ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বই ॥ ভেঙ্গে গড়ার কাগজ

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

বই ॥ ভেঙ্গে গড়ার কাগজ

ক্ষুদ্র সাময়িকী ‘ৎ’ এর ২য় বর্ষের ২ সংখ্যা প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই ক্ষুদ্র কাগজটির সম্পাদনায় আছেন আহমেদ তানভীর। প্রচ্ছদ ও নামলিপিতে তানভীর এনায়েত। গত দুই বছর ধরে এই ছোট্ট সাময়িকীর নিয়মিত প্রকাশিত হওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও ২/১টি সংখ্যা বিশেষ কারণে বের করা সম্ভব হয়নি। শুরুতেই সম্পাদকীয়তে আহমেদ তানভীরের ক্ষোভ, হতাশা আর কষ্টের অনুভব বিধৃত হয়েছে। ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের বহুমাত্রিক সঙ্কটে সম্পাদক আশা-আকাক্সক্ষার বিরোধকে চৈতন্যের চরম স্খলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ব্যক্তিক প্রেম, স্বদেশ প্রীতি, মানবিক চৈতন্য থেকে শুরু করে ধর্মীয় উন্মত্ততার দুঃসহ আগ্রাসনে গোটা জাতির হতবিহ্বল অবস্থাকে সকরুণ আর্তিতে প্রত্যক্ষ করেন। ব্যক্তির বোধ আর আকাক্সক্ষার কাছে জীবন ও জীবিকার অসহায়ত্ব লেখককে উৎকণ্ঠিত করে, বিদগ্ধ অনুভবের তাড়নায় মর্মাহত হন। সেই মর্মান্তিক বেদনায় সমাজ সংসারের দৃশ্যপট ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় বিপর্যস্ত। এমন কন্টকাকীর্ণ পথপরিক্রমার বলয়কে সত্য ও সুন্দরের শুভযোগে নির্মল আর মঙ্গলময় করা ছাড়া বাঁচার বিকল্প কোন কিছুই নেই। আলোকময় জগত গড়ে তুলতে সব ধরনের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশাকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলতেই হবে। ছোট্ট এই সাময়িকী শুরু করা হয় একেবারে মলাটের ওপর লেখা একটি কষ্টকর কাব্যিক অনুভব দিয়ে। আহসান হাবীব হৃদয়ের ‘মাদার্স নেইম’ নামে কবিতাটিও দুঃখ ভারাক্রান্ত অন্তরের করুণ আর্তি। প্রতিদিনের ক্ষুধার্ত জীবনের কাছে সুকুমার হৃদয়বৃত্তি মূল্যহীন। প্রেম-ভালবাসা ম্লান হয়ে যায় নিত্য সমস্যা জড়িত জীবন প্রবাহের বাস্তব তাড়নায়। যা স্মরণ করিয়ে দেয় কবি সুকান্তের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘হে মহা জীবন’-এর আকর্ষণীয় পঙ্্ক্তিটি ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ ‘বদমাশ’ নামে গল্পটি লিখেছেন মাহবুব আলী, জীবনের গতিময়তায় দৈনন্দিন সুখ, দুঃখ, আশা-নিরাশার এক বিচিত্র শৈল্পিক আবেদনে গল্পকার তার কাহিনীর আঙ্গিক আর বৈশিষ্ট্য সাজিয়েছেন নির্দিষ্ট বলয়ের সীমারেখায়। জীবনের কঠিন আর রূঢ় বাস্তবতায় গল্পের গতিপথ নির্ণীত হয়, বিকাশ লাভ করে শেষ অবধি পরিণতিতে পৌঁছায়। শেষ পরিণামও হয় অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনাপ্রবাহের নির্মম আর্তনাদে। নায়িকা অরুণিমার করুণ মৃত্যু গল্পকারকে যে নিঃসীম অন্ধকারে পৌঁছে দেয় সেখান থেকে বের হওয়া সত্যিই দুঃসাধ্য। এর পরে থাকে হারানোর বেদনায় লেখকের বিষণ্ন প্রকৃতির মাঝে নিবিষ্ট হয়ে নিজেকে দুঃখের তিমিরে নিমজ্জিত করে দেয়া। রিফাত চৌধুরীর কবিতা ‘শিশু শয়তানে’ও আছে সমাজ প্রবাহের নেতিবাচক অবস্থার অন্তর্দর্শন। এখানেও অশুভ থেকে শুভ আর সুন্দরের দিকে মোড় ফেরানোর এক অনবদ্য কাব্যিক ঝঙ্কার। যা পাঠককে আন্দোলিত করে বিমোহিত অবস্থায় সত্য আর মঙ্গলের পানে ধাবিত করায়। মাহফুজ সজল লিখেছেন ‘চির কৌতুক’ কবিতাটি। এখানেও হার মানা জীবনের অপ্রাপ্তির হাহাকার। যা প্রতিদিনের গতিপথকে বিষাদময় করে তোলে। ভাল আর আলোকেও আবাহন করতে কবির ভুল হয় না। তানভীর এনায়েতের ‘মানুষ বিষয়ক’ ছোট বার্তাটি উপাদেয় এবং আকর্ষণীয়। অন্যের ক্ষতি করা কিছু মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু অনেকেই আবার কারোর অনিষ্ট করার কথা ভাবতেও পারে না। এই নিয়মেই সমাজ-সংসার তার যাত্রাপথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ভাল-মন্দের এই হিসাব-নিকাশে আলোর নিশানা উজ্জীবিত থাকেই। আর এখানেই মানুষ আর মানবতার জয়। আকিব শিকদারের প্রবন্ধ ‘খ- কথায় ‘ৎ’ এর মধ্যে আছে এই ছোট কাগজটির যাত্রা শুরু এবং নিরন্তর এগিয়ে যাওয়ার কথামালা। ‘ৎ’ এর যে মূল বার্তা ‘ভেঙে গড়ার কাগজ’ এটাকে সামনে রেখে পত্রিকাটি যেভাবে তার বিষয়বস্তু এবং অঙ্গসৌষ্ঠব নির্মাণ করে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তার পরেও সীমাবদ্ধতার কারণে সবকিছু নিয়ে ভাবাও কঠিন হয়ে যায়। ফলে এসব ব্যাপারে লেখকের কিছু পরামর্শ এসেছে যা কিনা কাগজটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটাবে। দেশকে অতিক্রম করে বহির্বিশ্বেও এর বিচরণ ঘটুক সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন প্রবন্ধকার। সব মিলিয়ে ছোট বইটি সুখপাঠ্য এবং পাঠকনন্দিত হবে বলে আশা করা যায়। ছোট্ট এই বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×