ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আজকের ছাত্রলীগকে হতে হবে মেধাভিত্তিক সংগঠন -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৪ জানুয়ারি ২০১৮

আজকের ছাত্রলীগকে হতে হবে মেধাভিত্তিক সংগঠন -স্বদেশ রায়

এখন যারা ছাত্রলীগের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়- তারা পর্যায়ক্রমে দেশের নেতৃত্বে আসবে। কেউ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেবে, কেউ প্রশাসনিক নেতৃত্ব নেবে, কেউ বিচার বিভাগীয় নেতৃত্ব নেবে, কেউ শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, সাংবাদিকতা- এমনিভাবে রাষ্ট্রের ও সমাজের সব ক্ষেত্রের নেতৃত্বে আসবে তারা। ছাত্রলীগ করার অর্থ কখনই শুধু এ নয় যে ভবিষ্যতে আমি একজন রাজনীতিক হব। একটি ছাত্র সংগঠন করার অর্থ হলো নেতৃত্ব দেয়ার একটি ট্রেনিং নেয়া। একটি সংসার পরিচালনার জন্যও ভাল নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলী থাকতে হয়। একজন নারী ও একজন পুরুষ মিলে একটি সংসার গড়ে। দু’জনের যখন ভাল নেতৃত্বের গুণাবলী থাকে তখন সে সংসারটি সুন্দর হয় ও পরিকল্পিতভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়। নেতৃত্বের অন্যতম গুণ হলো- ভবিষ্যত পরিকল্পনা করার যোগ্যতা অর্জন করা এবং ওই পরিকল্পনার ছকের ওপর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আজ যারা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলে ছাত্রলীগ করছে তাদের পর্যায়ক্রমে ১৮ কোটি থেকে ২৫ কোটি মানুষের একটি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে। জনসংখ্যা ধীরে ধীরে যত বাড়বে ততই যেমন তরুণের সংখ্যা বাড়বে, তেমনি সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যাও বাড়বে। ছোট একটি দেশে একদিকে তরুণের জন্য কর্মসংস্থান, অন্যদিকে সিনিয়র সিটিজেনের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা এই দুইকে সমন্বয় করে তখন দেশ চালাতে হবে। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই কাজ কোন রুটিন পরিকল্পনা দিয়ে হবে না, যথাপরিকল্পনা ও অধিকতর যোগ্যতা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আজ যারা ছাত্রলীগ করছে, তাদের আগামী দিনে দেশের যে কোন সেক্টরে নেতৃত্ব দিতে হলে অবশ্যই অনেক বেশি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আজ এই স্কুল পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি যারা ছাত্রলীগ করছে তাদের সামনে এখন প্রশ্ন, অনেক বেশি যোগ্যতার অর্থ কি? অনেক বেশি যোগ্যতার অর্থ হলো তাদের বিশ্বমানের হতে হবে। দেশটির জনসংখ্যা যখনই বিশ কোটি ছুঁয়ে যাবে, তখন গ্লোবাল ভিলেজের একটি অংশ করতে না পারলে দেশটি জনভারে ক্লান্ত হয়ে যাবে। দেশকে বিশ্বের একটি অংশ করতে হলে অবশ্যই নিজেকে বিশ্বমানের হতে হবে। তাই এ মুহূর্তে যারা ছাত্রলীগের নেতা, যারা ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষক তাদের উচিত হবে- মেধা অনুসারে ছাত্রলীগের সদস্যরা যাতে নানা বিষয়ে বিশ্বমানের শিক্ষা পায় সে ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে যারা ছাত্রলীগ করে তাদেরও প্রতিমুহূর্তে চেষ্টা করতে হবে আমি কীভাবে নিজেকে বিশ্বের সঙ্গে মেলাব। বিশ্বের সঙ্গে বর্তমান যুগে নিজেকে মেলানো কিন্তু খুব কঠিন কিছু নয়। তথ্যপ্রযুক্তি এখন বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছে। এই তথ্যপ্রযুক্তি যেন কেবল ফেসবুকে নানা দৈনন্দিন ঘটনা প্রকাশের কাজে ব্যয় না করি। এই তথ্যপ্রযুক্তিকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যে পরিবর্তন হচ্ছে, সেই পরিবর্তন সম্পর্কে পড়াশোনার কাজে লাগাতে হবে। যেমন এমন একদিন ছিল, যখন কোন ছাত্র সংগঠনে যিনি সঙ্গীতচর্চা করতেন, তার জন্য কিন্তু সঙ্গীতের বিশ্বভুবনে ঢোকার কোন সহজ পথ ছিল না। এখন সেদিন বদলে গেছে। এখন পৃথিবীর সঙ্গীত হাতের মুঠোয়। ছাত্র সংগঠনে এখন যারা সঙ্গীতচর্চা করে তাদের আর নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে বসে থাকলে চলবে না। তাদের বিশ্ব পরিম-লের সঙ্গীতের সঙ্গে নিজের সঙ্গীতকে মেলাতে হবে। নিজের সঙ্গীতকে বিশ্বমানের করতে হবে। একটি ছোট দেশকে বিশ্ব পরিম-লে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের গবেষণা, খেলা, সঙ্গীত, ছবি এগুলো অনেক বড় ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে এগুলো দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখে। আজ আমাদের দেশে, আমাদের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওই অর্থে কোন গবেষণা নেই, আন্তর্জাতিক মানের শিল্পকলা চর্চার সুযোগ নেই, খেলাধুলা চর্চার সুযোগ নেই। আজকের ছাত্রলীগের কাজ হবে সরকার যাতে এই ব্যবস্থাগুলো করে, তার জন্য ভূমিকা রাখা। ছাত্র প্রতিনিধিদের প্রতিটি বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বসতে হবে। তাদের বলতে হবে, দেশে মৌলিক গবেষণার বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতের জনসংখ্যার চাপের ভেতরও অর্থনীতিসহ দেশের সব দিক এগিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের গবেষণার বিকল্প নেই। আর এই মৌলিক গবেষণার জন্য শুধু সার্টিফিকেট প্রদানের কাজ করার বাইরে অন্তত কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যারা শুধুমাত্র পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পর্যায়ে বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষে গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। এ দাবিগুলো শুধু নয়, এগুলো প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব যাদের তাদের মধ্যে ছাত্র সংগঠন অন্যতম। বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, তাদের পূর্বসূরিরা একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। ছাত্রলীগের জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম সহজ হতো না। তাই এই স্বাধীন দেশটি যাতে গ্লোবাল ভিলেজের অংশ হয়, সে কাজটির দায়ও অন্য অনেকের থেকে ছাত্রলীগের বেশি। আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়তে হলে গবেষণা অনেক বেশি প্রয়োজন। নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ছাড়া যে ছোট এই দেশটিকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে না, এ সত্যটি ছাত্রলীগকে বুঝতে হবে। তাদের সে জন্য চিন্তা করতে হবে, কী তাদের প্রয়োজন। আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে কোনরূপ খাটো না করেই বলা যায়, এ কাজটি স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে অনেক বড় সংগ্রাম। এ সংগ্রামে যেমন দেশপ্রেম প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন দীর্ঘ সাধনা ও জ্ঞানের। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা ধান, মাছ, সবজি ফলানোর ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। তবে ২৫ কোটি মানুষ যখন হবে তখন এই পরিবর্তন, এই প্রযুক্তি কতটুকু কাজ দেবে! নিশ্চয়ই তখন আর যথেষ্ট থাকবে না। তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি দরকার। আজ যারা ছাত্রলীগ করছে তাদের তাই রাস্তায় মিছিল করার থেকে ওই বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা দরকার। আবার ওই বিজ্ঞানীদের স্কুলে স্কুলে নিয়ে গিয়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মনের ভেতরে আলো জ্বেলে দিয়ে আসা দরকার, যাতে তারা আগামী দিনের গবেষক হওয়ার চিন্তাটি এখনই মাথায় নেয়। পাশাপাশি, সারা পৃথিবী এসব ক্ষেত্রে কীভাবে কাজ করছে, সেগুলো সম্পর্কে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের জানতে হবে। নিজেকে, আপটুডেট রাখতে হবে এই মুহূর্তে বিশ্বে কী ঘটছে সে সম্পর্কে। তাহলেই কেবল নিজেকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেয়া যায়। আরেকটি বিষয় এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু আগামী পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এগুতে হবে, তাই তথ্যপ্রযুক্তির মূল ভাষাকে রপ্ত করা দরকার। এ মুহূর্তে স্বীকার করতে হবে তথ্যপ্রযুক্তির মূল ভাষা ইংরেজী। পৃথিবীতে এখন এই ভাষাটি রাজত্ব করছে। ভাষা একটি টেকনোলজি। তাই যে টেকনোলজিটি পৃথিবীতে রাজত্ব করছে, তাকে করায়ত্ত করতেই হবে। অন্য ভাষা শেখার সঙ্গে মাতৃভাষা জানার কোন বিরোধ নেই। বরং একটি সত্য মনে রাখতে হয়, পৃথিবীর সব ভাষার ভেতর কোথাও না কোথাও একটা মিল আছে, একটা ঐক্যতান আছে। যত বেশি ভাষা জানা যায় ততই নিজের ভাষাকে উন্নত করা যায়। ছাত্রলীগ স্কুলে স্কুলে যে কমিটি গড়ছে, সেখানে তাদের ভাষা শিক্ষা ক্লাব করতে হবে। যার ফলে স্কুল থেকেই ভাষাটি ওই ছাত্র বা ছাত্রীটি ভালভাবে রপ্ত করে আসতে পারে। আর ভাষা শেখার বয়স আড়াই বছর থেকে পঁচিশই; সব থেকে ভাল সময়। আজীবন শেখা যায়। তবে শিশু-কিশোর ও তরুণ মস্তিষ্ক অনেক দ্রুত শেখে। ভাষা শেখার পাশাপাশি ছাত্রলীগের কিশোর ও তরুণদের অবশ্যই মানবসভ্যতার পরিপূর্ণ ইতিহাস জানতে হবে। মানবসভ্যতার ইতিহাস না জানলে কখনই একটি বিজ্ঞানমনস্ক মনন তৈরি হয় না। বিজ্ঞানমনস্ক মনন ছাড়া আধুনিক বিশ্বে কোন আধুনিক রাষ্ট্র বা সমাজের সঠিক নেতৃত্ব দেয়া যায় না। বর্তমান ছাত্রলীগকে মনে রাখতে হবে, তারা ষাট, সত্তর, আশি এমনকি নব্বই দশকের ছাত্রলীগ নয়। তারা এখন এক গ্লোবাল ভিলেজের ছাত্রলীগ। তাদের গ্র্যাজুয়েশন এখন আর বাংলাদেশ মানের হলে হবে না, তাদের বিশ্ব মানে পৌঁছাতে হবে। আজ যারা স্কুলে পড়ছে, তারা যেন বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েশন বাংলাদেশে পায়, সে বিষয়টি ছাত্রলীগকেই ভাবতে হবে। এ জন্য কী করা প্রয়োজন সে কাজের জন্য তাদের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার কলসটির পানি যে নানা ধাক্কা লেগে লেগে পথে পথে পড়ে যাচ্ছে, খাবার পানি হিসেবে আজও পর্যন্ত ঘরে পৌঁছাতে পারল না- এ দায় এখন অনেকখানি হলেও আজকের ছাত্রলীগকে কাঁধে তুলে নিতে হবে। তাদের পূর্বসূরিরা একটি ভাল শিক্ষার জন্য আন্দোলন করে প্রাণ দিয়ে গেছেন। এখন ওই রক্তকে স্মরণ করে তাদের নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যে প্রাণ হবে উন্নত শিক্ষার মাধ্যমে। সে জন্য তাদের দেশ-বিদেশের শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবেÑ সবকিছুর ভেতর দিয়ে নিজস্ব একটি মত তৈরি করতে হবে। জাতির কাছে, সরকারের কাছে সে মত প্রকাশ করতে হবে। আর এ দেশের লোকসংখ্যা বিশ কোটি ছোঁয়ার আগেই যদি আধুনিক উন্নত শিক্ষা না দেয়া যায়, তাহলে এই মানুষগুলো কোথায় কাজ করবে? আজ যারা ছাত্রলীগ করছে, তারা নিশ্চয়ই চাইবে না যে, তারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে গিয়ে দেখুক, তার দেশের মানুষ এক সময়ে যে কাজগুলো ক্রীতদাস দিয়ে করানো হতো সেই কাজগুলোই এখন করছে! ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক ও বাহক। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি ভিক্ষুকের জাতির নেতা হতে চাই না। তাই আজ যারা ছাত্রলীগ করছে তাদের আবেগে, মননে বঙ্গবন্ধুর এই প্রতিজ্ঞাকে ধারণ করতে হবে। তার দেশের মানুষ পৃথিবীতে আর দেহ বিক্রি করবে না। তারা এমন দেশের নেতৃত্ব দেবে যে দেশের মানুষ গোটা পৃথিবীতে মেধা বিক্রি করবে। আগামী দিনের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশকে অবশ্যই মেধাভিত্তিক দেশ হতে হবে, শ্রমভিত্তিক নয়। একবিংশ শতাব্দীর ছাত্রলীগকে তাই হতে হবে মেধাভিত্তিক একটি সংগঠন। [email protected]
×