ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

ভর্তিবাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁসহীন শিক্ষা কি অধরা?

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

ভর্তিবাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁসহীন শিক্ষা কি অধরা?

ভর্তি বাণিজ্য শব্দটা বাংলা ভাষায় প্রচলন করার হোতা কে বা কারা? যেই হোক শব্দটি নতুন। অর্থাৎ স্কুলে ভর্তি হতে হলে, যে কোন ক্লাসে হোক, একটি গোষ্ঠী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জিম্মি করে টাকার বিনিময়ে ভর্তি হওয়ার সাধারণ অধিকারকে বাণিজ্যে পরিণত করেছে। বিশেষ করে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর কিছু খ্যাতনামা স্কুল। শিক্ষার্থীর শিক্ষার অধিকারকে সমাজের রাজনীতি, প্রশাসন ও শিক্ষা অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তি লঙ্ঘন করে চলেছে। এই অদ্ভুত, অমানবিক, শিক্ষার্থীর অধিকার লুণ্ঠনকারী, রাষ্ট্রের সংবিধান ভঙ্গকারী অর্থলোভীদের, যাদের অনেকের পরিচয় জেনেও সরকার যেন মূক ও বধির হয়ে আছে! কেন? শিক্ষাঙ্গনের এই সব দুর্নীতি ও নীতিহীনতার বিরুদ্ধেও একটি লড়াই শুরু করতে হবে। সত্যি করে বলতে গেলে- ভর্তি বাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁস- এ দুটি শব্দ আমাদের বিব্রতকর, লজ্জাস্কর পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে। যে অপরাধটিকে অপরাধ গণ্য করে এর নির্মূলে কাজ করার অন্য কোন বিকল্প নেই। এ কাজটি করার জন্য দুদককে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দৃঢ় অঙ্গীকরাবদ্ধ থাকার মতো উপযুক্ত পরিবেশ সরকারের দিক থেকে তৈরি করতে হবে। এছাড়া সরকারকে এখনই তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যেটি আগামী নির্বাচনের আগে দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। এসব পদক্ষেপের কয়েকটি হবে- ১. প্রাথমিক, মাধ্যমিক, সরকারী, বেসরকারী, কোন স্কুলে স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতে কোন দলের কোন সংসদ সদস্য সভাপতি বা সদস্য হতে পারবে না। তথ্যসূত্রে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতাধারী সংসদ সদস্য অথবা সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধিদের অনেকেই এই ধরনের আর্থিক দুর্নীতি সংঘটন করে থাকে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতেও এরা সে ধরনের অপরাধ করে থাকে। এদের অসততা, অর্থলোভই ভর্তি বাণিজ্য সংঘটিত হওয়ার প্রধান কারণ। আমার মতে শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতির মূলোৎপাটনের প্রধান শর্ত এটিই। ২. শিক্ষক নিয়োগে আরেক ধরনের বাণিজ্য হয় যা নিয়োগ-বাণিজ্য! অর্থাৎ শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফলকে মূল্যহীন করে তুলছে শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত কিছু অসাধু অর্থলোভী কর্মকর্তা, খাতা দেখা ও মূল্যায়নের সঙ্গে যুক্ত কিছু অর্থলোভী শিক্ষক ও কর্মকর্তা! ফলে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের মেধার স্থানে যোগ্যতা হয়ে যায় অর্থ বা ঘুষের পরিমাণ এবং ঘুষ প্রদানের ক্ষমতা! অথচ আমরা চাই, সরকারও চায় মেধাবীরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় আসুক। আমরা খুব ভাল করেই জানি শিক্ষক নিয়োগেও উৎকোচের প্রচলন আছে যা মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের পথে প্রধান বাধা। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, ’৭২ সালের শেষদিকে আমি পিএসসিতে প্রভাষক পদে পরীক্ষা দিতে যাব। কোলের শিশু ও হাঁটতে পারা শিশু দুটিকে ওদের বাবার কাছে রেখে বের হওয়ার সময় উনি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, পিএসসি অফিসের রাস্তা চিনতে পারব কিনা। বলেছিলাম, ‘মনে হয় চিনব, না চিনলে কাউকে জিজ্ঞেস করে নেব।’ পরীক্ষা বোর্ডে কে আছে, না আছে, তা জানার দরকার তখন কেউ ভাবত না। অনেক পরে, ’৮২-’৮৩ সালে, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার খাতা দেখতে এনসিটিবির চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের কর্মকর্তাদের একদিন দুপুরে ডেকে বললেন, আজ কেউ বাসায় যাবেন না, কয়েকটি বাসে আমাদের সাভারের সদ্য তৈরি এ্যাটমিক এনার্জি সেন্টারে একটি কাজ করতে হবে সারারাত। প্রয়োজনে পরদিনও। স্ব-স্ব বাসায় খবর দিয়ে সত্যিই আমরা চারটার দিকে বাসে চড়ে সেন্টারের দোতলার কক্ষগুলোতে পাতা চেয়ার-টেবিলে বসে সারারাত ও পরদিন সকাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার খাতা দেখেছিলাম! আমাদের সঙ্গে অনেক স্কুল, কলেজের শিক্ষকও ছিলেন। সম্ভবত লক্ষাধিক খাতা দেখা হয়েছিল। নম্বর দেয়ার ও কাটার কয়েকটি নিয়ম আমরাই ঠিক করে নিয়েছিলাম। তখনও মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ড, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও এনসিটিবির এসব দায়িত্ব কর্তব্যে নাক গলাত না, মাথাও ঘামাত না, অর্থ বা ঘুষের প্রশ্নই আসেনি। আমরা নাশতা, ভাত-তরকারি খেয়ে অর্পিত জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছি, এর জন্য সম্মানীর প্রশ্ন কেউ ভাবেনি! বিষয়গুলো এখন রূপকথা মনে হচ্ছে আমার কাছে! যা হোক, শিক্ষক নিয়োগকে বাণিজ্যে পরিণত করেছে কারা এবং কারা প্রাথমিক শিক্ষাকে মানহীন করার উদ্দেশে এবং নিজেদের অর্থ লাভের নতুন অন্যায় উৎস আবিষ্কার করে আমাদের সব শিক্ষার ভিত প্রাথমিক শিক্ষাকে ক্রমশ দুর্বল করে তুলল। অথচ বর্তমানের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে যে নতুন প্রজন্ম তাদের শিক্ষার শক্ত ভিত গঠনের কোন বিকল্প নেই। প্রাথমিক স্তরের ভাষা ও গণিতের মৌলিক দক্ষতাগুলো শক্ত বা পোক্তভাবে শেখা না হলে শিক্ষার্থী সে ভাষা ও গণিতের জ্ঞান-দক্ষতার সাহায্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সহজে গ্রহণ করতে পারবে? তাই এ নিয়োগ বাণিজ্য অবশ্যই সরকারকে বন্ধ করতেই হবে। কেননা শুধু বেতন বাড়িয়ে মাঝারি, নিম্ন মানের শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকরা মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করতে পারবে না। ৩. পরীক্ষা ও প্রশ্নফাঁস দুটি তো যমজের মতো গলাগলি করে চলে। পরীক্ষা না হলে বা যত কম পরীক্ষা হবে, প্রশ্নফাঁস এর আশঙ্কা তত কম হবে। দেখা যাচ্ছে, একবার কোন একটা পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হলে পরের পরীক্ষাগুলোতেও প্রশ্নফাঁস হচ্ছে, এই প্রবণতার প্রতি দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় এতে দুটি পক্ষ রয়েছে যারা অর্থলোভ ও অর্থলাভের একটি উৎস হিসেবে এই জঘন্য কাজটি করছে ব্যাংক ডাকাত গোষ্ঠীর মতোই। কিন্তু নেপথ্যে আর একটি দল রয়েছে যারা ফেসবুক, এ্যাপ ইত্যাদি মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস করছে! এরা তো আর্থিক লাভ করছে না, তাহলে ওদের প্রশ্নফাঁসের উদ্দেশ্য কি? অর্থলাভ ছাড়া রাজনৈতিক লাভ হয় যদি একটি গোষ্ঠী বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিন্দিত, কলুষিত করতে পারে, সর্বোপরি বর্তমান সরকার, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রের অর্জনকে ধূলিসাত করে একটি দল প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। সে কাজটি তারা করতে পেরেছে এবং একটি প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষার বদলে ফাঁকি দিয়ে নম্বর লাভের অনৈতিক পথে যেতে উদ্বুদ্ধ ও আগ্রহী করেছে। শুধু তাই নয়, এদের মা-বাবাদেরও ফেসবুকে প্রশ্ন এসেছে কি-না, আসলে সে প্রশ্ন নিজ হাতে ছেলেমেয়েদের পাঠ্য বিষয় না পড়ে ফাঁকির পরীক্ষায় সহায়তা দিতে কম আগ্রহী নয়! এ রকমই কিছু বাবা-মা প্রকৃত শিক্ষাকে ফাঁকি দিতে গিয়ে নিজেরাই ফাঁকিতে পরে নিজেদের, সন্তানদের জীবনে সফলতার বদলে ব্যর্থতা নিয়ে আসছেন। অনেকে আবার অবাস্তব ধারণা- মানুষ হত্যা করে বেহেশ্তে যাবার হিংস্র জঙ্গী পন্থায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে! আগের যুগে অর্থাৎ আমাদের যুগে ম্যাট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় আমরা দু’-একজন শ্রেণীর খুবই দুর্বল ছাত্রছাত্রীকে নকল করার চেষ্টা করতে দেখতাম। স্মর্তব্য, তারা কিন্তু কখনও প্রশ্ন জানতে পেত না, আন্দাজে সাজেশনের ওপর ভর করে, কোন অঙ্ক, কোন বইয়ের পাতা ছিঁড়ে আনত, বড়জোর কোন একটা রচনার নোট নিয়ে আসত, এতে তাদের পরীক্ষার ফল যা হওয়ার তাই-ই হতো। কারণ, এসব নকল হয় বেমিল হতো, মিল যদি থাকতও তবু আড়াল করে সে নোট দেখে লেখা আসলেই কঠিন কাজ হতো। আমরা জানতাম, পড়াশোনায় যারা খারাপ তারাই নকল করে, নকল করাদের সামাজিক নিন্দা অবধারিত ছিল। সেদিন এক আলোচনা সভায় যথারীতি পরীক্ষার আধিক্য, প্রশ্নফাঁস, নৈতিকতা শিক্ষা ইত্যাদি আলোচনায় আবারও আমি ভাঙ্গা রেকর্ডের মতোই বললাম, অতি পরীক্ষা কোচিং, নোট বই, মুখস্থবিদ্যা, প্রশ্নফাঁস, সার্টিফিকেট বাণিজ্য বা জিপিএ পাঁচ লাভের প্রতি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের ঠেলে দিয়েছে যা বন্ধ হয়ে যেতে পারে ক্লাসে প্রতি পাঠের শেষে মূল্যায়ন বা শ্রেণী পরীক্ষা নিয়ে যা বছর শেষে গড় নম্বরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মোট প্রাপ্ত নম্বর ও গ্রেড নির্দেশ করবে। তাছাড়া একজন শ্রেণীশিক্ষক খুব ভালভাবে জানেন তার শ্রেণির কোন ৫-৭ জন খুব দ্রুত শেখে, ভাল ফল করে, কোন ২০-২৫ জন মাঝারি মানের, মোটামুটি ভাল শেখে ও ফল করে, কোন ৭-৮ জন খুবই দুর্বল, সাধারণত প্রায় রোগে ভোগে, পরিবারে অর্থকষ্ট আছে, পড়াশোনায় দুর্বল এবং ফেল করে। তাদের জন্য দরকার নিরাময়মূলক শিক্ষা এবং পুষ্টি। প্রধানমন্ত্রীকে বল্ছি, আমরা শত শত মা-বাবা পেয়েছি যারা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য কোচিং, নোটবই, টিচারের দেয়া প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতেই বাচ্চাদের সব সময় চলে যায় বলে অভিযোগ করেছেন। পরীক্ষা উৎসব হবে কেন, তাছাড়া ওটা সিরিয়াস, শ্রমসাধ্যই থাকুক। ওরা উৎসব করবে স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, শিশু দিবসে, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনে, গান-বাজনা, নাচ-নাটক, আবৃত্তি এসবে যোগ দিয়ে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, গ্রামের যাত্রাপালা ও মেলায় গিয়ে। বড় শহরের স্কুলে না থাকলেও গ্রামের সব স্কুলেই বড় বড় খোলা জায়গা আছে, পুকুর আছে, ওরা শুধু বই পড়ে-উত্তর মুখস্থ না করে ছোটাছুটি করবে, সাঁতার কাটবে, ফুটবল, ক্রিকেট, অন্য খেলা খেলবে, বনে-জঙ্গলে দৌড়াবে ছুটির দিনে। মনে রাখতে হবে, বইয়ের তথ্য মুখস্থ করলে মানুষের মগজে জন্ম থেকে পাওয়া সৃজনক্ষমতা, সৃষ্টির প্রতি কৌতূহল ও নানা কিছু করার দক্ষতা মরে যায়। সে আর পরে উজ্জীবিত হয় না, পুনর্জীবিত হয় না। ক্লাস এইট পর্যন্ত শিশুদের স্বাধীনতা ও নিয়ম, দুটোই উপভোগ করতে, মেনে চলতে শেখাতে হয়। পরে বেশি বয়সে অনেক দক্ষতাই কিন্তু অর্জন করা কঠিন হয়। প্রাথমিক স্তরের সিংহভাগ ৬ থেকে ১৪-১৫ বছরের গরিব শিশুর শৈশবকে আমরা ক্ষমতার জোরে ভুল পথে চালাতে পারি না। পাবলিক পরীক্ষা সব সময় একটা চাপ, সেটি চাপ হয়েই থাকুক এসএসসি ও এইচএসসিতে। তাকে সংখ্যায় বাড়িয়ে উৎসব নাম দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন হয় না। বই উৎসব হচ্ছে খুব ভাল একটি প্রকৃত উৎসব। নতুন বই নিয়ে শিশুরা খুশি হোক, সঙ্গে পড়াশোনাটা আরও মানসম্পন্ন করার জন্য প্রথম তিন মাস ওরা আগের শ্রেণীর বাংলা, গণিত, ইংরেজিটা ঝালিয়ে নিক। এ বয়সে পাঠের পুনরাবৃত্তি খুবই কাজের। এটি চালু করুন। জিপিএ পাঁচ পাওয়ার জন্য ওরা কলুর বলদে পরিণত হয়েছে, আবার কেউ কেউ দেখছি কোর্মা পোলাওয়ের উৎসব করছে, যা এক কথায় শিশুর মনমানসিকতাকে আত্মম্ভরী করে তুলছে, ফলে অকৃতকার্য হয়ে অনেক শিশু আত্মহত্যা করছে, ভাবছে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে! আসলে পরীক্ষা পাস, জিপিএ পাঁচ, ফার্স্ট ডিভিশন- এগুলো জীবনে বড় কথা নয়, কারণ শিক্ষায় ‘ধীরে প্রস্ফুটিত’ (খধঃব নষড়ড়সবৎ) হওয়ার বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আইনস্টাইন শুধু নয়, আমাদের অনেকেই যা কিছু সফলতা আজ পেয়েছি, তা হয়েছে ধীরে, অনেক পরে। এডিনবরায় পড়াকালে আমার এক শিক্ষক আমাকে বলতেন, ‘ব্লটিং পেপার স্টুডেন্ট’। ৪. নীতি-শিক্ষা ও ধর্ম শিক্ষা নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত ‘১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ খুদা কমিশন রিপোর্ট ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম শিক্ষার বদলে নীতি শিক্ষার একটি বই চালু করার প্রস্তাব করেছিলেন। জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা ও রাজনীতি, অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত ছিল বলে কুদরাত-এ খুদার নির্দেশিত কারিকুলাম প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে চালু ছিল। তবে নীতিশিক্ষার এক বই হয়নি। চার ধর্মের আলাদা আলাদা বই হয়ে ধর্মশিক্ষা চালু হলো বাংলাদেশে সেই প্রথম। এর আগে, আমরা পাকিস্তানী আমলে ভাষা শিক্ষার বই পড়তাম, ক্লাস নাইনে হয় উর্দু না হয় আরবী অথবা সংস্কৃত নিতে হত। সে হিসেবে আগে আমরা উর্দু, আরবী, দুটোই পড়েছি ক্লাস সিক্স থেকে। ধর্মশিক্ষা না থাকায় ধার্মিকেরা কম ধার্মিক হয়েছে তা কিন্তু নয়। তবে নাইন থেকে একটি ভাষা বিষয় বাছাই করতে হবে, এ নিয়মে আমরা বন্ধুরা সবাই উর্দু নেব, এটা ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমাদের রেজিস্ট্রেশনের সময় ‘স্বাস্থ্য’ নামের এক বিষয় এ তিন ভাষার পাশে এসে পড়ল। আমরা হৈ হৈ করে সবাই বাংলায় পড়ার ‘স্বাস্থ্য’ বিষয় বাছাই করে ফেললাম। এদিকে চরম হতাশ উর্দু মৌলবী সাহেব আমাদের মত বদলানোর চেষ্টা করলেন কারণ দুই মৌলবী সাহেবের মধ্যে আরবী মৌলবী সাহেবের ভাগে পড়েছিল তিন-চারজন যারা জানত আরবীতে অনেক নম্বর উঠবে। যাই হোক, স্কুলের গল্প এখানে নয়। আমার প্রস্তাব-চার ধর্মের বইয়ের ভাষা হবে বাংলা, এ বই দিয়ে আরবী, সংস্কৃত, পালি শেখানোর প্রয়োজন নেই। শিক্ষার্থী জীবিকার তাগিদে বিদেশী যে কোন ভাষা শিখবে। কারণ ব্যবহার না থাকলে ভাষা শিক্ষা হারিয়ে যায়, যেমন আমরা উর্দু, আরবী ভুলে গেছি। এই চার ধর্মের সহজ বই এর পাশে সব ধর্মের সব শিশুদের জন্য একটি নীতিশিক্ষার চটিবই থাকবে যাতে মহৎ মানুষের জীবনী, তাঁদের বক্তব্য, তাঁদের আত্মত্যাগ, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিকদের আত্মোৎসর্গ, কোন মৃত মুক্তিযোদ্ধার চিঠিও থাকতে পারে। শিশুদের শৈশব থেকে দুঃখ, শোক, বেদনাবোধ করতে দিতে হবে। এভাবে ওরা সংবেদনশীল এবং দয়ালু হবে। মনে রাখতে হবে, এক এক শিশু এক এক ভাবে শেখে। কেউ বই পড়েও খুব ভাল শেখে, কেউ বাবা-মা-শিক্ষককে অনুকরণ করে তাদের কাছ থেকে শেখে, কেউ খেলাধুলা, গানবাজনা করে পড়ার সময় পড়ে ভাল করে, কেউ যন্ত্রপাতি, খেলনা ভেঙ্গে, ভেতরে কলকব্জা খুলে দেখে কিছু বানিয়ে শেখে, কেউ গল্প-কবিতা পড়ে জীবনের নীতি শেখে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। ওদের শেখার, পড়ার, জানার হাতিয়ারগুলো বর্ণমালা, সংখ্যা, ভাষা ও গণিতের দক্ষতাগুলো এবং নানা রকম অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ দিয়ে শিখতে দিতে হবে। বড়রা দেখবে ওরা যা শিখছে তা যেন হয় শুদ্ধ, সঠিক এবং ইতিবাচক হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×