ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বের আলোচিত তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২ জানুয়ারি ২০১৮

বিশ্বের আলোচিত তারুণ্য

তারুণ্য পা দিয়েছে নতুন এক বছরে। গত বছরে তারুণ্য ছিল তার অপ্রতিরুদ্ধ রূপে। এর মাঝে তারুণ্য সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে নতুন একটি সকল উপহার দেয়ার জন্য। সেই সব তারুণ্য নিয়ে আমাদের এই আয়োজন। লিখেছেন- সুমন্ত গুপ্ত গুরমেহার কাউর গুরমেহার কাউর হচ্ছেন কারগিল যুদ্ধে নিহত এক ভারতীয় সেনার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে। তার এক মন্তব্যকে ঘিরে উত্তাল হয়েছিল সারা ভারত। গুরমেহারের পক্ষে-বিপক্ষে পুরো ভারত কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এ বিতর্কে শামিল হয়েছেন ক্ষমতাসীন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে ভারতের প্রখ্যাত খেলোয়াড় এমনকি বলিউড অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পর্যন্ত। এই গুরমেহার কাউর এবারের টাইম ম্যাগাজিনে প্রভাবশালী তারুণ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। তিনি অর্জন করেছেন ‘ফ্রি স্পিচ ওয়ারিয়র’-এর খেতাব। শুরুর কথা বলতে গেলে ফেসবুকে এবিভিপির সমালোচনা করেছিলেন গুরমেহার। বলেছেন, তাদের দেয়া জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তিনি মানেন না। কিন্তু এর পর থেকেই তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। দিল্লীর রামযশ কলেজে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্রনেতা উমর খালিদের অনুষ্ঠান বাতিলের পর থেকেই ঝামেলার সূত্রপাত। কলেজ চত্বরে বামপন্থী ছাত্রদের ওপরে হামলায় অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপির ছাত্রদের বিরুদ্ধে। এরপর গুরমেহার একটি প্ল্যাকার্ডে লিখে জানান, ‘আমি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমি এবিভিপিকে ভয় করি না। আমি একা নই। ভারতের সমস্ত শিক্ষার্থী আমার সঙ্গে আছেন।’ ওই প্ল্যাকার্ডের ছবিসহ টুইট করামাত্রই সোশ্যাল মিডিয়ায় গুরমেহারকে নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। এবিভিপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী টুইট পোস্ট করার মধ্যেই গুরমেহারের আরও একটি টুইট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। পরের বিতর্ক আগেরটিকেও কয়েকগুণে ছাড়িয়ে যায়। ওই টুইটে কারগিল যুদ্ধে নিহত ক্যাপ্টেন মনদীপ সিংয়ের ২০ বছর বয়সী মেয়ে গুরমেহার কাউর লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানের হাতে নয়, আমার বাবা নিহত হয়েছিলেন যুদ্ধের হাতে।’ এর পরই দাবানলের মতো বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে ভারতজুড়ে। গুরমেহারের পক্ষে বিপক্ষে দু’দল দাঁড়িয়ে যায়, পরের দু’দিন ধরে উভয় দলে যোগ দিয়েছেন ভারতের প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। তীব্র আলোচনা সমালোচনার জোয়ারে ভেসে যেতে থাকা গুরমেহারকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। আর প্রকাশ্যে বিজেপির ছাত্র শাখা এবিভিপির নিন্দা করার পর থেকেই তাকে এই দুর্ভোগের শিকার হতে হয় তাকে। এর আগে গুরমেহার এক সাক্ষাতকারে বিবিসিকে বলছিলেন, ‘ফোন বা ফেসবুক মেসেঞ্জারে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় আমাকে দেশদ্রোহী বলে গালিগালাজ করা হচ্ছে। আমি কারও কাছে দেশপ্রেমের প্রমাণ দেব না, কিন্তু যারা আমার মতো একজন ভারতীয় নাগরিককে ধর্ষণের হুমকি দেয় তাদের আগে দেশপ্রেমের পরীক্ষা হওয়া দরকার।’ লিন্ডা সারসোর কয়েক দশক ধরে চলা ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতিরোধের ইতিহাস নানাভাবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী জেরুজালেমকে শুধু ইসরাইলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির ঘোষণার পর তা নতুন করে বিশ্বের সামনে চলে এসেছে। তৃতীয় ইন্তিফাদার (প্রতিরোধ যুদ্ধ) ডাকে ফিলিস্তিনজুড়ে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। চলছে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের লড়াই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে তৃতীয় ইন্তিফাদার ডাক দেয় হামাস। এর আগে দুটি বড় ধরনের ইন্তিফাদার ডাক দিয়েছিল ফিলিস্তিন। প্রথম ইন্তিফাদা ছিল ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। তখন এটি ছিল মূলত একটি অসহযোগ আন্দোলন ও গেরিলা প্রতিরোধ। প্রথম ইন্তিফাদা চলাকালে শত শত ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে ইসরাইলী বাহিনী। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বহু মানুষকে পঙ্গু করে দেয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হন হাজার হাজার মানুষ। প্রথম ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনীরা ব্যবহৃত টায়ার থেকে নেয়া রবারের চাকতিতে একটি লোহার পেরেক ঢুকিয়ে এক ধরনের টায়ার ছিদ্রকারী যন্ত্র উদ্ভাবন করে। পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চলগুলোর প্রধান সড়কগুলোতে এ যন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়। আর সাবেক ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী এ্যারিয়েল শ্যারন কয়েক হাজার সেনা নিয়ে জেরুজালেমের পুরনো শহর (ওল্ড সিটি) এবং মসজিদুল আকসা ভ্রমণ করতে গেলে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। ২০০০ সালে শুরু হয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকে। মূলত ইন্তিফাদার মাধ্যমেই প্রতিবেশী কোন আরব দেশের সহায়তা ছাড়া দখলদার ইসরাইলী বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হন ফিলিস্তিনীরা। ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন, নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, হত্যাযজ্ঞের মুখেও তারা প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনীরা নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন লিন্ডা সারসোর। তার মতে বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তরুণ প্রজন্মের মতো ফিলিস্তিন তরুণদের রয়েছে মৌলিক অধিকার। শান্তিতে ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। সেই অধিকার আদায়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। লিন্ডা সারসোর একজন আমেরিকান রাজনৈতিক কর্মী এবং আরব আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব নিউইয়র্কের সাবেক নির্বাহী পরিচালক। ১৭ বছর বয়সে সারসোরকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। তার পরিবারের সবাই ফিলিস্তিনে থাকে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার পর আমেরিকান মুসলমানদের নাগরিক অধিকার রক্ষায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে সময়ে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে মিশে সবার অধিকর আদায়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের থেকে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড দখল করে সেখানে বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। আন্তর্জাতিক আইনে এ বসতি স্থাপন অবৈধ বিবেচনা করা হলেও দেশটি তা মানতে নারাজ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাত চলে আসছে ওই ভূখণ্ডে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বেশ কয়েক দফায় শান্তি আলোচনা হলেও তা ব্যর্থ হয়। পূর্ব জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী বলে দাবি করে ইসরাইল। ফিলিস্তিনে যখন ইসরাইলীরা বুলডোজার চালায়, বিমান হামলা চালায় তখন ভীষণ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মন। কষ্টের এক নীল চাদর বুকজুড়ে অবস্থান করে। ইসরাইলীরা ২০০৯ সালে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে গাজাকে মৃত্যুপুরী বানাল অথচ তাদের শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থ হলো জাতিসংঘ আর পৃথিবীর মানুষ। এত দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধানে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থ হচ্ছে। এর চেয়ে আর বড় বিড়ম্বনা হতে পারে না। ফিলিস্তিনীদের অধিকার রক্ষায় বিশ্বের সব মানুষকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। এলেন মাস্ক বর্তমান বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে অন্যতম সুপরিচিত নাম হলো এলেন মাস্ক। আপনি যদি বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বের খবর রাখেন তবে দেখবেন সপ্তাহের দুই থেকে তিন দিনের মতো কোন না কোন খবরের শিরোনামে আছেন এলেন মাস্ক, তিনি একাধারে উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক ও বিনিয়োগকারী দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এলন মাস্কের জন্ম ২৮ জুন, ১৯৭১। শৈশব ও স্কুল জীবন খুব একটা ভাল কাটেনি। কিন্তু শেখার আগ্রহ ছিল প্রচুর। দিনে ১০ ঘণ্টার ওপরে বই পড়তেন। পড়ার ধাত এতই বেশি ছিল যে লাইব্রেরির সব বই শেষ করে পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাই পড়ে ফেললেন। মাস্ক একটা মানুষকে কম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করেন। মানুষের হার্ডওয়্যার হলো তার শরীর আর মাথা। সফটওয়্যার হলো তার জ্ঞান আহরণ ক্ষমতা, স্বভাব, ব্যক্তিত্ব। আর শেখাটা হচ্ছে সহজ ভাষায় মাথায় তথ্য আর বিচার-বিশ্লেষণ করে মাথায় ঢুকিয়ে রাখা। ক্লাসরুম শিক্ষার প্রতি তাই তার প্রধান অভিযোগ ছিল যে এটার ‘ডাউনলোড স্পিড অসম্ভব রকমের কম!’ তার বেশিরভাগ শিক্ষাই বাসায় বসে পড়ে পড়ে। নয় বছর বয়সে যখন প্রথম কম্পিউটার হাতে পান, সেটির মেমরি ছিল ৫ কিলোবাইট। ‘ঐড়ি ঃড় চৎড়মৎধস’ গাইড মাত্র তিনদিনে আত্মস্থ করে ছোট্ট মাস্ক একটা ভিডিও গেম বানিয়ে ফেললেন ‘ব্ল্যাস্ট’ নামে, যেটা তার মতে- ফ্ল্যাপি বার্ডের চেয়ে বহুগুণে ভাল। ১৯৮৩ সালে গেমটি ৫০০ ডলারে কিনে নিয়েছিল একটি কম্পিউটার ম্যাগাজিন যখন মাস্কের বয়স মাত্র ১২। মায়ের কানাডার নাগরিকত্বের সুযোগে মাস্ক ১৯ বছর বয়সে আফ্রিকা ছেড়ে কানাডা চলে আসেন এবং কিছু বছর পর কলেজ পরিবর্তন করে আমেরিকার পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। এলন মাস্কের আর একটি পরিচয় হচ্ছে, তিনি টেসলা মোটরসের প্রধান নির্বাহী ও মালিক। মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি মডেল এস নামের গাড়িটি ৯০ হাজার ইউনিট বিক্রি করেছে। গাড়ি ছাড়াও রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা মাস্ক। ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থ আদান-প্রদান সেবাপ্রদানকারী ওয়েবসাইট পেপালের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। পেপাল হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত অনলাইন মানি ট্রানজেকশন কোম্পানি। ২০১৭ সালে এলেন মাস্ক আলোচনায় এলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাটারি বানিয়ে। ১০০ মেগাওয়াটের বিশাল এই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি এলান মাস্ক বানিয়েছেন বাজি ধরে, মাত্র ১০০ দিনে। সাউথ অস্ট্রেলিয়ান রাজ্য সরকারের তহবিল নিয়ে বানানো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাটারি রাজ্যের নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউএ্যাবল এনার্জি প্রকল্পের অংশ। কয়েকদিনের ভেতর এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হবে। যদি তা সফল হয় তবে ডিসেম্বরের ১ তারিখ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এলান মাস্কের এই বাজি ছিল বিশ্বের আলোচিত বাজির একটি। কেননা, তিনি বলেছিলেন, তিনি যদি ১০০ দিনে এটা বানাতে না পারেন তবে এটা বানানোর বিল ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ফেরত দেবেন এবং তিনি তা সাফল্যের সঙ্গেই পেরেছেন। গত সেপ্টেম্বরে সাউথ অস্ট্রেলিয়া ব্ল্যাক আউট হলে অস্ট্রেলিয়ান রাজ্য সরকার তাদের পাওয়ার সিস্টেমে ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়। এটা তারই একটা অংশ। সেপ্টেম্বরের সেই ‘অন্ধকার’ রাত যাতে আর ফিরে না আসে তাই রাজ্য সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়। প্রায় ৯০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিড করে টেসলর এই প্রকল্প পায়। এই প্রকল্প থেকে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত যাবে এবং তা প্রায় ৩০ হাজার বাড়িতে সরবরাহ করবে। মাত্র ১০০ দিনে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ব্যবস্থা সত্যি বিস্ময়কর।
×