ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

ফিরে দেখা ২০১৭ ॥ দেশের ক্রিকেটে সাফল্য ব্যর্থতার মিশেল

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৩ জানুয়ারি ২০১৮

ফিরে দেখা ২০১৭ ॥ দেশের ক্রিকেটে সাফল্য ব্যর্থতার মিশেল

আগের দুই বছরে পাওয়া টানা ঈর্ষণীয় সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। কিন্তু ২০১৭ সালটা একেবারে মন্দ কাটেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। বিশেষ করে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে প্রথমবার সেমিফাইনাল খেলা এবং শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে নিজেদের শততম টেস্ট ও ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট বিজয় অবিস্মরণীয় সাফল্য দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে এর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে লজ্জাজনক পরাজয় চরম হতাশার জন্মও দিয়েছে। আর বছরের শেষদিকে দেশের ক্রিকেটে সফলতম কোচ চান্দিকা হাতুরাসিংহের পদত্যাগ এবং টি২০ ক্রিকেট থেকে মাশরাফি বিন মর্তুজার অবসর গ্রহণ, সাকিব আল হাসানের টি২০ ফরমেটের পর টেস্টেও অধিনায়কত্ব পাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা। টেস্ট নেতৃত্ব হারিয়েছেন মুশফিকুর রহীম। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য সব ফরমেট মিলিয়ে বিশ্বসেরা টেস্ট ও টি২০ অলরাউন্ডার সাকিবই এগিয়ে অন্যদের চেয়ে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনে পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নাজমুল হাসান পাপনের থেকে যাওয়া ও পুরো পরিচালনা পর্ষদ প্রায় অপরিবর্তিত থাকাটা বড় ঘটনা। সব ফরমেটে সবমিলিয়ে সুখ-দুঃখের মিশ্র অনুভূতি ছিল এবার দেশের ক্রিকেটে। বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি এখন পর্যন্ত টিকে আছেন। তিনি এবার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরে অধিনায়ক হিসেবে শিরোপাও জিতিয়েছেন রংপুর রাইডার্সকে। তাকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল জাতীয় দল এই এক বছর কেমন পারফর্ম করল? জবাবে মাশরাফি ভাল-মন্দের বছরের কথাই বললেন। জানালেন, ‘আমাদের সবকিছু আমার কাছে মনে হয় ভাল-খারাপ দুটাই ছিল। কিছু কিছু ভাল পারফর্মেন্স ছিল। আবার শুরু এবং শেষটাও ভাল হয়নি। যদি বলেন যে নিউজিল্যান্ড দিয়ে শুরু হয়েছিল, ওটা আমরা ভাল করিনি। টেস্ট ম্যাচে ভাল করেছিলাম। আবার সাউথ আফ্রিকায় শেষ হলো, এটা সবাই জানে ভাল হয়নি। কিছু পারফর্মেন্স হয়তোবা আমরা ভাল করেছি। আমার কাছে মনে হয় ভাল খারাপ দুইটা দিয়েই ছিল।’ আসলেই তাই। ২০১৭ সাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ভাল-মন্দের বছরই গেছে। ক্রিকেট বিশ্ব এক নতুন বাংলাদেশকে দেখেছিল ২০১৫ সালে। সে বছর অসাধারণ কিছু সাফল্য দিয়ে সারা দুনিয়াকে রীতিমতো অবাক করে দিয়েছিল লাল-সবুজের দল। সে ধারাবাহিকতা ছিল ২০১৬ সালেও। ২০১৭ সাল শেষ হয়ে গেছে। সোমবার শুরু হয়েছে নতুন বছর। নতুন পথচলাও শুরু হয়ে যাবে সফরকারী শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। তবে এর আগেই দীর্ঘ সময় পর দেশের মাটিতে কোন ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ দিয়েই এবার পরীক্ষার শুরু হবে বাংলাদেশ দলের। ২০১৭ সালে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে হিসাব কষার পালাও শেষ হচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশ কয়েকটি সিরিজ ও টুর্নামেন্ট খেলেছিল। তবে শেষ দিকের কিছু ব্যর্থতা বাদ দিলে অর্জনটাই বেশি মাশরাফি-সাকিবদের। নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলা দিয়ে বছর শুরু। হার হয়েছে সফরজুড়ে। শেষ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর দিয়ে। সেখানেও একই অবস্থা। মন্দ বলতে এ দুই সিরিজে বাংলাদেশের পারফর্ম। আর বছরের বাকি সময়টুকুতে সাফল্যেই কেটেছে বাংলাদেশের। সেই সাফল্যগুলোই ভাল দিক ফুটিয়ে তুলছে। টেস্ট সাফল্যের কথাই ধরা যাক, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। তার মধ্যে দুটি টেস্ট জিতেছে, হেরেছে সাতটি ম্যাচ। অঙ্কের হিসাবে এই সাফল্য কমই। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য দুটি টেস্ট জয় ছিল অনেক বড় সাফল্য। বিশেষ করে গত মার্চে কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঐতিহাসিক শততম টেস্টে চার উইকেটে জয় ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বিশাল অর্জন। এর পর আগস্টে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয় আরেকটি ইতিহাস রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। দুর্দান্ত প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়াকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ২০ রানে হারিয়েছিল মুশফিক বাহিনী, যা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ছিল দারুণ একটি মাইলফলক। টেস্টে বাংলাদেশের এ দুটি সাফল্য অন্য সব ব্যর্থতাকে একেবারেই ঢেকে দিয়েছে। তবে সাফল্য না হলেও টেস্টে বাংলাদেশের আরেকটি অর্জন ছিল। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ পর কোন সিরিজ খেলতে ভারত সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ভারতে হায়দরাবাদে একমাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল অবশ্য ২০৮ রানে হেরেছিল। ওয়ানডেতেও বাংলাদেশের ঝুলিতে ছিল দারুণ কিছু অর্জন। বছরের প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ শুরু করেছিল জয় দিয়ে। এ বছর মার্চে ডাম্বুলায় শ্রীলঙ্কাকে ৯০ রানে হারিয়েছিল মাশরাফিরা। সে ধারাবাহিকতা বছরজুড়ে না থাকলেও ১৪টি ওয়ানডে খেলে চারটিতে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। অবশ্য এর মধ্যে তিনটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছিল। তবে এবছর ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল, কয়েকটি পরাশক্তি দলকে টপকে মে-জুনে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠা। এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা সাফল্য বললে ভুল বলা হবে না। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের মত দলকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে পেছনে ফেলে সেমিফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। তার আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের দুটি ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয় পেয়েছিল আট উইকেটে এবং সিরিজের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ উইকেটে জেতে মাশরাফির দল। এই সফল্য চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বেশ কাজে আসে। তবে বছরের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে একেবারেই নাকাল ছিল বাংলাদেশ দল। তিনটি ম্যাচ খেলে তিনটিতেই হেরেছিল, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুনতে হয় ক্রিকেটারদের। টেস্ট এবং টি২০ সিরিজেও শতভাগ ব্যর্থতার গ্লানি যোগ হয়। এই সফরে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবার তিন ফরমেটে তিন অধিনায়ক ছিলেন। টেস্টে মুশফিক, ওয়ানডেতে মাশরাফি এবং টি২০ ক্রিকেটে সাকিব নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে কেউ সাফল্য আনতে পারেননি। এই সফরে ভরাডুবি, সমালোচনা ও বিতর্কে শেষ পর্যন্ত সফলতম কোচ হাতুরাসিংহে পদত্যাগ করেন। বছরের শেষ ভাগে এসে কোচ শূন্য হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ইতোমধ্যেই পরবর্তী কোচ নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলেও বছর শেষে জানা যায়নি কে কোচ হচ্ছেন। বিপিএল টি২০ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সেই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ব্যর্থতাকে ঘিরেই টেস্ট দলের নেতৃত্ব মুশফিকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে সাকিবের কাঁধে। আর তামিম ইকবালকে সরিয়ে সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে। টি২০তে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ৭টি ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে ছয়টিতেই হেরেছিল, আর জয় পায় মাত্র একটি ম্যাচে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গত এপ্রিলে সে ম্যাচে ছয় উইকেটে জিতেছিল মাশরাফির দল। এই সিরিজের পরই টি২০ থেকে অবসরে যান অধিনায়ক মাশরাফি। মাশরাফির অবসর এ বছর বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম আলোচিত ঘটনা। বছরজুড়ে আরও সাফল্য হয়ত মিলত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দেশের মাটিতে এ বছর একটি ওয়ানডেও খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। তা যদি খেলত, তাহলে হয়ত আরও সাফল্য যোগ হতো। তবে শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারানো এবং চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে খেলাই বাংলাদেশের পালে বছরটিতে সাফল্যের হাওয়া দিচ্ছে। বাকি ব্যর্থতাগুলো মন্দ আভাস দিলেও, মন্দ আর ভালর মধ্যেই শেষ হচ্ছে দেশের ক্রিকেটের বছর। ২০১৭ সালেও সাকিব তার অলরাউন্ড নৈপুণ্য দিয়ে ব্যক্তিগত সাফল্যে উজ্জ্বলই হয়ে আছেন সবার চেয়ে। টেস্টে এ বছর বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন অবশ্য মুশফিক (৭৬৬ রান)। পরের অবস্থানেই আছেন সাকিব (৬৬৫ রান)। ওয়ানডেতে এ বছর বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন তামিম ইকবাল (৬৪৬ রান)। তারপরে আছেন মুশফিক (৪৫৮ রান)। তৃতীয় স্থানে আছেন সাকিব (৪৩০ রান)। টি২০ তে এ বছর বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন সৌম্য সরকার (২৩৫ রান), সাকিব আছেন চার নম্বরে (১২০ রান)। বল হাতে ওয়ানডেতে এ বছর দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান (১৪ উইকেট)। সাকিব আছেন ছয় নম্বরে (৬ উইকেট)। এদিক থেকে সাকিব পেছনে। আর কোন স্থান কী আছে, সাকিবকে পেছনে ফেলে? সাকিব আর সবদিকেই উজ্জ্বল। দলকে জেতানোতে তো সাকিবই এ বছর সেরা। সাকিবের নৈপুণ্য ছাড়া জয় যেন এ বছর কল্পনাই করা যেত না! এ বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে বছর শুরু হয় বাংলাদেশের। সাকিব ২১৭ রানের একটি ইনিংস খেলেন। যা কিনা দেশের হয়ে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস হয়ে গেছে। ভারতের বিপক্ষে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ভারতের মাটিতে টেস্ট খেলে বাংলাদেশ। এক ইনিংসে ৮২ রান করেন সাকিব। দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখান। কলম্বোয় দেশের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে যে হারায় বাংলাদেশ, সেই ম্যাচের এক ইনিংসে ১১৬ রান করেন সাকিব। ইনিংসটি না খেললে কী বাংলাদেশের জেতা সম্ভব ছিল! এ তো গেল টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং। বোলিংটা তো আরও দুর্দান্ত। টেস্টে এ বছর সাকিবই সবচেয়ে বেশি ২৯ উইকেট নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জেতা টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৬ উইকেট নিয়েছেন। আবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০ উইকেট নিয়ে তো ম্যাচ সেরাই হয়েছেন। সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্য ছাড়া অজিদের হারানো খুবই কঠিন ছিল। টেস্টে এ বছর ২টি সেঞ্চুরিসহ ৪৭.৫০ গড়ে ৬৬৫ রানসহ ২৯ উইকেট নিয়েছেন সাকিব। টেস্টে বিশ্বসেরা অলরাউন্ড এখনও আছেন সাকিবই। তবে বছরের শেষ সিরিজ (দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ) না খেলা, বিপিএলে ফাইনালে উঠে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা, সাবেক কোচ হাতুরাসিংহের সমালোচনার তীর হওয়া ছাড়া আর কোন ব্যর্থতাই বছরটিতে সাকিবকে ছুঁতে পারেনি। শুধু সাফল্যই মিলেছে। ব্যক্তিগত সাফল্যে তাই ২০১৭ সালে উজ্জ্বলই সাকিব!
×