ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পিকেএসএফের ‘সমৃদ্ধি কর্মসূচীর’ আওতায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন

ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে সমৃদ্ধির পথে

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২ জানুয়ারি ২০১৮

ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে সমৃদ্ধির পথে

আনোয়ার রোজেন ॥ আলিয়া বেগমের (৫২) চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। ঠোঁট লাল করে পান চিবুচ্ছেন আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রশ্নের। স্বামী যখন ভিক্ষা করতো আপনার সংসার চলতো কীভাবে- এমন প্রশ্নে এক মুহূর্তের জন্য মুখটা মলিন হলো আলিয়ার। অবশ্য পরক্ষণেই সাবলীল। উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক টানে বললেন, চোখের ব্যয়বহুল চিকিৎসা করিয়ে স্বামী মোঃ আবু বকর ততদিনে নিঃস্ব। তারপরও চোখ ভাল হয়নি, প্রায় দৃষ্টিহীন। চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় তিন জনেরও একই সমস্যা। বাবার মতো ক্ষীণদৃষ্টি তাদের। বাধ্য হয়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে তুলে নেন আবু বকর। ১৫ বছর ভিক্ষা করেছেন। নিদারুণ কষ্টের ওইসব দিনের কথা চাইলেও ভুলতে পারেন না আলিয়া। এবার পাশে দাঁড়ানো আবু বকর বলেন, কয়েক বছর হলো সংসারের মোড় ঘুরেছে। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করেছেন সমৃদ্ধির পথে। জীবনের নতুন এই পথ চলায় তাদের সঙ্গী হয়েছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। জাতীয় এই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের ‘সমৃদ্ধি কর্মসূচী’ মুছে দিয়েছে আবু বকরের ভিক্ষুক পরিচিতি। জয়পুরহাট সদর উপজেলার ধলাহার ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের শেখপাড়ার আবু বকর এখন ‘উদ্যমী সদস্য’। সম্প্রতি সরেজমিন জয়পুরহাট ঘুরে এ প্রতিবেদক আবু বকরের বদলে যাওয়া জীবনের চালচিত্র দেখেছেন। দেখা মিলেছে ষাটোর্ধ নারী ‘উদ্যমী সদস্য’ সুফিয়া বেগমের। তিনিও এক সময় ভিক্ষা করতেন। ধলাহার ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামের নিত্তিপাড়ায় এখন তিনি ‘সমৃদ্ধ বাড়ির’ মালিক। তারা দুজনই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা অদম্য মানুষের দৃষ্টান্ত। নিজেদের আঙিনায় দাঁড়িয়ে শোনালেন দারিদ্র্য জয়ের কাহিনী.. আজন্ম অভাবী সুফিয়া এখন স্বাবলম্বী ॥ দরিদ্র পরিবারে জন্ম সুফিয়ার। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সুফিয়া তৃতীয়। আট সদস্যের পরিবারে দিনমজুর বাবার নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা দেখেই বড় হয়েছেন সুফিয়া। অভাবের সংসারে ঠিক মত খাবারও জুটত না। পড়াশোনায় হাতে খড়ির বয়সে করেছেন অন্যের বাড়ির বাসন মাজার কাজ। এরপর মাত্র ১২ বছর বয়সে নিত্তিপাড়ার মকবুল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় সুফিয়ার। সংসার বদল হলেও অভাব বদলায় না। ভ্যানচালক মকবুলের সংসারে এসে অভাবের সঙ্গে জুটে শ্বশুরবাড়ির নানা রকম অত্যাচার। অসহায় সুফিয়া বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামীকে নিয়ে আশ্রয় নেন নিত্তিপাড়া গুচ্ছগ্রামে। এখানেই জন্ম হয় একমাত্র সন্তান সখিনা বেগমের। অসুখ-বিসুখে ভুগতে থাকা মকবুল ২০০২ সালে পঙ্গু হয়ে আশ্রয় নেন বিছানায়। সংসারে আয় করার মত আর কেউ নেই। তাই অভাব আরও জেঁকে বসে মেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন সুফিয়া। বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির কোন সহযোগিতা না পেয়ে সুফিয়া হাতে তুলে নেন ভিক্ষার ঝুলি। সারাদিন ভিক্ষে করে মেয়ে ও অসুস্থ স্বামীর মুখে কোন রকমে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু স্বামীর চিকিৎসার করার মত অবস্থা ছিল না। সাত বছর বিছানায় পড়ে থেকে এক রকম বিনা চিকিৎসায় মকবুল মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়ে সখিনাকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েন। ‘অভাবের উত্তরাধিকার’ সূত্রে সখিনার বিয়ে হয় গাইবান্ধা জেলার কামদিয়া এলাকার দিনমজুর আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। মেয়ের জামাইকে রেখে দেন নিজ বাড়িতেই। দুই নাতি ও এক নাতনিসহ ছয় সদস্যের পরিবারের অভাব শুধু বেড়েই চলে। এই অবস্থায় পিকেএসএফের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সমৃদ্ধি কর্মসূচী ধলাহার ইউনিয়নে জরিপের মাধ্যমে ভিক্ষুকদের একটি তালিকা করে। সিদ্ধান্ত হয় প্রত্যেক ভিক্ষুক পরিবারের আয় বাড়ানোর জন্য ১ লাখ অনুদান হিসেবে দেয়া হবে। কর্মসূচীর আওতায় পিকেএসএফের সহযোগি সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেয়ার মৌখিক ও লিখিত চুক্তির মাধ্যমে সুফিয়াকে দুইটি গাভী ও একটি বাছুর কিনে দেয়। আর এর মাধ্যমে নিজেকে আয় বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করে সুফিয়ার ভিক্ষাবৃত্তির অবসান ঘটে। তিনি এখন স্বাবলম্বী। সুফিয়া জানান, বর্তমানে দুইটি গাভী থেকে প্রতিদিন পাঁচম কেজি দুধ হয়। ওই দুধ বিক্রি করে মাসিক আয় আসে পাঁচ হাজার ২৫০ টাকা। এছাড়াও মুরগি, কবুতর, বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ থেকে আসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ভিক্ষুক হয়ে যাওয়া সুফিয়ার মাসিক আয় এখন ১০ হাজার টাকারও বেশি! বাড়ির সামনে গাঁদা ফুলের এক চিলতে বাগান। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে সুখের নাগাল পাওয়া সুফিয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি। ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া নাতি সাগরকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তো ইশকুলে যাইবার পারি নাই। নাতিটা ইশকুলে যায়। সন্ধ্যার সময় আমার পাশে বইসা জোরে জোরে পড়ে। আমার খুব খুশি লাগে। সুখের মুখ দেখেছেন প্রায় দৃষ্টিহীন আবু বকর ॥ একই ইউনিয়নের শেখপাড়ার আবু বকরও দেখেছেন সুখের মুখ। তারও দিন বদলেছে। প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা আবু বকরও পুনর্বাসন কর্মসূচীর আওতায় ১ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছিলেন। তার বাড়ি ঘুরে দেখা গেল, রাজহাঁস, মুরগি ও কবুতরের সুখের কোলাহল। বাড়ি একপাশে আছে প্রজনন সেন্টার। প্রতিবেশীদের তুলনায় তার আয় কম নয়। কালো ষাঁড়ের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে আবু বকর বলেন, ২০১৫ সালে স্যারেরা আমাকে টাকা দেন। আমাকে প্রজনন সেন্টার দিতে সহায়তা করেন। দুইটা ষাঁড় ও একটি পাঠা দিয়ে প্রজনন কাজ করা হয়। ছাগল প্রজননে একশ টাকা ও গরুর প্রজননে করতে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা নিই। চিনা হাঁস ও রাজহাঁস পালন করি আমি। আমি এখন ভাল আছি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আবু বকরের দুইটা ষাঁড়ের দাম এখন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া হাঁস-মুরগি ও কবুতর আছে প্রায় ১৫ হাজার টাকার। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আবু বকর ও সুফিয়া বেওয়ার এই উদ্যম অনুসরণীয় বলে মনে করেন ১নং ধলাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের সহায়তার জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে বিভিন্ন ভাতা ও কর্মসূচী সরকারের রয়েছে। এর পাশাপাশি পিকেএসএফ এবং জাকস ফাউন্ডেশনের মত সংস্থা এগিয়ে আসলে আরও বেশি সংখ্যক দরিদ্র মানুষ উপকৃত হবেন। জয়পুরহাটে পিকেএসএফের ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় এনজিও জাকস ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরে এসে যারা নিজেদের উদ্যমে টেকসই কর্মসংস্থান ও আয়ের ব্যবস্থা করেন, আমরা তাদের ‘উদ্যমী সদস্য’ বলি। ধলাহার ইউনিয়নে উদ্যমী সদস্য সংখ্যা ১০ জন। এদের কেউই এখন আর ভিক্ষা করেন না। এ অবস্থা ধরে রাখা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। তাদের এই উন্নতি যাতে টেকসই হয়, সে জন্য আমাদের মনিটরিং টিম সক্রিয় রয়েছে। পিকেএসএফ-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) ড. জসিম উদ্দিনও পুনর্বাসিত সুফিয়ার বাড়ি ও অর্থনৈতিক কর্মকা- সরেজমিন দেখেছেন। জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত তিন বছরে সুফিয়ার মতো প্রায় ৮৫০ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। যারা এখন আর ভিক্ষা করছেন না। প্রত্যেক ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য পিকেএসএফ থেকে সর্বমোট ১ লাখ টাকার অনুদান বরাদ্দ দেয়া হয়। সার্বিক বিষয়ে পিকেএসএফ সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক মূল স্রোতে আনার জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। এজন্য দরকার বহুমাত্রিক সমাধান। এর অংশ হিসেবে পিকেএসএফ ‘সমৃদ্ধি কর্মসূচী’ প্রবর্তন করেছে। কর্মসূচীর একটি কার্যক্রম হলো ভিক্ষুকদের স্বাবলম্বী করা। এই উদ্যোগে এখন পর্যন্ত সফল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
×