ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

অষ্টাদশীর কাছে প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

অষ্টাদশীর কাছে প্রত্যাশা

পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের দেশ নবীন হলেও নিজস্ব শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ইতিহাস কিন্তু নবীন নয়। এক কথায় এসবের ইতিহাস হাজার বছরেরও অধিক সময়ের; যদিও সমসাময়িক বাস্তবতা এসব থেকে আমরা কিঞ্চিৎ দূরে। তারপরও শিল্প সাহিত্য এবং নিজস্ব সংস্কৃতি আগলে রাখার অদম্য চেষ্টা আমাদের নিরন্তর। যার প্রমাণ, আমরা এখন সংখ্যায় অনেক বেশি জ্যোৎনা প্রেমী। শরতের পূর্ণিমা কিংবা মাঘী পূর্ণিমা এখন অনেক বেশি আমাদের কাছে মোহনীয়। উৎসবের উপযুক্ত ক্ষণ মনে করি বছরের প্রায় প্রতিটি পূর্ণিমা রাতকে। দেশের ভেতরে বা বাইরে পাহাড়, ঝর্ণা, সমুদ্র কিংবা অরূপ শোভায় সাজানো বিস্তীর্ণ প্রকৃতি দর্শনে আমরা এখন অনেক বেশি সজাগ। মানবের কাব্যিক মন জাগাতে কিংবা সাহিত্য অনুরাগী হতে এসব অতুলনীয়! যে কারণে এখন সাহিত্য চর্চার মানুষের সংখ্যাও বেশি। রাজধানী কিংবা বড় বড় জেলা শহরে আয়োজিত বই মেলার সংখ্যাও বেশি। প্রকৃত সাহিত্য বা গভীর জীবনবোধের উৎকৃষ্ট সাহিত্য তার সংখ্যাতো বরাবরই কম। সংখ্যাগরিষ্ঠের যারা চেষ্টা করেন তাদের ভেতর থেকেই তো মাঝে মাঝে রত্ন প্রসব হয়! সাহিত্য চর্চা অবশ্যই মহৎ কর্ম। কেননা আগুনের সংস্পর্শ ছাড়া সোনা যেমন কখনোই খাঁটি হয় না, তেমনি সাহিত্যের স্পর্র্শ ছাড়া মানব জীবন পূণ্য হয় না এই তো সেদিন! কি চমৎকার রৌদ্র উজ্জ্বল মিষ্টি আবহাওয়ার নিমন্ত্রণে শুরু হলো নতুন বছর ২০১৮। কি ধুমধাম করে মধ্যরাতে আকাশ রাঙিয়ে, অল্প সময়ের সীমাহীন কোলাহলের মধ্য দিয়ে, দুই হাজার সতেরো সালকে আমরা বিগত ঘোষণা করলাম। একই সঙ্গে স্বাগত জানালাম আঠারোকে! বিগত বেশ কয়েকটা বছর থেকে নির্ঞ্ঝাট বলার খাতিরে দুই হাজার সংখ্যাটাকে উহ্য রেখে আমরা কেবল পনেরো সাল, ষোলো সাল বলে বলে অভ্যস্ত হয়েছি। যে কারণে, আমরা এখন মহাকালের অষ্টাদশ সালের সাক্ষী! আমাদের এই ছোট্ট মানবজীবনের অষ্টাদশ নম্বর বছরকে বলা হয় সর্বাদিক গুরুত্বের। রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা বৈবাহিক যোগ্যতা কিংবা যে কোন স্বীকৃতি; সবই মেলে অষ্টাদশে! বাংলাদেশ তথা সমগ্র পৃথিবীতে গত সোমবার থেকে শুরু হয়েছে দুই হাজার আঠারো খ্রিস্টাব্দ। এ বছর অর্থাৎ অষ্টাদশের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, জীবনের জন্য যা কিছু তার সবকিছুর ইতিবাচক পরিবর্তন। মানবিক হওয়ার প্রত্যাশা আমরা সবাই চাই একটি সুখী মানবিক সমাজের অংশ হয়ে বেঁচে থাকতে। যে সমাজ, আমাদের সবক্ষেত্রে মানবিক হতে সহায়তা করবে। যদিও উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক প্রান্তে আমাদের মানবিক গুণের অনন্য উদাহরণ এখন দৃষ্টান্ত! এক্ষেত্রে আমি সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয় উল্লেখ করব না। কারণ, এটা রাষ্ট্রের সামগ্রিক মূল্যবোধের উদাহরণ। আমি বলব, এই দেশের মানুষগুলো রাষ্ট্রকে ছাপিয়েও অনেক বেশি মানবিক। এক্ষেত্রে আমাদের আবহমান বাংলার সাধারণ একটি পরিবারের, একটা ঘটনা বলা যেতে পারে। গত অক্টোবরের শেষের দিকের ঘটনা। গ্রামগুলোতে তখন পাতলা কাঁথার পরিবর্তে মোটা কাঁথার শীত পড়েছে। কোথাও কোথাও শেষরাতে পায়ের কাছে রাখা গরম লেপ চলে। এমনি এক শেষরাতে, মোটা কাঁথার ভেতর গভীর ঘুমে নিমগ্ন অখিল দাশ। পূর্ব আকাশে দিনের সূর্য ক্ষাণিক বাদেই দেখা দেবে! এমন সময় দরজায় খট্ খট্ শব্দ! প্রথমে শব্দের মাত্রা অল্প শোনালেও পরের শব্দগুলো তাকে বিছানা ছাড়তে বাধ্য করে। স্ত্রী নীলাকে বললে, সে উঠতে দেরি করছিল। ঘুম কাতর চোখে দরজা খুলে দেখে, তার দুলাল কাকা। সঙ্গে একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রী লোক দাঁড়িয়ে আছে। দুলাল অখিলের আপন কাকা নন। বেশ দূরেরই আত্মীয়। বাড়ির কাছের বাজারে একেবারেই শেষ মাথায় একটা চায়ের দোকান চালান, দোকানেই তার খাওয়া দাওয়া-থাকা। স্ত্রী গত হয়েছেন বছরপাঁচেক আগে। এখন পরিবার বলতে কেবল এক ছেলে, থাকে ঢাকায়। দুলাল বললেন, অখিল শোন, এই মানুষ তিনজন তোদের বাড়িতে আসবে। ভোর চারটের দিকে বাজারের দক্ষিণ দিকে ইসমাইলের দোকানের সামনে চুপচাপ বসাছিল। দোকানের জল আনতে খালের দিকে গেলে আমার সঙ্গে দেখা হয়। কোথায় যাবেন, জিজ্ঞেস করাতে তোর বাবার নাম বলে। কিন্তু এরা রাস্তা চেনে না। শীতের মধ্যে ওনাদের কষ্ট দেখে সকাল সকাল তোর কাছে নিয়ে আসলাম। অখিল তাদের ঘরের ভেতর আসতে বলে। এরপর সে জানতে চায়, তারা কারা, কোথা থেকে এসেছে? উত্তরে, পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ লোকটি বলে, আমার বাবার নাম নিপেন দাশ। শুনেছি আপনাদের বাড়িতে থাকত। গত এক সপ্তাহ আগে খবর পেয়েছি বাবা মারা গেছেন। খবরটা শোনার পর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। গত ক’দিন ধরে খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, মৃত্যুর পর ওনার সৎকার কে বা কারা করল, সমাধি কোথায় হলো! এসব উত্তর জানতে মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে গেলে, শেষে বাংলাদেশী দালাল ধরে গতকাল উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে স্ত্রী-মেয়েসহ রওনা হই। আপনাদের এখানে আসতে আসতে প্রায় শেষ রাত হয়ে যায়। তাই বাজারে অপেক্ষা করছিলাম। সব শুনে অখিল বলেন, নিপেন কাকা আমাদের বাড়িতে থাকত না। তবে, মাঝে মাঝে আসত। যদিও তিনি আমাদের রক্তের কেউ ছিলেন না। সম্পর্কে আমার বাবার জ্ঞাতি ভাই ছিলেন। তার পরও ওনার সব সুবিধা-অসুবিধা আমাকেই জানাত। আপন বলতে আমাকেই জানত। আমিও ওনাকে আপন কাকার মতোই জানতাম। বাজারে অনিল দাশের বড় দোকানে ছোটখাটো কাজ করতেন। বয়স বেশি হওয়াতে খুব একটা চলাফেরা করতে পারতেন না। শেষের দিকে কোন বেতন ছাড়া ওই বাড়িতেই (অনিশ দাশের) থাকতেন। মাসখানেক আগে এক রাতে ওনার ভীষণ জ্বর হয়। প্রায় চারদিন একটানা এক শ’ তিন-চার জ্বর ছিল। ওষুধ বলতে স্বাভাবিক জ্বরের ওষুধ চলছিল। আমি দুই দিন গিয়ে দেখে এসেছি। জ্বরের ছয়দিনের মাথায় ভোররাতে কাকা মারা যান। অনিল দাশের সঙ্গে বাজারের আরো কয়েকজন আর আমি ওনার সৎ করি। আপনাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। একটা ফোন নম্বরে চেষ্টা করে বন্ধ পেয়েছি। শেষে আমাদের বাড়ির উত্তর মাথায় ওনার সৎকার করি। পুত্রতুল্য বলে, আমিই ওনার মৃত্যুপরবর্তী সব কাজ সম্পন্ন করি। কিন্তু যতদূর জানি উনি তো আপনার সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগাযোগ করতেন। হ্যাঁ করতেন। তবে খুবই কম। উনি ভিওআইপি কার্ড কিনে আমাদের ফোন করতেন। নম্বর চাইলে কারও নম্বরই দিতে পারতেন না। বলতেন, আমি ভাল আছি। শরীর খারাপ হলে তোমাকে জানানো হবে। প্রায় চার মাস ওনার সঙ্গে কোন কথা হয়নি। এর আগে যখন কথা হতো তখন প্রায়ই বলতাম, আমাদের এখানে চলে আসো। উনি রাজি হতেন না। বলতেন আমি এখানে বেশ আছি! অখিল, ও, আর একটা কথা আপনারা কিন্তু কাকার মৃত্যু খবর জেনেছেন প্রায় কুড়ি দিন পর! এই ঘটনা আর বেশিদূর নিয়ে যাব না। কারণ, যা বোঝাতে চাইছি পাঠক নিশ্চয়ই তা বুঝেছেন! আসলে আমরা বা আমাদের সমাজটা এখনও কতটা মানবিক তার একটা বাস্তব উদাহরণ এটি। আপনি যদি এই পুরো ঘটনাটা পৃথিবীর অন্য কোন সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কল্পনা করেন তা হলে বিষটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। নতুন ক্যালেন্ডারের পাতায় আমরা এখন দুই হাজার আঠারো সালের অভিযাত্রী। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের জীবনে অনেক কিছু যোগ হয়, অনেক কিছুর বিয়োগ ঘটে। সামগ্রিক এই যোগ-বিয়োগের হিসাবে পৃথিবীব্যাপী মানবিক গুণসমূহের বিয়োগ ঘটছে অতিদ্রুত। যার দৃষ্টান্ত প্রতিনিয়ত আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সে বিবেচনায় আমাদের সমজে এখনও এই গুণটিকে বলা যায় ধীরক্ষয়িষ্ণু। নতুন বছরে আমাদের এই বোধ যেন আরও বেশি উজ্জ্বল বা স্পষ্ট হয়, সে প্রত্যাশা অবশ্যই আমাদের কাম্য। আমরা কখনই যেন ভুলে না যাই, বিশ্বব্যাপী আধুনিকতার এই যে উৎকর্ষ তা কিন্তু একে অন্যের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ফল। আশা করি অতীতের মতো আমরা এই গুণটির পরিচর্যা দুই হাজার আঠারোতেও করব। ইতিবাচক চিন্তার প্রসার মানুষ তার অন্তরাত্মায় যে সব চিন্তা বা ধ্যান-ধারণা লালন করে। বস্তুগত এই দুনিয়ায় তার বাহ্যিক অবস্থান সেভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে একটা গল্প বলা যাক। এক লোক ঠিক করলেন পুণ্য লাভের জন্য তীর্থস্থান বৃন্দাবন যাবেন। সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো দর্শন করবেন। অনেকদিন ধরে তার যাওয়ার চেষ্টা! কিন্তু, গৃহস্থঘরের মানুষ হওয়াতে তিনি সময় করে উঠতে পারছেন না। একটু গোছগাছের ব্যাপার তো অবশ্যই আছে। ওদিকে বাড়ি থেকে মথুরার দূরত্বও অনেক! তার পরও লোকটি প্রায়ই মনে মনে বৃন্দাবনে হারিয়ে যায়। কি শোভা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের! কি শোভা বৃন্দাবনের আকাশে-বাতাসে ইত্যাদি ইত্যাদি ভেবে। অবশেষে আর অপেক্ষা করতে না পেরে, একদিন সকালে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে! পথে গাড়িতে ওঠার সময় পাশের বাড়ির একজনকে বলে যায়। আমি ক’দিনের জন্য এক জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছি। বাড়িতে গিয়ে তুমি একটু বলো। সকলে যেন কোন প্রকার দুশ্চিন্তা না করে। এই বলে লোকটি গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছাড়ল। সকাল গড়িয়ে বেলা বাড়তে থাকল। লোকটার মনে তখন বাড়ির বিভিন্ন চিন্তা ডানা বাঁধতে থাকল। বিকেলে সেই চিন্তাগুলো দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো। মাঠ থেকে গরুগুলো ঠিক ঠিক বাড়ি ফিরেছে কি না! বিকেলে কচুক্ষেতে কেউ কি জল দিয়েছে!। ছোট ছেলেটা গোয়ালঘরের দরজা ঠিক ঠিক লাগাবে তো! এমন সব চিন্তা করতে করতে লোকটি এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখে, তার বড় গাভীটা কে যেন গোয়ালঘরের দরজা খোলা পেয়ে, বাড়ির পেছন থেকে কচুক্ষেত মাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে! গাভীটার সামনের মাসে বিয়ানোর কথা। প্রচ- ভয়ে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এর মধ্যে বাস এসে থামে বৃন্দাবনগরে। গাড়ি থেকে বৃন্দাবনের মাটিতে পা রাখার পর লোকটির ভেতর কোন ভাবের উদয় হলো না। তার যে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন সত্যি হলো, তার বিন্দুমাত্র তৃপ্তিও ভেতর থেকে জাগল না। বরং গতরাতে ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন, তাই যেন তার চোখের সামনে ঘুরছে। বলতে গেলে সে এক রকম ভুলেই গেছে সে এখন কোথায়! হঠাৎ দূরে একটা মন্দির দেখতে পেল! সে নিজেকে বলল, যাই ওখান থেকে একটু ঘুরে ফিরতি গাড়িতে বাড়ি ফিরে যাই! এই ভেবে মন্দিরের দিকে হাঁটা শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর, সে দেখল কয়েকজন লোক একটা গরু সঙ্গে নিয়ে অদূরের একটা কচুক্ষেতের ভেতর দিয়ে তার দিকে আসছে! গল্প শেষ। আসলে এই গল্পের মতোই সত্য আমাদের ভেতরের চিন্তা এবং বাইরের বস্তুজগত! অর্থাৎ আমরা যা যা ভাবছি। যেমন, আগামীতে কী করব, কী ভাবে করব, কেন করব ইত্যাদি ইত্যাদি। যে কারণে, আমাদের জীবনে যা-ই হচ্ছে বা ঘটছে তা আমাদের চিন্তার স্বরূপ। এটা সত্য, জাতিগতভাবে আমরা অনেক ইতিবাচক চিন্তা করতে অভস্ত। এযাবতকালে নিজেদের দেশ বলুন আর অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন বলুন সবই হয়েছে ইতিবাচক চিন্তার কারণে। কাজেই সুশ্চিন্তা ছাড়া আমাদের আগামী কল্পনা করা ঠিক নয়। আশা করি নতুন বছর সব চিন্তায় শুভবুদ্ধির আরও প্রসার ঘটবে। সাহিত্য-সংস্কৃতির আশ্রয়ে জীবন পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের দেশ নবীন হলেও নিজস্ব শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ইতিহাস কিন্তু নবীন নয়। এক কথায় এসবের ইতিহাস হাজার বছরেরও অধিক সময়ের; যদিও সমসাময়িক বাস্তবতা এসব থেকে আমারা কিঞ্চিত দূরে। তার পরও শিল্প সাহিত্য এবং নিজস্ব সংস্কৃতি আগলে রাখার অদম্য চেষ্টা আমাদের নিরন্তর। যার প্রমাণ, আমরা এখন সংখ্যায় অনেক বেশি জ্যোৎ¯œপ্রেমী। শরতের পূর্ণিমা কিংবা মাঘী পূর্ণিমা এখন অনেক বেশি আমাদের কাছে মোহনীয়। উৎসবের উপযুক্ত ক্ষণ মনে করি বছরের প্রায় প্রতিটি পূর্ণিমা রাতকে। দেশের ভেতরে বা বাইরে পাহাড়, ঝর্ণা, সমুদ্র কিংবা অরূপ শোভায় সাজানো বিস্তীর্ণ প্রকৃতি দর্শনে আমরা এখন অনেক বেশি সজাগ। মানবের কাব্যিক মন জাগাতে কিংবা সাহিত্য অনুরাগী হতে এসব অতুলনীয়! যে কারণে এখন সাহিত্যচর্চার মানুষের সংখ্যাও বেশি। রাজধানী কিংবা বড় বড় জেলা শহরে আয়োজিত বইমেলার সংখ্যাও বেশি। প্রকৃত সাহিত্য বা গভীর জীবনবোধের উৎকৃষ্ট সাহিত্য তার সংখ্যা তো বরাবরই কম। সংখ্যাগরিষ্ঠের যারা চেষ্টা করেন তাদের ভেতর থেকেই তো মাঝে মাঝে রত্ন প্রসব হয়! সাহিত্যচর্চা অবশ্যই মহৎ কর্ম। কেননা আগুনের সংস্পর্শ ছাড়া সোনা যেমন কখনই খাঁটি হয় না, তেমনি সাহিত্যের স্পর্র্শ ছাড়া মানবজীবন পুণ্য হয় না। বই পড়া, সহিত্যচর্চা কিংবা নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতি ধারণের সুচেষ্টা নিশ্চয়ই, দুই হাজার আঠারোতে আরও বেশি শাণিত হবে। মূল্যবোধের সঙ্গে জ্ঞানার্জন জ্ঞানার্জন বা শিক্ষা লাভ নিঃসন্দেহে মানবজীবনের সর্বউৎকৃষ্ট কর্ম। সেই প্রত্যন্ত গ্রামবাংলায় একটা প্রচলিত কথা আছে। ‘সব কিছুর ভাগ মেলে শিক্ষার নয়’ অর্থাৎ শিক্ষা বা জ্ঞান ব্যক্তির একান্ত সম্পদ। এ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক কথা যদিও বর্তমান। তার পরও একটা সুশৃঙ্খল পদ্ধতির মধ্যে আমাদের বর্তমান জ্ঞানার্জন সম্ভব হচ্ছে না! অতীতের থেকে আমরা এখন সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি, শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের জন্য মরিয়া। কিন্তু কিছু সচেতন ত্রুটির কারণে এই মহৎ কাজটি মহৎভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি কিংবা প্রশাসনিক ত্রুটি যাই বলি না কেন, এর বাইরে যে বা যারা এই মহৎ গুণটির অধিকারী হতে চায়, তাদেরও নিশ্চয়ই পবিত্র চিন্তার দায়ভার আছে! একটা সময় ছিল আমাদের দেশের ষাট থেকে সত্তর ভাগ মানুষের নাম লেখার মতো অক্ষরজ্ঞান ছিল না। এটা কিন্তু, খুব দূর অতীতের কথা নয়। আত্ম উপলব্ধি আর সদিচ্ছার কারণে অতিদ্রুত আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছি। এখন দিনে দিনে আমরা নিশ্চয়ই পৌঁছে যাব স্বাক্ষরতার শতভাগের কাছাকাছি। এক্ষেত্রে আরও অন্য সব কিছুর সঙ্গে দরকার সঠিক মূল্যবোধের প্রয়োগ। তবেই না মহৎ কাজটি সফল বা সার্থক হবে। আশা করি নতুন বছর আমাদের সেই শুভবুদ্ধির উদয় ঘটবে। ই-দুনিয়ার সঠিক ব্যবহার একজন প্রযুক্তিবিদ বলেছিলেন, ১৯০০-২০০০ সাল এই এক শ’ বছর প্রযুক্তিতে যে পরিবর্তন বা উৎকর্ষ সাধন ঘটেছে, তা ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল অর্থাৎ এই পনেরো বছরের মধ্যে তার অধিকাংশ ঘটে গেছে! ধনী, মধ্যবিত্ত কিংবা নিতান্তই গরিব সব দেশই এখন মোটামুটি প্রযুক্তিনির্ভর। এই মুহূর্তে বিশ্বের এমন একটা পরিবার হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে পরিবারটি টেকনোলজিনির্ভর নয়। অর্থাৎ প্রতিটি পরিবার কোন না কোনভাবে টেকনোলজিনির্ভর! বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির প্রতি এই যে তুমুল আগ্রহ তা মূলত সৃষ্টি হয় ইন্টারনেট বা ই-দুনিয়ার বদৌলতে। যখন এই দুনিয়ায় প্রবেশসুলভ হতে শুরু করল তখন থেকেই মানুষের জীবনযাপনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর সঙ্গে জুড়ে গেল। বছর বছর আমরা প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সংখ্যায় নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছি। বিশেষ করে আমাদের শহুরে জীবন এখন ই-দুনিয়ায় ব্যস্ত! একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ, সম্পর্ক সৃষ্টি, বিনোদিত হওয়া, পেশাগত ক্যারিয়ার, জ্ঞানার্জন বা শিক্ষা গ্রহণ মানব জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান কাজগুলো আমাদের বেশ সংখ্যক মানুষ এই দুনিয়ায় সম্পন্ন করছেন। ভবিষ্যতে এর সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বাড়বে! তবে, এক্ষেত্রে কিছু সাবধানতা তো অবশ্যই আমাদের মানতে হবে। বিশেষ করে কিছু নির্দিষ্ট ই-এক্টিভিটি যেমন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সময়ের অপব্যবহার কিংবা রুচিহীন বা অনৈতিক কাজকর্মে মস্তিষ্ক ক্ষয় হয় এমন বিষয়গুলোতে সচেতন থাকা জরুরী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সব বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠি, ঠিক সেই বিচারে অদূর অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বছরে ই-দুনিয়ার ক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি সচেতন হয়ে উঠব। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ এতক্ষণ যে আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, তার সব একত্র করলে একটা আধুনিক চিন্তার রেখা পাওয়া যাবে। এই আধুনিক চিন্তার রেখাটা আরও বেশি স্পষ্ট হবে যখন, এর সঙ্গে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটানো হবে। তার মানে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক চেতনা আধুনিক চিন্তার অনুষঙ্গ। অন্যদিকে সম্প্রদায় প্রীতি একটা দুর্বল, পুরনো ধ্যান-ধারণা। এর ভেতর কোন আলো নেই, আছে কেবল অন্ধকার। আমাদের অবশ্যই উচিত নিজ নিজ সম্প্রদায়ের উর্ধে গিয়ে বিশ্বমানবতার সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করা। আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি আমাদের এই জন্মভূমি অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে জন্মেছিল। সকল সম্প্রদায় মিলে বুকের রক্ত দিয়ে এই মাতৃভূমিকে আলিঙ্গন করেছিল। বছরের পর বছর দূর ভবিষ্যতেও এই চেতনা বেঁচে থাকবে আমাদের এই চারণভূমিতে। নতুন বছর অষ্টাদশের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
×