ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী সেলিম

একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ

মানবসমাজে একজন মানুষ যদি তার সততা, সদিচ্ছা ও সাহসিকতার যথাযথ ব্যবহার এবং প্রয়োগ করে সমাজ, দেশ ও জাতিকে কিছু উপহার দিতে চান তবে তা অনায়াসেই প্রদান করতে পারেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সদ্য প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। একজন সৎ, সাধারণ গর্বিত পিতার সন্তান পিতার প্রদর্শিত আদর্শ ও শিক্ষা-দীক্ষায় দীক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রথমে নিজ পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর একজন সৎ ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে বাংলাদেশ এবং বিদেশী ব্যবসায়িক সংস্থার প্রধান নির্বাচিত হয়ে দারুণ সফলতা লাভ করেছিলেন। তাছাড়াও বাংলাদেশের টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে বেশ সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে প্রতিটি অনুষ্ঠান পরিচালনাও করেছিলেন তিনি। দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি হয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার প্রসারিত করার বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিদেশে আরও ব্যাপকতা ও বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের বিভিন্ন পন্থা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবে রূপ দান করেছিলেন। রাজধানী ঢাকার তথা শহরবাসীর বিভিন্ন সমস্যা লাঘব ও শহরবাসীর জন্য কিছু করার মানসিকতা নিয়েই ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ও নির্বাচিতও হয়েছিলেন। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতাকে অবজ্ঞা করে জনসেবার মহৎ এক ব্রত এবং লক্ষ্য নিয়ে, সমাজ ও নগরবাসীর কল্যাণার্থে নিজেকে উৎসর্গও করেছিলেন তিনি। ভদ্র, শিক্ষিত, জনপ্রিয় এই মানুষটির আচার-আচরণ, কথাবার্তা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয়কে জয় করেছিল। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তার সরকারের সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন তিনি। ঢাকা উত্তরের ব্যাপক উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে তিনি সরকারপ্রধান ও শহরের উত্তরের জনগণের কাছে পেশ করে তার যথাযথ বাস্তবায়নে মহাকর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। তিনি সবচেয়ে দুরূহ ও অসম্ভব কাজগুলো অত্যন্ত স্বল্পসময়ের মধ্যে সম্পন্ন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শহরের তেজগাঁওয়ের অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড ও গাবতলীর বাস টার্মিনালের দখলকৃত সরকারী জায়গা তথা সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তিকে মস্তান, পরিবহনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের হাত থেকে মুক্ত করেন। অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে জনগণের অবাধ ও নির্বিঘ্নে চলাচলের উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে সরকারের ও জনগণের সম্পদ হিসেবে টার্মিনালগুলো তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর এলাকার উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্ব প্রদানকালে রংবাজ, মস্তানসহ বিভিন্ন দলীয় পরিবহন মালিক, শ্রমিক বা কোন মতলববাজ মহলের কাছে নতি স্বীকার বা আপোস করেননি তিনি। কোন প্রকার ভয়ভীতি ও অনুরোধের প্রতি কর্ণপাত না করে নিজ জীবনকে বিপন্ন করে অত্যন্ত শান্ত মস্তিষ্কে সাহসিকতার সঙ্গে একজন মেয়র হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছিলেন তিনি। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, সঠিক ও সুচিন্তিত গঠনমূলক সদিচ্ছা এবং উদ্যোগ থাকলে, জনগণের কল্যাণে যে কোন কঠিন ও দুরূহ কাজ সম্পন্ন করা যায়। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ, মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতাকর্মীদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। মেয়র নির্বাচিত ও দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি দ্রুত ঢাকা উত্তরের অবৈধ দখলকৃত ফুটপাথগুলোকে উদ্ধার করা, ফুটপাথের উন্নয়ন, বিজলী বাতির তথা স্ট্রিট বাতির ব্যাপক উন্নয়ন, রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ, সংস্কারকরণ, ড্রেনেজ অবস্থার উন্নয়নকরণ তথা বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজের বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধনের বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়ায় নিয়ে এসেছিলেন। বেশ কিছু উল্লিখিত কাজ বা উন্নয়ন তার জীবদ্দশায় শেষ হয়েছিল। তিনি উত্তরের জনগণের কল্যাণার্থে, উত্তরের জনপথকে একটি তিলোত্তমা নগরীতে রূপদান করে নগরবাসীর চলাফেরা ও হাঁটা-চলার পথকে নির্ঞ্ঝঝাট ও ঝামেলামুক্ত মসৃণ করার মহান ব্রত নিয়ে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে, তার প্রতিশ্রুতি-অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের কঠিন পথে নিজকে উৎসর্গ করেছিলেন। একজন মেয়র হিসেবে রাস্তায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনের সময় একজন সাদামাটা সাধারণ মানুষের মতোই জনগণ ও পথচারীদের সঙ্গে বাক্যালাপ ও মতামত, আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা বলতেন। তিনি যে একজন সংস্কারক পরিকল্পনাবিদ, প্রশাসক ও জনগণের সাধারণ সেবক হয়েছিলেন, এটা তার দৈনন্দিন কার্যকলাপ কথাবার্তার মধ্য দিয়েই প্রস্ফুটিত হয়েছিল। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন পৌরসভার উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার প্রতি বছর অর্থ বাজেটে প্রচুর টাকা বরাদ্দ করে থাকে। এই বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক সময় বিভিন্ন অনিয়ম বা বিশৃঙ্খল অব্যবস্থাপনায় আক্রান্ত্র হয়ে অথবা অর্থ ব্যয়ের সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় অথবা দায়িত্ব পালনের গাফিলতির কারণে, দায়িত্ব পালনে চরম দুর্নীতি-অপব্যবহার বিদ্যমান থাকায় সরকারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক উন্নয়ন পরিকল্পনার চরম বিফলতা ঘটায়। মরহুম আনিসুল হক ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর দীর্ঘদিনের ওই সব কলঙ্কিত ও কলুষিত প্রশাসনিক ও জঞ্জালকে তিনি কঠোরভাবে অত্যন্ত সততা, দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করে সিটি কর্পোরেশনকে জনগণের সেবার একটি বিভিন্ন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। স্বার্থান্বেষী মহলের বিভিন্ন অসন্তোষ, নাখোশকে তিনি তোয়াক্কা না করে নিজের প্রণীত ও গৃহীত পরিকল্পনা ও কর্মসূচীকে বাস্তবায়নের কঠোর নিয়মনীতি, আইন-কানুনকে সংরক্ষণ ও অনুসরণ করে তিনি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে একটি সুন্দর, স্বচ্ছ, মানসম্মত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থার মধ্যে সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন সাধনের মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। রাজধানী ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ দুই মেরুর দুই নির্বাচিত মেয়র যথা উত্তরের সদ্য প্রয়াত আনিসুল হক ও দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনÑ দু’জনের রাজধানীর নগর উন্নয়নের কর্মসূচী ও কর্মযজ্ঞকে যেন বেশ গতিবেগের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্ধকার রাতের টিমটিম করে জ্বলে, নিভে যাওয়ার সড়ক বাতির পরিবর্তে আধুনিক ও অধিক আলো প্রদানকারী বাতির ব্যবস্থা, শহরের বর্জ্য আবর্জনার যথাযথভাবে বিন্যাস করা, পয়ঃপ্রণালী, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ফুটপাথের অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করে জনগণের চলাচলের জন্য ফুটপাথগুলোকে অবমুক্তকরণসহ, রাতারাতি বিভিন্ন কর্মসূচী দুই মেয়রই তাদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচীকে বাস্তবায়ন করার কাজ নবউদ্যোমে শুরু করেছিলেন। এই দুই মেরুর দুই মেয়র তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের এক সমন্বিত কর্মপন্থা অনুসরণ করতেন, তাদের এই কর্মযজ্ঞের প্রচেষ্টায় ঢাকাবাসী বেশ আনন্দিত ও আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে বড় ভাইয়ের ন্যায় শ্রদ্ধা করতেন। তেমনি উত্তরের মেয়র মরহুম আনিসুল হকও দক্ষিণের মেয়রকে ছোট ভাই সমতুল্য সাঈদ খোকনকে প্রয়োজনীয় উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান করতেন। দক্ষিণের মেয়র উত্তরের মেয়রের অকাল মৃত্যুতে দারুণভাবে মর্মাহত ও ব্যথিত হয়েছেন। পরিশেষে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক কর্তৃক উত্তরের নগরবাসীর উন্নয়নের প্রচেষ্টা ও সফলতার কৃতজ্ঞতা এবং সম্মানস্বরূপ তার সম্মানে ও স্মরণে গুলশান অথবা বনানীর যে কোন একটি রাস্তার নামকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তাকে সম্মান করা হবে। লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
×