকে মডারেট ডেমোক্র্যাট এবং বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম কান্ট্রি হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছিল। অথচ এই সার্টিফিকেট পেয়ে তারা নতুন উদ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তাদের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় ইসলামী হুকমত কায়েম বা তালেবানী রাষ্ট্র কায়েমে এগিয়ে যায়। জোট শাসনামলে বাংলা ভাই, আব্দুর রহমানের জেএমবিসহ অসংখ্য সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠনের আবির্ভাব হয়েছে জামায়াতের তত্ত্বাবধানে। পরে অবশ্য মার্কিন সরকার জামায়াত সম্পর্কে ধারণা পাল্টায়। আমি মি. ফিলিপকে আরও বলি, দেখুন আপনি যে বাংলাদেশী যুবকদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন, পাশাপাশি দেখুন তো গত ১ মে ২০১০ সালে বাংলাদেশী-আমেরিকান আরেক যুবক ‘মানব ক্যামেরা’ সেজে ৩৩ বছর বয়সী ফয়সল শাহজাদ নামে পাকিস্তানী-আমেরিকান যুবককে টাইম স্কয়ারে বোমা হামলার ষড়যন্ত্রে ধরিয়ে দেয়। মানব ক্যামেরা সাজা যুবকটির বাল্য, কৈশোর তথা এই দেশের (আমেরিকার) লেখাপড়া শিখে বড় হয়েছে। অপর দিকে যুবকদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে এ অঞ্চলের ধর্মান্ধ রাজনীতির চলমান আবহ দ্বারা প্রভাবিত এটাই স্বাভাবিক বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আমি এখানে মি. ফিলিপের সকল প্রশ্ন পাঠকের সুবিধার্থে এক সঙ্গে মিশিয়ে আলোচনা করতে চাই। আজকের লেখায় জামায়াতসহ সমমনা কয়েকটি ধর্মান্ধ রাজনউতিক দলের কয়েক দশকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সামান্য কিছু ফিরিস্তি উপস্থাপন করছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামসহ, আরও দু-একটি দলকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিরোধিতাসহ পাকবাহিনীর সহযোগী হয়ে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের অপরাধে আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সামরিক ফরমান বলে সব দলের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে জামায়াতসহ ধর্মান্ধ দলগুলোকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান করেন। প্রথম থেকেই সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লিগাররা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্যতার পাশাপাশি তাদের দলেও ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়ে। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরে গেলে জামায়াতে ইসলামী নতুন পরিবেশে নব উদ্যমে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ে। সামরিক- বেসামরিক নেতাদের দুর্বলতা ও ক্ষমতার রাজনীতির সুযোগে জামায়াত তার বাংলাদেশবিরোধী তথা তার পূর্বের দর্শন বহাল রেখেই চলতে থাকে। জামায়াতীরা কখনও মনেপ্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। ’৭৫ পরবর্তী শাসনামলে জামায়াত অধ্যুষিত প্রায় স্থানেই মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হতো না। ১৯৭৬ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ইসলামী জলসায় জামায়াত নেতারা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন, পতাকা বদল, বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা এবং দেশের সকল শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার দাবি তুলেছিল। এভাবেই জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ১৯৭৫ এর পর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে ক্রমান্বয়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি মৌলবাদী অর্থনীতি তথা ব্যাংক, বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এ সময়েই ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও শরিয়তী কিংবা হাদিস আন্দোলনে বিশ্বাসী। জামায়াতীরা মুখে গণতন্ত্র, স্বাধীনতার কথা বললেও আসলে তারা আল্লাহ্শাসন ছাড়া অন্য কিছু মানে না। মানলে নির্বাচনের পূর্বে জামায়াতের গঠনতন্ত্রে আল্লাহর শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি আনুগত্যে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় রেজিস্ট্রেশনভুুক্ত হবে না। নির্বাচনের পর জামায়াত আবার পূর্বের গঠনতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার খবরে নির্বাচন কমিশন হুঁশিয়ারি দিয়ে নোটিশ পাঠায় এই বলে যে পূর্বের সংশোধনীতে ফিরে না গেলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে। জামায়াত এভাবেই দীর্ঘদিন ছলচাতুরী ও প্রতারণার রাজনীতি করে আসছে। আর সেই সঙ্গে বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জামায়াত ফুলে-ফেঁপে উঠে ২০০১ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতার পার্টনার বনে যায়। এই সময়েই জামায়াতের ছত্রছায়ায় ও পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার আশীর্বাদে তালেবানী রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে নামে-বেনামে অসংখ্য সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠন গড়ে উঠে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে আকস্মিক ও অসম্ভব দ্রুততায় জঙ্গী নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটেছে। জোট সরকার গত অক্টোবর ২০০৬ সালে বিদায়ের সময় দেশে জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা ছিল ৬১। কিন্তু পরবর্তীতে বেড়ে দাঁড়ায় ১১৭-এ। আমি এখানে কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের নাম উল্লেখ করছি ১. জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি ) ২. হরকত উল ৩. শাহদত-ই-আল হিকমা ৪. আহলে হাদিস আন্দোলন-বাংলাদেশ ৫. জামা’আতুল ফালাইয়া ৬. জইশে মোস্তফা ৭. জাগ্রত মুসলিম জনতাÑবাংলাদেশ (জেএমজেবি) ৮. হিজবুত তাহরির ৯. আল কায়েদা ১০. রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন। এই জঙ্গী সংগঠনগুলোর ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচী থাকলেও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সংগঠনের অনুসারীরা কোরান ও সুন্নাহর আলোকে জীবনধারা পরিচালনার কথা বললেও বাস্তবে তাদের উদ্দেশ্যে ইসলামের ছত্রছায়ায় গোপনে এক শ্রেণীর তরুণ যুবকের জিহাদী তথা সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা। এ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রতিটি মুসলমানের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা ফরজ ও সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী জাতীয় মতবাদে তারা সংগঠনের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করে থাকে। জেএমবি দাবি করে, তাদের ২৫ সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে এ ছাড়া মুফতি হান্নানের ( হরকত উল জিহাদ), হিজবুত তাহ্রীরের ও অনুরূপ সশস্ত্র সদস্যের কথা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারি তথা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে গুলবদরের মুজাহিদ বাহিনীকে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার যুবক যায় আফগানিস্তানে। ৯/১১ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণের ফলে শত শত নারী, শিশু, বৃদ্ধ হত্যার প্রতিশোধে মোল্লা ওমরের সরকার ও ওসামা বিন লাদেনকে সহায়তার জন্য আবারও বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার যুবক আফগানিস্তানে গিয়েছিল যুদ্ধের জন্য। এদের অধিকাংশই সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে এবং তালেবানী ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে দেশে ফিরে অনেকে সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলে। জোট সরকারের পুরো পাঁচ বছরে স্বাধীনতার পক্ষের লেখক, কবি, বুব্ধিজীবী, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বিচারক, আইনজীবী হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে তালেবানী রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে ক্ষমতায় থাকা শক্তির ইশারায় এসব জঙ্গী সংগঠন ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই পাঁচ বছরে আমরা দেখতে পাই, কবি শামসুর রহমানের ওপর হামলা, হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. কিবরিয়া হত্যা, ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় ২৩ জন নিহত এবং গাজীপুরে এজলাসে হামলা চালিয়ে তিন আইনজীবীকে হত্যা, কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে বোমা হামলায় ৭ জন নিহত, ময়মনসিংহ শহরে ৪টি সিনেমা হলে বোমা হামলা, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর হামলা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গোপালগঞ্জের জনসভাস্থলে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখা, সারা জাগানো উদীচীর অনুষ্ঠানে জঙ্গীদের হামলায় ১৭ জন নিহত হয়। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, তাদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে ভাংচুর ও আগুন পুড়িয়ে দেয়া, সম্পত্তি দখলসহ অসংখ্য ঘটনা এই আমলে ঘটে। জঙ্গীরা যে কতটা শক্তিশালী তার প্রমাণ, দেশ বিদেশ সাড়া জাগানো ১৭ আগস্ট ২০০৫ সালে সারা দেশের ৬৩ জেলায় তিন শ’ স্থানে একই সময়ে ৫শ’টি বোমা হামলা চালাতে জঙ্গীদের ব্যবহার করতে হয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলে রাজশাহীর বাগমারা, নওগাঁয়ে সাবেক শিবির ক্যাডার, জাগ্রত মুসলিম জনতা-বাংলাদেশ (জেএমজেবি) এর প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে প্যারালাল শাসন গড়ে উঠেছিল। দেশ ও বিদেশের মানুষ সর্বহারা বা চরমপন্থী শায়েস্তার অজুহাতে ২২ জন প্রগতিশীল কর্মী হত্যা ও লোমহর্ষক নির্যাতনের খবর জেনেছে। এসব ঘটনা সরেজমিন দেখা ও জানার জন্য ঢাকা থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই অঞ্চলে ছুটে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমেনি তার নিয়ন্ত্রণাধীন হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসাগুলোতে কোমলমতি ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে আমেরিকাসহ অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদী ভাবধারা ও বাছাইকৃত মাদ্রাসাগুলোতে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের একাধিক রিপোর্ট দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়। এই আমেনির দল আমরা ঢাকাবাসীসহ ধর্মীয় সংগঠনগুলো ঢাকার বকশীবাজার ও খুলনায় কাদিয়ানীদের মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দেয়ার ঘটনাও পত্রিকার রিপোর্টে পড়েছি। জোট আমলে বোমা ও জঙ্গী হামলায় যে সব জঙ্গী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, তাদের অধিকাংশের জবানবন্দীতে জামায়াতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততার কথা বেরিয়ে আসে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে জামায়াত প্রত্যক্ষ ইন্ধনের কথা জানিয়াছে দৈনিক সংবাদ ২২ আগস্ট ২০০৬-এর রিপোর্টে। শেষ পর্যন্ত জোট সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আমেরিকার চাপে জেএমবি প্রধান শাইখ আব্দুর রহমান ও বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষ নেতাকে আটক ও বিচারের ব্যবস্থা করে। আদালতের রায়ে ছয় শীর্ষ নেতার ফাঁসির আদেশ হলেও জোট সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে ওই ছয় শীর্ষ জঙ্গী নেতার ফাঁসি কার্যকর করে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই জঙ্গী দমনে উঠে পড়ে লাগে। অনেকেই মনে করেছিল, শীর্ষ জঙ্গীদের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে জঙ্গী কর্মকাণ্ড শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তা নয়। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউল হক ও জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য মুফতি জসিমুদ্দিন রাহমানির নেতৃত্বে নব্য জেএমবি ও আনসারউল্লাহ্ টিম নামে দুটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলে। নিষিদ্ধ ঘোষিত এই জঙ্গী সংগঠনগুলো সুকৌশলে স্কলাস্টিকা ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উঠতি বয়সী ছাত্রদের জিহাদী মন্ত্রে ও আত্মঘাতী সদস্য বানাতে অনুপ্রবেশ করে। তারা নব উদ্যমে জঙ্গী তৎপরতা চালায়। এই সময়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠী আইএসের কর্মকাণ্ডে দেশীয় জঙ্গী গোষ্ঠীলো প্রভাবিত হয়। এই সময়েই জঙ্গীরা ভিন্ন মত, লেখক, প্রকাশক, পুরোহিত, যাজক ও বিদেশীদের চাপাতি দ্বারা হত্যর মাধ্যমে গলা কাটার সংস্কৃতি চালু করে। আমেরিকা প্রবাসী লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ, ব্লগার-রাজীব, প্রকাশক-দীপেন, ব্লগার-নিলাদ্রি আরও অনেকে তাদের হাতে খুন হয়। দেশ বিদেশে সবচেয়ে আলোচিত ও নৃশংস জঙ্গী হামলা হয় গত বছরের ১ জুলাই এ হোলি আর্টিজান রেস্তরাঁয়। ওই দিনের হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা, তিন জন আমেরিকা প্রবাসী এবং বাকি ইতালি ও জাপানী নাগরিকসহ ২১ জন জঙ্গীদের হাতে নিহত হয়। এদিন নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে সকল জঙ্গী নিহত হয়। এর পর থেকে সরকার শক্ত অবস্থান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে জঙ্গী ডেরা ধ্বংস ও জঙ্গী নিধন করে চলেছেন। সরকার জঙ্গী দমনে সফল হয়। জঙ্গীদের মেরুদণ্ড বা নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে গেলেও একেবারে সমাজ, রাজনীতি থেকে তারা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। দীর্ঘ ৪২ বছরের জামায়াতসহ অন্য ধর্মান্ধ দলগুলো সমাজের একটি অংশের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িকতা, জিহাদীসহ আমেরিকা বিদ্বেষী মনোভাব গড়ে উঠেছিল তা মহাজোট বা আওয়ামী সরকারের ৯ বছরের গণতান্ত্রিক ও সেমি-সেকুলার শাসনে ধুয়ে মুছে যাওয়ার কথা নয়। কিংবা এই দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে তথা আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশে ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদ ও তাদের অনুসারীরা (আধ্যাত্মিক নেতারা) বিভিন্ন সময়ে দীন ও ইসলামের দাওয়াতের ছদ্মাবরণে যুবকদের বিভ্রান্ত করার অভিযোগও আছে। আমেরিকাসহ যে পশ্চিমা বিশ্ব ওসামা বিন লাদেনকে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস ও নিরাপরাধ সাড়ে তিন হাজার মানুষের হত্যার দায়ে বিশ্ব সন্ত্রাসী হিসেবে জানে, বাংলাদেশের একটি অংশের মানুষ জানে তার উল্টোটা। আজ যে মেধাবী যুবকদের কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে একজন রেজাউল ফেরদৌস ইতোমধ্যে ১৭ বছরের জেল হয়েছে। কাজী রেজাউনুল আহসান নাফিসের বিচারে সাজা হয়েছে। আকায়েদ এবং নাইমুর গংয়ের আদালতের বিচারে সাজা হবে এবং বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হতে পারে। এ ছাড়া গত ২০০৮ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের দুই সহোদর যুবক পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য হয়ে নয়াদিল্লী গিয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে হামলার জন্য। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষীর হাতে আটক হয়। বর্তমানে তাদের বিচারে সাজা হয়ে দিল্লীর বিহার জেলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আমি এসব যুবক সন্ত্রাসী ঘটনায় কতটুকু বা কিভাবে জড়িত এ বিতর্কে না গিয়ে শুধু বলব, এ যুবকরা বা তাদের পরিবার যে স্বপ্ন দেখেছিল আজকে তাদের এই পরিণতির জন্য কে দায়ী? যুবকরা নিজে, পিতা মাতা, সরকার না ধর্মান্ধ রাজনীতি? এমনিতেই ৯/১১এর ঘটনার পর পশ্চিমা বিশ্ব এশিয়ানদের বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে। তারপর বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানী বা আফ্রিকানদের সন্ত্রাসী ঘটনায় নাম এলেও বাংলাদেশের নাম থাকে উজ্জ্বল ভূমিকায়। গত বছর দুই বাংলাদেশী আমেরিকার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি লুটিয়ে পড়ে। আমেরিকানরা এখন সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। ভারত বা আমেরিকা আমাদের শত্রু নয় বরং বন্ধু কিংবা যুদ্ধাবস্থাও বিদ্যমান নয়। যতদূর জানা যায়, নাফিসের পরিবারটি উচ্চ শিক্ষিত। পিতা একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং একটি বোনও ডাক্তার। আকায়েদের পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এসব পরিবার থেকে আসা আকায়েদ, নাফিসরা কেন আমেরিকা, ব্রিটেন বিদ্বেষী হয়ে তাদের ভবিষ্যত সোনালি দিনগুলো অন্ধকারে বিসর্জন দিতে গেল? এর জবাবে কেউ যদি বলে বাংলাদেশের ধর্মান্ধ বুলশিট রাজনীতির শিকার হয়েছে তারা, তবে কি তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যাবে? লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী শিক্ষাবিদ
×