ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গণতন্ত্র ॥ বিহাইন্ড দ্য স্ক্রিন -মিলু শামস

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৩ জানুয়ারি ২০১৮

গণতন্ত্র ॥ বিহাইন্ড দ্য স্ক্রিন -মিলু শামস

দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা দু’হাজার আট-এ বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ গণতন্ত্রের নামে এখনও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় বাস করে। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র বা বহুদলীয় গণতন্ত্রের ঢাক পেটানো হয় এই জনগণের নামে। তাদের নামে নির্বাচন হয়। সংসদ বসে। উন্নয়নের নানা পরিসংখ্যানের প্রজেকশন হয়। অথচ প্রাকৃতিক যে সম্পদের মালিক জনগণ তা যখন বিভিন্ন চুক্তির নামে বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে চলে যায় জনগণ তখন কিছুই টের পায় না। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে এখন সংসদের তেমন কোন ভূমিকা নেই। এ দায়িত্ব চলে গেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব প্রক্রিয়ার কেন্দ্রের কর্পোরেট পুঁজির হাতে। তাদের দরকার এমন শাসন ব্যবস্থা যা প্রান্তের দেশগুলোর পুঁজি ও উদ্বৃত্তের প্রবাহ প্রাপ্তি নিরাপদ রাখতে পারে, জনগণের অসন্তোষ বা ক্রোধ থেকে ব্যবস্থাটি রক্ষা করে চড়া মুনাফা ফেরত নিশ্চিত করতে পারে। তাই তাদের জন্য সহায়ক গণতন্ত্রকেই তারা এসব দেশে চালান করে। তা নিয়ে স্থানীয় গণতন্ত্র-কারবারিদের কাড়াকাড়ি। তাদের পেছনে অবস্থান নেয় সুশীল সমাজ নামের মতাদর্শজীবীরা। সামরিক-বেসামরিক গোপন, উন্মুক্ত নানান চুক্তি এই খুশি রাখার জন্য পাঠানো উপঢৌকন। যার কাছ থেকে যত বেশি উপঢৌকন পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় গণতন্ত্রের বলটি তার কোর্টেই যায়। এ হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশের গণতন্ত্রের পেছনের সরল অঙ্ক। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ। স্বাভাবিক কারণেই বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজির এ ভূখ- নিয়ে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে সেখানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সংলাপ, অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে উচ্চারিত এসব শব্দ আসলেই কী কোন তাৎপর্য বহন করে? অথবা এসব শব্দের সঙ্গে দেশের জনগণের আদৌ কী কোন সম্পর্ক আছে? এ নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে তর্কের তুফান তোলা মানে আসল সমস্যা আড়াল রাখার চেষ্টা। বরং সজাগ থাকা উচিত বহুজাতিক কর্পোরেশনের গতিবিধির ওপর। তাদের হাত অনেকখানিই প্রসারিত হয়েছে। এখন তা থেকে সম্পদ তুলে নেয়ার পালা। যে সম্পদের মালিক গণতন্ত্রের কারবারিরা নয়, দেশের মানুষ। নানা ধরনের কূটকৌশলে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে কি কৌশলে ওই প্রসারিত হাত জনগণের সম্পদ তুলে নেবে সেদিকে খেয়াল রাখা সবচেয়ে জরুরী। নাইজিরিয়ার কবি কেন্ সারো উইয়া কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যেমন মানুষকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে, কর্পোরেট পুঁজি তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট ও ভূমি এবং পরিবেশ ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে মানুষ হত্যা করে।’ একে তিনি ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং এ নিয়ে কথা বলা, লেখালেখি করায় তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল নাইজিরিয়ার সামরিক শাসকের হাতে। যে সরকারের পেছনে তখন অন্যতম খুঁটি ছিল ডাচ ও মার্কিন দুই বিখ্যাত কোম্পানি। নাইজিরিয়ান লেখক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো তার ‘আপসাইড ডাউন’ বইয়ে ওই দুই কোম্পানি সম্পর্কে বলেছেন, তেল সম্পদ লুট করতে গিয়ে কোম্পানি দুটি নাইজিরিয়ার অগোনি সম্প্রদায়ের ভূমি ও নদী-নালাসহ তাদের পুরো পরিবেশই ধ্বংস করে ফেলেছে। অথচ এদের কাছ থেকেই আমরা পরিবেশ রক্ষার সবক নেই। তৃতীয় বিশ্বের পরিবেশ রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকার ফান্ড আসে। পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখার জন্য পদক আসে। সামরিক শাসনের বদলে কর্পোরেট প্রভুরা এখন গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণ বেশি পছন্দ করছে। সুতরাং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বহুমাত্রিক খেলাধুলা পৃথিবীর নানা দেশেই চলছে। বাংলাদেশে নির্বাচনকে উপলক্ষ করে সে খেলা ক্রমশ জমে উঠবে নিঃসন্দেহে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী পাঁচ কর্পোরেশন- জেনারেল মোটরস, ওয়ালমার্ট, এক্সন-মবিল, ফোর্ড এবং ডাইমলার-ক্রাইসলারের সামগ্রিক বিক্রি পৃথিবীর এক শ’ বিরাশিটি দেশের জিডিপির চেয়ে বেশি। আর মাইক্রোসফট, কোকা-কোলা এবং আইবিএম কোম্পানির বার্ষিক বিক্রি তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সম্মিলিত জিডিপি ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং এদের ক্ষমতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। এদের কাছে অন্য সব কিছুর মতো গণতন্ত্রও একটি পণ্য। এ পণ্য বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী প্রান্তের দেশগুলোয়। বিশেষ করে যেসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সেসব দেশের গণতন্ত্র বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে নানা আইন ও চুক্তিতে জড়িয়ে নিজেদের সম্পদ তাদের হাতে নামমাত্র মূল্যে তুলে দেয়। বৃহৎ পুঁজিকে সার্ভিস দিতে এসব দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত সরবরাহ, আর্থিক লেনদেনের আধুনিকায়ন ইত্যাদি অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোযোগী হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে আছে এরা। মার্কিন গবেষক হাওয়ার্ড জিমের দেয়া তথ্য মতে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের শতকরা ষাটভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলো নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। গত শতকের আশির দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বাজার সম্প্রসারণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক পুঁজির চরিত্র বদলের সঙ্গে এরপর ধীরে ধীরে আমদানি হয় গণতন্ত্র। কেননা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে লুটপাট ও দখলদারিত্ব ভদ্রস্থ গ্রহণযোগ্যতা পায়। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও এ চিত্র দেখি।
×