ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাড়ে ৩৫ কোটি বই

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৩ জানুয়ারি ২০১৮

সাড়ে ৩৫ কোটি বই

শিক্ষাবছর তথা নতুন বছরের একেবারে প্রথম দিনেই একজন শিশু শিক্ষার্থীর নতুন বই পাওয়া প্রায় হাতে চাঁদ পাওয়া আনন্দ-উৎসবের মতো। অনাবিল এই আনন্দের কোন তুলনাই হয় না। একজন কৃষকের কাছে যেমন পাকা ফসল ভরা ধানের মাঠ; একজন শিশু শিক্ষার্থীর হাতে তেমনি এক ঝাঁক নতুন ঝকঝকে তকতকে বই। দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বছরের শুরুতেই পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়ার ব্যাপারটি অন্য অনেক কিছুর মতোই সরকারের একটি অন্যতম বড় সাফল্য। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে চার কোটি স্কুল শিক্ষার্থীর হাতে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যবই প্রতিবছর সময় মতো গ্রন্থনা, মুদ্রণ ও সরবরাহের ব্যাপারটি একেবারে বিনামূল্যে, রীতিমতো এক বিরাট ব্যাপার। হৈ হৈ- রৈ রৈ কান্ড-কারখানা। রাজধানী থেকে শুরু করে এই আনন্দ-উৎসব চলে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে একেবারে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত। এই দৃশ্য দেখলে যে কারও দুচোখ জুড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। বিশ্বের অন্য কোথাও বা অন্য কোন দেশে কেবল পাঠ্যপুস্তক বিতরণ নিয়ে এমনটি আনন্দ-হুল্লোড় হয় কিনা, আমরা জানি না। আরও একটি ইতিবাচক সংবাদ হলো, গত বছরের চেয়ে এবার শিক্ষার্থী বেড়েছে ১০ লাখ ৭০ হাজার ৯৬৬ জন। ফলে বেশি ছাপতে হয়েছে ৭১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৯টি বই। নিকট অতীতে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণসহ সিলেবাস প্রণয়ন ও বানানে কিছু ভুল ভ্রান্তি থাকলেও এবার তেমনটি ঘটবে না বলেই প্রত্যাশা। তবে ছবি ছাপা ও বাঁধাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ইতোমধ্যে। এত বিপুল আনন্দ উৎসবের মধ্যেও শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণসহ ১১ দফা দাবিতে এমপিও এবং নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলন-অনশন এতে নিঃসন্দেহে যোগ করেছে একটি বিষণ্ন বার্তা। আশা করি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে খুব শীঘ্রই এর অবসান হবে। বর্তমানে প্রায় শিশুস্তর থেকেই একজন শিক্ষার্থীর পিঠে চাপিয়ে দেয়া হয় এক ব্যাগ বইখাতার বোঝা। ভেবেও দেখা হয় না যে, শিশুটি সেই ওজন আদৌ বহন করতে পারবে কিনা। সেসব পাঠ্য বইয়ের একটি অংশ আবার সৃজনশীল। শিশু পঠিত অংশ থেকে কী শিখল, তারই পরীক্ষা। বাস্তবতা হলো সৃজনশীল তো শিক্ষকই বোঝেন না। শিশু শিখবে কী? সম্প্রতি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের অধিকাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বোঝেন না। অতঃপর শিশুর নাকি শিক্ষকদের বোঝার জন্য অচিরেই বাজারে এলো গাদা গাদা গাইড বই, নোট বই, ধারণাপত্র ইত্যাদি। দামও অগ্নিমূল্য। সৃজনশীল বলে কথা! এ যেন সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষকমন্ডলী, অভিভাবকরা সর্বোপরি কোটি কোটি শিক্ষার্থীর কানামাছি ভোঁ-ভোঁ খেলা। মাঝখানে উচ্চ আদালত যেন রেফারির ভূমিকায়। একদিকে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নোট ও গাইড বইয়ের অবৈধ রমরমা ব্যবসা; অন্যদিকে আদালতের খড়গের দোহাই দিয়ে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের গাইড বই বাজেয়াপ্তকরণের লুকোচুরি খেলা; মাঝখানে অভিভাবকদের ফতুর করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রায় মরণদশা শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে টেনে নামিয়েছে খাদের কিনারে। ইদানীং আবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগও উঠেছে। এহেন শোচনীয় অবস্থা থেকে শিক্ষাকে টেনে তুলতে হলে সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সর্বশক্তি নিয়ে নামতে হবে যাবতীয় নোট ও গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে। নিষিদ্ধ করতে হবে কোচিং ব্যবসা। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষেই শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদানে যত্নবান হতে হবে।
×