ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ট্যাক্স-কর যোগ করে সিলিন্ডার প্রতি দাম ৬০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়

কাঁচামালের দ্বিগুণ দরে দেশের বাজারে এলপিজি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৪ জানুয়ারি ২০১৮

কাঁচামালের দ্বিগুণ দরে দেশের বাজারে এলপিজি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কাঁচামালের দ্বিগুণ দরে দেশের বাজারে এলপিজি (লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) বিক্রি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের এলপিজির উৎপাদন ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক বাজার দর বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারী উদ্যোগের অভাবে এলপিজিতে অনৈতিক বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা। মজুদ স্বল্পতার দোহাই দিয়ে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করলেও রান্না ঘরের জ্বালানি সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে এক টন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বর্তমানে ৬৯০ ডলার। অর্থাৎ প্রতি কেজির দর দশমিক ৬৯ ডলার। সে হিসেবে ১২ কেজি এলপিজির দাম দাঁড়ায় ৬৬২ টাকা (১ ডলার= ৮০ টাকা হিসেবে)। অথচ দেশের বাজারে এই এলপিজি বোতলজাত করে বিক্রি হয় প্রায় দ্বিগুণ দামে, এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাসের দাম ছাড়াও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালন বিতরণ খরচের সঙ্গে যোগ হয় আরও দুই ধাপে মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা। উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ডিলার এবং ডিলারের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় এলপিজি। এই দুই স্তর পেরোতে দাম বেড়ে যায় অন্তত ১৫০ টাকা। বাংলাদেশে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করা বেসরকারী কোম্পানিগুলোর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। তবে তাদের কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তেলের উপজাতের মধ্যে বিউটেন ও প্রপেনের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় এলপিজি। এরপর এটি ট্যাঙ্কারে সংরক্ষণ করে সিলিন্ডারে দিয়ে বাজারজাত করা হয়। আমদানির ক্ষেত্রে সরাসরি জাহাজে করে এই গ্যাস আনা হয়। এরপর ট্যাঙ্কারে সংরক্ষণ করে বোতলজাত করে বিক্রি করা হয়। সরকারীভাবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কোম্পানিগুলো এলপিজি সরবরাহ করে। বেসরকারীভাবে বসুন্ধরা এলপিজি, এনার্জিপ্যাক, বেক্সিমকো, পেট্রোগ্যাস, যমুনা, টোটাল গ্যাস, ওরিয়ন, ওমেরা এবং বাংলাদেশ অক্সিজেন কোম্পানিসহ (বিওসি) ৪৪টি কোম্পানি বাজারে এলপিজি সরবরাহ করে। এছাড়া আরও প্রায় একশ’ কোম্পানিকে এলপিজি সরবরাহের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। বিপিসির একজন কর্মকর্তা জানান, দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় চার থেকে তিন লাখ টন গ্যাস প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারীভাবে মাত্র ১৮ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন। বেসরকারীভাবে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন এলপি গ্যাস বাজারজাত করা হয়। এদিকে, সরকারীভাবে উৎপাদিত বিপিসির এলপি গ্যাস প্রতি বোতল (১২ কেজি) ৭০০ টাকা দামে বিক্রি করে। কিন্তু বেসরকারী কোম্পানিগুলো এলপি গ্যাস প্রতি বোতল সাড়ে ৯০০ থেকে এক হাজার ২৫০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করছে। এ বিষয়ে একটি বেসরকারী কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ১২ কেজির একটি এলপিজি সিলিন্ডারে তাদের খরচ হয় ৮৪৫ টাকা। তারা বিক্রি করেন ৯৪৫ টাকায়। এর সঙ্গে খুচরা বাজারে আরও ১৫০ থেকে ২০০ টাকা যোগ করে বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে ডিলার এবং খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফা ছাড়াও পরিবহন ব্যয় রয়েছে। আরেক কর্মকর্তা জানান, খরচের মধ্যে গ্যাসের দাম, প্রিমিয়াম, জাহাজের ভাড়া, বন্দরে আনার পর খালাস পর্যন্ত খরচ, এরপর কারখানায় নেয়ার খরচ, সিলিন্ডারের দাম ও সিলিন্ডার কারখানা থেকে ডিলারদের কাছে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত খরচ হিসেব করা হয়। তিনি আরও জানান, সব মিলিয়ে যে খরচ হয় তাতে লাভ খুবই কম থাকে। তবে কত লাভ থাকে তা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। গ্যাস সঙ্কটের কারণে আবাসিকে এখন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে রাজধানীর বহু এলাকায় এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। মিরপুরের বাসিন্দা শম্পা জানান, গ্যাসের লাইন না থাকায় সিলিন্ডার ব্যবহার করছি দীর্ঘদিন ধরেই। পাইপলাইনের গ্যাসের তুলনায় দাম তো বেশি পড়ছেই, তারপরও মাঝে মাঝে মনে হয় গ্যাসও কম থাকে। কিন্তু কিছুই করার নেই। বাধ্য হয়েই ব্যবহার করতে হচ্ছে। তিনি জানান, বাজারে দামের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা সমস্যা। কোথাও সিলিন্ডার এক হাজার ১০০ টাকায় আবার কোথাও কোথাও এক হাজার ২০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের এগিয়ে আসা দরকার বলে তিনি মনে করেন। কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘এখন আন্তর্জাতিক বাজারে যে দামে এলপি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে তার সঙ্গে কমিশন, ট্যাক্স-কর যোগ করে সিলিন্ডার প্রতি দাম ৬০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। ফলে যার যেমন ইচ্ছে সেই দামে সিলিন্ডার বিক্রি করছে। তিনি অভিযোগ করেন, এলপিজির খুচরা মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই। কোম্পানিগুলো একেক দামে ডিলারের কাছে গ্যাস বিক্রি করছে। ডিলাররা ইচ্ছেমতো লাভ ধরে গ্রাহক পর্যায়ে তা সরবরাহ করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘এই দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নীতিমালা করা জরুরী। সরকার বার বার নীতিমালার কথা বললেও এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।’ বুয়েটের পেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘বাংলাদেশ তেল উৎপাদনকারী দেশ নয়। ফলে আমাদের পক্ষে এলপিজি উৎপাদন করা সম্ভব নয়। নিজেরা এলপিজি উৎপাদন করতে পারলে দাম অনেক কম হত।’ তিনি জানান, বর্তমানে যে রিফাইনারি আছে তাতে মাত্র এক লাখ টন তেল পরিশোধন করা হয়। সেখান থেকে যে এলপিজি পাওয়া যায় তার পরিমাণ খুবই কম। আর সিলেটের কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্র থেকে উপজাত হিসেবে পাওয়া কনডেনসেট থেকেও খুবই কম এলপিজি হয়। সব মিলিয়ে মাত্র ২০ হাজার টন এলপিজি পাওয়া যায়। যা চাহিদার মাত্র ৫ ভাগ মেটাতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে নীতিমালা করতে হবে। নীতিমালার মাধ্যমেই সব বিষয় নির্ধারণ করা যেতে পারে।’
×