ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খান মাহবুব

টাঙ্গাইল কবিতা উৎসব

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

টাঙ্গাইল কবিতা উৎসব

সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের দর্পণ যার মাধ্যমে মানুষ সমাজে প্রতিভাস হয়। দেশজ সংস্কৃতির চর্চা ও বিস্তর-বিকাশে আমাদের অন্তরগরজ রয়েছে। তবে চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব দৃশ্যমান। বস্তুবাদী বাস্তবতার ব্যস্ততা আমাদের নগর জীবনের অনুষঙ্গ। জীবনকে চালিয়ে রাখতেই ব্যস্ত থাকতে হয় সকাল-সন্ধ্যা। এই ব্যস্ততায় নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা ও লালন অনেক সময় হয়ে উঠে না। আধুনিক নগরজনেরা আধুনিকতায় নানা বিষয় ও প্রকরণকে যাপিত জীবনে ধারণ করতে গিয়ে মাটির সংস্কৃতি থেকে অনেক সময় বিচ্যুতি ঘটে। সব মিলিয়ে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির চর্চার এক খরা দশা বিরাজমান। এই ক্রান্তিলগ্নেও কিছু এলাকা, কিছু সংগঠন বা ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি বিভিন্ন আয়োজনে বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতির ধারাকে উজ্জীবিত করতে তৎপরতা বিদ্যমান। এমন এক বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত সাবেক অসমের তান্ত্রিক রাজ্য কামরুপের অংশ বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা শিল্প-সংস্কৃতির এক তীর্থস্থান বাংলাদেশের এ কথা মান্য সত্য। আর টাঙ্গাইল হচ্ছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের শিখণ্ডি। কবিধাম হিসেবে খ্যাত টাঙ্গাইলের বাংলা কবিতা উৎসব নামীয় মোড়কে উৎসবের যাত্রা ২০০২ সালে। উৎসবে কবিতার প্রাধান্য থাকলেও সাহিত্যের অন্যান্য শাখার সংশ্লেষ রয়েছে। এবার বসছে বাংলা কবিতা উৎসবের চতুর্থ আসর। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৫০০ জন সাহিত্যসেবী এই আয়োজনে অংশ নেবে। জানুয়ারির ৪-৬, তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের ভেন্যু টাঙ্গাইল পৌর উদ্যান। এবার উৎসবে যোগ হচ্ছে নানা নতুন মাত্রিকতা। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সংস্কৃতিহিতৈষী ফজলুর রহমান খান ফারুক, উদ্বোধনী পর্বকে স্মরণীয় করে রাখতে নান্দনিক মঞ্চ তৈরি, ভারতেশ্বরী হোমসের পরিবেশনা ইত্যাদি, উৎসবকে উতুঙ্গে পৌঁছে দেবে। টাঙ্গাইল উৎসবের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে বাংলাদেশ এবং ভারতের কবিদের অংশগ্রহণের আবদার বেড়েছে। ফলে আমন্ত্রিতদের সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০ হতে প্রায় ৫০০ জনে নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রায় ৫০০ মানুষদের তিনদিন টাঙ্গাইল জেলা শহরে আবাসন-আহারসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা সত্যই দুরূহ। এই কর্মযজ্ঞে উৎসব কমিটির সম্পাদক মাহমুদ কামালসহ পুরো টিম গলদঘর্ম। দীর্ঘদিনের উৎসব আয়োজনের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। ২০০২, ২০০৫, ২০১০, ২০১৫ এবং বর্তমান ২০১৮ এর আয়োজনে আমাদের মূল কমিটির সঙ্গে সারথি অভ্যর্থনা কমিটি, আপ্যায়ন উপ-কমিটি, রেজিস্ট্রেশন উপ-কমিটি আবাসন উপ-কমিটি প্রচার উপকমিটি মঞ্চ ও তোরণ নির্মাণ উপকমিটি, অনুষ্ঠান পরিচালনা উপ-কমিটি, পরিবহন উপ-কমিটি, চিকিৎসা উপ-কমিটি। এবারের উৎসবকে আরও বেশি দর্শক ঘনিষ্ঠ ও জনসম্পৃক্ত করতে ভাসানীর হলের মঞ্চ থেকে বের করে শহরের পৌর উদ্যানের মক্তমঞ্চে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস উৎসব অধিক লোকপ্রিয় হবে। বাংলা কবিতা উৎসবে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় এবার পুরস্কার প্রাপ্তরা হচ্ছেনÑ কবি বিমল গুহ, ড. সুধাংশু শেখর রায়, কবি ফারুক মাহমুদ, ড. হাবীবুল্লাহ বাহার, ভারতের কবি তপন বন্দেগ্যাপাধ্যায় ও নলিনী বেরা। উৎসবে কবিতা পাঠের আসর ছাড়াও কথা সাহিত্যিকদের নিয়ে আয়োজন রয়েছে। দুটি বিশেষ গ্রন্থের প্রকাশ এবারের উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ। ভারতের কবি উত্তম দাশের জীবন ও কর্মের ওপর প্রকাশিত গ্রন্থ স্বাধীন বাংলাদেশ ও বিশাল ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী লেখকদের যোগসূত্রে সহায়ক হবে। বাংলা কবিতা উৎসব উপলক্ষে এবার প্রকাশিত হলো টাঙ্গাইলের রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের বর্তমান সময়ের দিক দৃষ্টা ফজলুর রহমান খান ফারুক জীবন ও কর্মগ্রন্থ। তার প্রায় আশি বছরের কর্মময় জীবনের নানা বিষয় নানা অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থের জমিনে ওঠে এসেছে। গ্রন্থটির সম্পাদনায় রয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, কবি আসাদ চৌধুরী, নাট্যকার মামুনুর রশিদ, কবি মাহমুদ কামাল ও খান মাহবুব। গ্রন্থটিতে নানা ঐতিহাসিক চিত্র যেন সময়ের জীবন্ত সহচর। বাংলা কবিতা উৎসব টাঙ্গাইলের সংস্কৃতিসেবীদের এক বেদীতে দাঁড়ানোর এক উৎসভূমি। এ জেলার সকল সংস্কৃতি সেবারা এই কর্মযজ্ঞে সহমত পোষণ করে চিন্তা ও তৎপরতার সমন্বয় সাধন করে। সকলের প্রসাবিত সহযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের নানা উপহারসামগ্রী প্রদান সম্ভব হয়। দীর্ঘদিনের এই আয়োজনের উদ্বোধনী পর্বে কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি আল মাহমুদ, কবি সৈয়দ শামসুল হক সহদেশ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ ইতোপূর্বে অংশ নিয়েছে। উৎসব শেষে প্রকাশিত হয়েছে উৎসবের আদ্যোপান্ত নিয়ে প্রকাশনা। এ সবই এখন আমাদের সংস্কৃতির অগ্রযাত্রার সারথি। এ বছর উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত টাঙ্গাইল তথ্য কণিকা এ জেলাকে পরিচিত করতে সহায়ক হবে। বর্তমানে তৃণমূলে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় বাংলা কবিতা উৎসব সমগ্র দেশের সংস্কৃতি সেবীদের কাছে প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য। আমরা বাংলা কবিতা উৎসবের বাইরেও নানামুখি তৎপরতায় বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে অগ্রগামী। এই যোক্তিক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে এখন আমরা দৃঢ়ভাবে দাবি করতে চাই টাঙ্গাইলবাসীর দীর্ঘদিনের চাওয়া এই জেলাকে সংস্কৃতি নগরী কিংবা বাংলাদেশের সাংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার। আমাদের কর্ম যদি এই দাবিরপক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য সহায়ক হয় তাহলে সকলের কাছে আমরা সহযোগিতা প্রত্যাশী। আমরাও কবিতার মতো সকলের হাত একত্র করে মানবিক বিশ্ব ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে প্রত্যয়ী। ভেদহীন সমাজ ও দেশই তো পারে কবিতার মত সব কিছু সাজাতে।
×