ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় সমাজসেবা দিবসের উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী

কর্মবিমুখ নয়, আমরা চাই জাতির কর্মশক্তি কাজে লাগাতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৩ জানুয়ারি ২০১৮

কর্মবিমুখ নয়, আমরা চাই জাতির কর্মশক্তি কাজে লাগাতে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কর্মবিমুখ জাতি গড়ে উঠুক সেটা আমরা চাই না। বরং যার যার কর্মক্ষমতা আছে, কর্মশক্তি আছে- সেটা যেন কাজে লাগাতে পারে। যার যা কর্মদক্ষতা ও কর্মশক্তি আছে তাকে কাজে লাগিয়েই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে চাই। আর কেউ যেন সম্পূর্ণভাবে ভাতার ওপর নির্ভরশীল না হয়। যে কর্মক্ষম, সে নিজে কাজ করে খাবে। কিন্তু সে যেন অভুক্ত না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখে অন্তত মাসে দশ কিলো চাল কিনতে পারে, সেই সমপরিমাণ আর তার সঙ্গে আরও বেশি টাকা আমরা দিচ্ছি। কর্মক্ষম হয়েও কেউ যেন কাজ করার স্পৃহা হারিয়ে না ফেলে সেজন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যের চেয়ে বেশি ভাতা না দেয়ার পক্ষেও মত দেন প্রধানমন্ত্রী। মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় সমাজসেবা দিবস-২০১৮’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ মত দেন। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া ভাতা একটি পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে বিভিন্ন সময়ে যারা সমালোচনা করেছেন তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে কিছু সুশীল সমাজ আছেন। তারা প্র্যাকটিক্যাল চিন্তাভাবনা করেন না। অনেকেই বলতে শুনেছি, যে ভাতা দিচ্ছে সেই ভাতায় কি সংসার চলে? সকল সংসার চালানোর দায়িত্ব তো সরকারের না। যার যার সংসার সে সে চালাবে। কেউ যেন অভুক্ত না থাকে, অবহেলিত না থাকে; সেটুকু দেখার দায়িত্ব সরকারের। কেউ অবহেলিত বা অভুক্ত থাকলে তার ব্যবস্থাটাই তো আমরা করে দিচ্ছি। বাকিটা তাকে কাজ করে খেতে হবে। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডাঃ মোঃ মোজাম্মেল হোসেন বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ জিল্লার রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী পরে অনুষ্ঠান স্থল থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আগারগাঁওয়ে সমাজসেবা অধিফতর চত্বরে চার দিনব্যাপী জাতীয় সমাজসেবা মেলার উদ্বোধন করেন এবং দেশবাসীকেও এ সময় প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। আলোচনা পর্ব শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, জাতীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের কূটনিতিকবৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং সমাজসেবা মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন উপকার ভোগী ও প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যে বিধবা-বয়স্ক ভাতা দেই তার একটি লক্ষ্য আছে। সেখানে আর একটি বিষয় আমরা লক্ষ্য রাখি তা হলো কেউ যেন সম্পূর্ণভাবে ভাতার উপর নির্ভরশীল না হয়। যে কর্মক্ষম সে কাজ করে খাবে। কিন্তু সে যেন কোনভাবেই অভুক্ত না থাকে সেদিকে আমরা লক্ষ্য রেখে অন্তত মাসে যেন ১০ কেজি চাল কিনতে পারে তার সমপরিমাণ এবং সঙ্গে কিছু বেশি টাকা দিচ্ছি। শুধু ভাতার ওপরই যেন তারা নির্ভরশীল না হয়, কাজ করে নিজের উপার্জন বাড়াতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এই ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা এর বেশি ভাতা দিতে চাই না। কারণ বেশি ভাতা পেলে আর কেউ কাজ করতে চাইবে না। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগকে জনগণের সেবক হিসেবে আখ্যায়িত করে আরও বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা দিয়েছিলাম শাসক নয়, সেবক হিসেবে কাজ করব। সেভাবেই কাজ করছি। তিনি বলেন, জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি যে সংবিধান দিয়েছেন সেই সংবিধানেই অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নের সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ যেন সরকার ও দেশের কাছ থেকে সমানভাবে সুযোগ পায় তিনি সেটা নিশ্চিত করে দিয়ে যান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে ৩ বছর সময় পেয়েছিলেন এবং একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে যখন তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপরই দেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির শুরু। এ সময় জাতির পিতার ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। তিনি বলেন, জাতির পিতা ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতিবন্ধিতা, বৈধব্য, মাতৃ-পিতৃহীন শিশু, প্রবীণ ব্যক্তিসহ অভাবগ্রস্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করেন। তিনি বিভিন্ন জেলায় স্থাপন করেছিলেন সরকারী শিশু সদন। তিনি ১৯৭৪ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচী প্রবর্তন করেন। যা আজও সারাদেশে ‘পল্লী সমাজসেবা (আরএসএস) কার্যক্রম’ নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৯ সালে তাঁর সমাজসেবা ভবন উদ্বোধনকালে প্রতি বছর ২ জানুয়ারি সমাজসেবা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়ার কথা স্মরণ করে বলেন, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমরা প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য প্রথমবারের মত বয়স্কভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা চালু করি। পরবর্তীতে সকল ভাতার পরিমাণ ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করি। তিনি বলেন, তাঁর সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমরা ৩৫ লাখ প্রবীণ ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫শ’ টাকা হারে বয়স্কভাতা দিচ্ছে। এ বছর ১২ লাখ ৬৫ হাজার নারীকে জনপ্রতি মাসিক ৫শ’ টাকা হারে বিধবা ভাতা দেয়া হচ্ছে। এ খাতে বছরে ৭ শত ৫৯ কোটি টাকা প্রদান করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধী ভাতা জনপ্রতি ৭শ’ টাকায় উন্নীত করে এ খাতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ থেকে ৮ লাখ ২৫ হাজার জনে উন্নীত করা হয়েছে। ৮০ হাজার শিক্ষার্থীকে দেয়া হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি। বর্তমানে ৮৬ হাজার ৪শ’ এতিম শিশুকে জনপ্রতি মাসিক এক হাজার টাকা হারে ক্যাপিটেশন গ্রান্ট দেয়া হচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে তাঁর সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। এ সময় তাঁর সরকারের আমলে করা বিভিন্ন আইন ও কৌশলপত্রের উল্লেখ করে বলেন, ‘লাইফ সাইকেল বেজ’ কর্মসূচীও হাতে নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সন্তান মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল পর্যায়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সাম্যতার ভিত্তিতে প্রদান সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার থেকে সামাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ যেন বঞ্চিত না হয় সে লক্ষ্যে সুবিধাভোগীদের জন্য ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম (এমআইএস)’ তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪৬ লাখ বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর তথ্য সন্নিবেশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সকল ভাতাভোগীরা যাতে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে ঘরে বসে ভাতা পেতে পারে সে লক্ষ্যে তাঁর সরকার ‘ক্যাশ ইনফর্মেশন ট্রান্সফার মর্ডানাইজেশন (সিটিএম) প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এর উপকারভোগীরা ভাতা পাবেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’, ‘বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’ এবং ‘চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন’ শীর্ষক তিনটি কার্যক্রম তাঁর সরকার বাস্তবায়ন করছে। সরকার প্রধান বলেন, উপজেলা পর্যায়ে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা দিতে ৪শ’ ১৯টি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে হাসাপাতালে সমাজসেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের উন্নয়ন ও কল্যাণে আমাদের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশব্যাপী ৮৫টি সরকারী শিশু পরিবারের কার্যক্রম চলছে। ৬ বিভাগে ৬টি ছোটমণি নিবাস (বেবি হোম), ১টি দিবাকালীন শিশুযতœ কেন্দ্র, ৩টি দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, আমরা ৬ বিভাগে ৬টি এতিম ও প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। ১২টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাধ্যমে পথশিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধিতা শণাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ ৪১ হাজার প্রতিবন্ধীকে শনাক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অনলাইনেও প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছি। এসব তথ্য সংরক্ষণের জন্য ‘ডিজ্যাবিলিটি ইনফর্মেশন সিস্টেম’ (ডিআইএস) সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করছি। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়নে তাঁর সরকার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সকল সমাজিক নিরাপত্তা সেবাকে ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ জন্য সমাজসেবা অধিদফতরকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ৬৪ জেলায় সোশ্যাল সার্ভিসেস কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পও একনেক এ অনুমোদন করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২২টি জেলায় অবিলম্বে এ কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু হবে। জাতির পিতাই আমাদের এই জায়গা দিয়ে যান যেটা আমরা এখন কাজে লাগাচ্ছি।
×