ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

রেকর্ড ইনিংস অসময়ে জ্বলে উঠলেন কুক

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৩ জানুয়ারি ২০১৮

রেকর্ড ইনিংস অসময়ে জ্বলে উঠলেন কুক

এ্যাশেজ ধরে রাখতে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের ভরসা ছিলেন বর্তমান অধিনায়ক জো রুট ও সাবেক অধিনায়ক এ্যালিস্টার কুক। টানা তিন হারে ট্রফি খোয়ানোর পথে দু-জনই ছিলেন ব্যর্থ। মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ড্র করে সফরকারীরা। সেখানেই জ্বলে ওঠেন কুক! প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ৩২৭-এর জবাবে অলআউট হওয়ার আগে ৪৯১ রান করে সফকারীরা। তখনও ২৪৪ রানে অপরাজিত সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক। ওপেনিংয়ে নেমে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং, অর্থাৎ টেস্ট ইতিহাসে ‘ক্যারিং দ্য ব্যাট থ্রু দ্য ইনিংস’-এর ক্ষেত্রে গড়েন নতুন রেকর্ড। শেষ জুটিতে সঙ্গী জেমস এ্যান্ডারসন (০) চতুর্থ দিন সকালে প্রতিপক্ষ পেসার প্যাট কামিন্সের করা প্রথম বলেই আউট হয়ে যান। ‘ক্যারিং দ্য ব্যাট’-এর ইতিহাসে এর আগের সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল নিউজিল্যান্ডের গ্লেন টার্নারের ২২৩, কিংস্টনে ১৯৭২ সালে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ৪৫ বছরের পুরনো সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়লেন কুক। এর মাঝেই মেলাবোর্নে কোন সফরকারী ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড গড়েছেন কুক। ছাড়িয়েছেন ১৯৮৪ তে করা ভিভ রিচার্ডসের ২০৮ রানকে। কোন ইংলিশ ব্যাটসম্যান সর্বশেষ এমন কীর্তি গড়েছিলেন ২০ বছর আগে। ১৯৯৭ সালে ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৪ রানে অপরাজিত ছিলেন আরেক সাবেক অধিনায়ক মাইক আথারটন। এ্যাশেজের ইতিহাসে তো এমন ঘটনা আরও আগের। ১৯৭৯ সালের পার্থ টেস্টে জিওফ্রে বয়কট এই রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু কুকের অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ে এ সবই পেছনে পড়েছে। শত বছরের পুরনো টেস্ট ইতিহাসে ‘ক্যারিং দ্য ব্যাট’ এর ঘটনা প্রায় হাতেগোনা। এ পর্যন্ত ২ হাজার ২৮৯টি টেস্টে মাত্র ৫২ বার এমন ঘটনা ঘটেছে। টেস্টে শুরুর দিনগুলোয় এমন ঘটনা ছিল একেবারেই বিরল। তবে গত কয়েক বছর ধরে মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। বিদায়ের পথে থাকা এই বছরে অবশ্য প্রথমবার এই কীর্তি অর্জন করলেন কুক। গত বছর অক্টোবরে শারজায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ক্যারিবীয় ওপেনার ক্রেইগ ব্রাফেটের ১৪২ রানের ইনিংসই ছিল ‘ক্যারিং দ্য ব্যাট’-এর সবশেষ ঘটনা। মেলবোর্নে সিরিজের চতুর্থ টেস্টের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে ব্যাট করে এই রেকর্ড গড়েন কুক। ম্যারাথন এই ইনিংস খেলার পথে ৪০৯ বল খেলেছেন এই বাঁ হাতি, উইকেটে ছিলেন ৬৩৪ মিনিট। আগের শেষ ১০ ইনিংসে কোন ফিফটির দেখা যে পাননি ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট রানের মালিক। চলতি এ্যাশেজে ছয় ইনিংসে মাত্র ৮৩ রান। টানা তিন হারে এ্যাশেজ খোয়ানোর পর ক্যারিয়ার নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। দল ও নিজের কঠিন সময়েই কুক খেললেন টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক ইনিংস। গত বছর আগস্টে এজবাস্টন টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। এরপর ১০ ইনিংসে নেই কোন ফিফটি, এ্যালিস্টার কুকের ১২ বছরের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে দীর্ঘ ফিফটি-খরা। এ্যাশেজের প্রথম তিন টেস্টের ছয় ইনিংস মিলিয়ে রান মাত্র ৮৩। এমন পাফর্মেন্সে নিজের কাছেই ‘বিব্রত’ হয়েছিলেন ইংলিশ ওপেনার। তবে মেলবোর্ন টেস্টে রেকর্ড গড়া ডাবল সেঞ্চুরির পর নিজেকে ‘গর্বিত’ মনে করছেন ৩৩ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান। ব্রিসবেন, এ্যাডিলেড, পার্থ- কোথাও উইকেটে থিতু হতে পারেননি কুক। উইকেটে এক ঘণ্টাও টিকতে পারেননি। সব মিলিয়ে শেষ ১০ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান ছিল ৩৭। সেই কুক মেলবোর্নে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উইকেটে কাটিয়ে দেন। ‘গত রাতে আমি কিছুটা নির্ভার অনুভব করছিলাম এবং আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। আজ আমি গর্বিত যে, নিজেকে ফিরে পেয়েছি, নিজেকে খেলার মধ্যে পেয়ে বড় ইনিংস খেলেছি।’ কুকের দিনে নিজেকে ফিরে পান স্টুয়ার্ট ব্রডও। নবম উইকেটে এই দু-জন গড়েন ঠিক ১০০ রানের জুটি। অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে ব্রড ৬৩ বলে করেন ৫৬। কুক শুনিয়েছেন সেই জুটির গল্প, ‘আমরা ব্রডকে তার লক্ষ্যে পেয়েছি এবং সে দারুণ খেলেছে। আমি সিঙ্গেল নিয়ে তাকে স্ট্রাইক দিয়েছি এবং সে চার হাঁকিয়ে তাদের (অস্ট্রেলিয়া) বিপর্যস্ত করেছে।’ সফরের প্রথম তিন টেস্টে অফ-ফর্মের কারণে নিজেকে কতটা অসহায় মনে হয়েছে, সেটাও জানিয়েছেন কুক, ‘এটা সেসব ১০ ঘণ্টার একটি, যেখানে আমি ফিরে দেখব, সবকিছু ঠিকমতো কাজ করেছে। পুরো সফরে ব্যাটিংয়ে ছন্দ ফিরে পেতে বেশ লড়াই করতে হয়েছে আমাকে। আমার পারফর্মেন্স ছিল কিছুটা বিব্রতকর। অবশেষে আজ আমি বড় ইনিংস পেলাম।’ এদিন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্রেট ব্রায়ান লারাকে টপকে টেস্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে উঠে গেছেন কুক। ইংলিশ ওপেনারের কণ্ঠে লারার জন্য সমবেদনা, ‘আমি ব্রায়ান লারার জন্য কিছুটা দুঃখিত। নিজের নাম ওপরে দেখাটা বিশেষ মুহূর্ত।’ অপরাজিক ২৪৪ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) সফরকারী কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংস এটিই। কুক ভেঙেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডসের ৩৩ বছরের রেকর্ড। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে মেলবোর্নে ভিভের খেলা ২০৮ রানের ইনিংস ছিল আগের রেকর্ড। ## অস্ট্রেলিয়ার বড় পাঁচটি ভেন্যুর দুটিতে সফরকারী কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড এখন কুকের। ২০১০-১১ এ্যাশেজে তিনি ব্রিসবেনে খেলেছিলেন অপরাজিত ২৩৫ রানের ইনিংস। যেটি গ্যাবায় সফরকারী কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংস। ## অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দুটি বা এর বেশি ডাবল সেঞ্চুরি করা মাত্র তৃতীয় সফরকারী ব্যাটসম্যান কুক। অন্য দুজন ওয়ালি হ্যামন্ড ও ব্রায়ান লারা। এর মধ্যে হ্যামন্ডের আছে তিনটি। ## কুকের অপরাজিত ২৪৪ রান এ্যাশেজ টেস্টে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানের পঞ্চম সর্বোচ্চ। আর সর্বোচ্চ লেন হাটনের ৩৬৪, ১৯৩৮ সালে ওভালে। ## কুক গত আগস্টে এজবাস্টন টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। এরপর ১০ ইনিংসে নেই কোন ফিফটি। মেলবোর্নে পঞ্চাশ ছুঁয়েই সেটিকে ডাবলে রূপ দিলেন। কুক ছাড়া এ বছর একের অধিক ডাবল সেঞ্চুরি আছে শুধু বিরাট কোহলির (৩টি)। ## ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় ক্রিজে থেকে ৪০৯ বলে ২৭টি চারে ২৪৪ রানে অপরাজিত আছেন কুক। যেটি গত সাত বছরে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সফরকারী কোনো ব্যাটসম্যানের দীর্ঘতম ইনিংস। ২০১০ সালে গ্যাবার কুকেরই অপরাজিত ২৩৫ ছিল আগের রেকর্ড। ## কুকের দেড়শ’ বা এর বেশি রানের ইনিংস হলো ১১টি, যা ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ। এমন ইনিংস ১০টি করে আছে ওয়ালি হ্যামন্ড, লেন হাটন ও কেভিন পিটারসেনের। চন্দরপল-লারাকে ছাড়িয়ে- কুক মেলবোর্নে ইনিংস শুরু করেছিলেন টেস্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় নবম স্থানে থেকে। ইনিংস শেষ না-হতেই ইংলিশ ওপেনার উঠে গেছেন ষষ্ঠ স্থানে! তিনি ছাড়িয়ে গেছেন মাহেলা জয়াবর্ধনে, শিবনারায়ণ চন্দরপল ও ব্রায়ান লারাকে। ক্যারিয়ারের পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে দিন শেষে অপরাজিত আছেন ২৪৪ রানে। ১৫১তম টেস্টে কুকের রান এখন ১১ হাজার ৯৫৬। ১৩১ টেস্টে ১১ হাজার ৯৫৩ রান করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বরপুত্র লারা। আরেক ক্যারিবীয় গ্রেট চন্দরপল ১৬৪ টেস্টে করেছেন ১১ হাজার ৮৬৭ রান। ১৪৯ টেস্টে ১১ হাজার ৮১৪ রান শ্রীলঙ্কান গ্রেট জয়াবর্ধনের। কুকের ওপরে আছেন কেবল কুমার সাঙ্গাকারা (১২৪০০), রাহুল দ্রাবিড় (১৩২৮৮), জ্যাক ক্যালিস (১৩২৮৯), রিকি পন্টিং (১৩৩৭৮) ও শচীন টেন্ডুলকর (১৫৯২১)। কুক রানে ফেরায় বৃহস্পতিবার সিডনিতে শুরু হতে যাওয়া এ্যাশেজের পঞ্চম ও শেষ টেস্টে আরও ভাল কিছুর আশা করতেই পারে ইংলিশরা!
×