ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিবন্ধন পেতে আবেদন ভুঁইফোঁড় ৭৬ দলের

নির্বাচন কমিশনের নাকে নয়, টেবিলে এবার ‘নাকফুল’

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৪ জানুয়ারি ২০১৮

নির্বাচন কমিশনের নাকে নয়, টেবিলে এবার ‘নাকফুল’

শাহীন রহমান ॥ ‘নাকফুল’ বাংলাদেশ! না, এটা কোন নারীর পরিহিত গয়না বা ফুলের নাম নয়। নয় কোন সাংস্কৃতিক বা সামাজিক সংগঠনও। এটা একটা রাজনৈতিক দলের নাম। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছে দলটি। শুধু ‘নাকফুল’ বাংলাদেশ নয়, এবারে ইসির নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়েছে এ রকম বাহারি নামের কিছু রাজনৈতিক দল। খোঁজ নিয়ে দেখ গেছে, নামসর্বস্ব এসব দলের হঠাৎ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড় সংগঠন। দল হিসেবে শর্ত পূরণের যোগ্যতা না থাকলেও নিবন্ধনের জন্য লাইন দিয়েছে। শুধু নাকফুল বাংলাদেশ নয়; এবারের ইসিতে নিবন্ধন পেতে আরও যেসব বাহারি রাজনেতিক দল আবেদন জানিয়েছে Ñ মঙ্গল পার্টি, কল্যাণ পার্টি, জালালী পার্টি, শান্তির পার্টির মতো রাজনৈতিক দলের নাম রয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে যারাই আবেদন করুক না কেন, তাদের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পরই কেবল নিবন্ধন দেয়া হবে। যাদের নিবন্ধন দেয়া হবে তারা আগামীতে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচন করতে পারবেন। গত ৩১ ডিসেম্বর ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের জন্য আবেদনের শেষ সময়। ইসি সূত্রে জানা গেছে, এই সময় পর্যন্ত নিবন্ধন পেতে ৭৬টি রাজনৈতিক দল আবেদন করেছে। আরও কিছু দল আবেদনের সময় সময়সীমা বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হলেও ইসির পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। তবে জানা গেছে, যেসব দল আবেদন জানিয়েছে তাদের বেশিরভাগ বাহারি নামের। রাজনৈতিক এসব দলের নাম শুনলে যে কারো হাসি পাবেই। ইসির তালিকায় বাহারি দলগুলোর মধ্যে রয়েছে নাকফুল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নিউ সংসদ লীগ, ঘুষ নির্মূল পার্টি, মঙ্গল পার্টি, কর্মসংস্থান আন্দোলন, বাংলাদেশ সমাধান ঐক্য পার্টি (বসবাস), সোনার বাংলা উন্নয়ন লীগ, সত্যব্রত আন্দোলন, সততা দল, জাতীয় পরিবার কল্যাণ পার্টি, শান্তির দল, জনতার কথা বলে, মৌলিক বাংলা, জনস্বার্থে বাংলাদেশ, সুশীল সামাজিক আন্দোলন, বাংলদেশ আলোকিত পার্টি, বাংলাদেশ মঙ্গল পার্টি, বাংলাদেশ সমাজ উন্নয়ন পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ নিউ সংসদ লীগ (বিএনএসএল), তৃণমূল ন্যাশনাল পার্টি, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণশক্তি দল, বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস (বিজেসি), বাংলাদেশ জনতা ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি, বাংলাদেশ রামকৃষ্ণ পার্টি, মুক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন, নতুন ধারা বাংলাদেশ (এনডিবি), সাধারণ জনতা পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিজম ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও মৌলিক বাংলা দল। এসব দলের বেশিরভাগই নামসর্বস্ব। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও এসব দলের যেমন নেই কোন কেন্দ্রীয় কার্যালয়। কোন কোন দলের নেতার বাড়ির ঠিকানাকেই দলীয় ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক দল প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তও জমা দিতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এক ধরনের রাজনৈতিক দলকে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব দলের নির্বাচনের সময় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার লক্ষ্য থাকে সব সময়। নিবন্ধনের বিধান চালু হওয়ার পর থেকে দেখা গেছে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনার যোগ্য নয়। তারপর নির্বাচন এলেই নিবন্ধনের জন্য লাইন দিতে শুরু করে। গত বছর ১৬ জুলাই ইসির পক্ষ থেকে যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে নতুন দলের নিবন্ধনের কথাও বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী গত ৩০ অক্টোবর নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ইসি। গত ৩১ ডিসেম্বর ছিল নিবন্ধন আবেদন জমা দেয়া শেষ সময়। এর মধ্যে ৭৬ রাজনৈতিক দল তাদের আবেদন জমা দেয়া। এসব দলের মধ্যে ঐক্য ন্যাপ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জোনায়েদ সাকীর গণসংহতি আন্দোলন যেমন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। তেমনি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে আছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামিক গাজী, জালালী পার্টি, ইনসানিয়া বিপ্লব, ইউনাইটেড ইসলামী পার্টি, ইসলামিক পার্টি, ফরায়েজি আন্দোলন, বাংলাদেশ রামকৃষ্ণ পার্টি, বাংলাদেশ হিন্দুলীগ, মাইনরিটি জনতা পার্টি। সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। ২০০৮ সাল থেকে তা চালুর পর বর্তমানে ৪০টি দল নিবন্ধিত রয়েছে। দলীয় প্রার্থীর বাইরে অন্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কমিশনের তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ হলে একটি দল নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হয়। শর্তগুলো হলো- ১. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোন জাতীয় নির্বাচনের আগ্রহী দলটি যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকে, যে কোন একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পায় এবং দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ (২১টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১শ’টি উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক দলগঠনের কোন আইন নেই। ফলে যে যার ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক দল গঠন করছে। কয়েকজন লোক একসঙ্গে বসে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের জন্ম দিচ্ছে। এভাবে জন্ম নেয়া কোন সংগঠন দল হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক দলগঠনের আইন রয়েছে। এখানে যদি এ ধরনের আইন করা হয় তাহলে রাজনীতির নামে ভূইফোঁড় এ ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম নিত না। তারা বলেন, নির্বাচনে এসব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে জোটের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে কদর সৃষ্টি করা। অথচ নির্বাচনে এসব দলে কোন প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রার্থী দিলে জামানত থাকে না। জনগণের কাছে দল হিসেবে নেই কোন গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের কোন শর্তও পূরণের ক্ষমতা এদের নেই। এ ধরনের হঠাৎ গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি জে অব. সাখাওয়াত হোসেন এর আগে জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণের কোন আইন নেই। রাজনৈতিক দল কেমন হবে তার কোন আইন নেই। তবে আমাদের দেশে এ ধরনের আইন না থাকলেও নেপালের সংবিধানের রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। দেশে এক হাজার রাজনৈতিক দল থাকলেও নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত হতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর শর্ত পূরণ করতে হবে। আমাদের সময়ও অনেক রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়েছিল। শর্ত পূরণ না হওয়ায় সবাইকে নিবন্ধন দেয়া সম্ভব হয়নি। দল হিসেবে নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই কমিশনের নিবন্ধন থাকতে হবে। যাদের নিবন্ধন নেই তারা বড় দলের সঙ্গে নির্বাচনে গেলে তারা দল হিসেবে গণ্য হবে না, উল্লেখ করেন। তবে এই ধরনের এবং এত অধিক রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করায় ইসির কর্মকর্তারাও বিস্মিত হয়েছেন। তারা জানান নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা বেশিরভাগ দলই নাম ও প্যাডসর্বস্ব। আবেদনের সঙ্গে নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়নি অনেক রাজনৈতিক দল। তবে সব দলের আবেদন সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করতে ইসি একটি কমিটি গঠন করেছে। প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ের দলীয় কার্যালয় ও কমিটির বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবে কমিশন। ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, এবার ৭৬টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এসব আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি করা হবে। নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করছে কি না, তা কঠোরভাবে যাচাই করা হবে। প্রয়োজনে মাঠপর্যায়ে তদন্ত ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেয়া হবে। আগামী মার্চ নাগাদ নতুন দলের নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত আসবে। পাশাপাশি নিবন্ধিত দলগুলো শর্ত পূরণ করছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। যেসব দলের কর্মকা- নেই, নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করছে না, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে উল্লেখ করেন।
×