ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিজয়ের দেশ ও পাওয়া না পাওয়ার সালতামামি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১ জানুয়ারি ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিজয়ের দেশ ও পাওয়া না পাওয়ার সালতামামি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ গর্ব করতেই পারে। কিন্তু আজ যখন বিজয়ের মাস শেষ নতুন বছর আমাদের দ্বারপ্রান্তে আর আমরা জাতি হিসেবে ইতিহাস ও অতীত নিয়ে এখনও বিতর্কে জানতে চাই তাঁদের কি আসলে ইতিহাস ও সত্য ধরে রাখার বিষয়ে সত্যিকার মনোভাব কাজ করে? বাংলাদেশে এখন আর যাই থাক টাকার অভাব নেই। খবরে দেখলাম স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বাজেট নাকি সাত লাখ কোটি টাকা। একটা সময় এমন অঙ্ক শুনলে অনেক মানুষ মূর্ছা যেতেন। এখন হয়তো তা হবে না। কিন্তু তার মানে কি এই যে, কেবল টাকার মাপে আমরা স্বাধীনতা বিজয় এসব দিন বা ইতিহাসকে মনে করার মনে রাখার দায়িত্ব পালন করব? যে ইতিহাসের গৌরবে আওয়ামী লীগ বিএনপি বা অন্যদের চাইতে এগিয়ে সে বিষয়ে তাদের একপেশে মনোভাব আর অনিচ্ছা কিংবা না জানার যে ফাঁক তাতেই মূলত অনেক কিছু হাতছাড়া হয়ে গেছে আমাদের। স্বাধীনতার পরপর সময় পাননি বলে বঙ্গবন্ধু বা চার জাতীয় নেতা যা করতে পারেননি এতবছর পর আপনারা সেদিকে মনোযোগ দেন না কেন? স্বাধীনতা বা বিজয় সমুন্নত রাখার মানে কি অন্যদলের কাউকে গালাগাল করা কিংবা তাদের সমালোচনাতেই পার পাওয়া? সেটাই কিন্তু করে চলেছে সরকারী দল। মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই পাওয়া জাসদ বা বাম নেতাদের মুখে যা শুনি তাতে বিচলিত বোধ করার বিকল্প থাকে না। কে না জানে তখনকার বাম শিবির ছিল দু’ধারায় বিভক্ত। সোভিয়েত ঘেঁষা বামেরা ছিলেন আওয়ামী লীগের ছায়াসঙ্গী। তাদের নেতা-কর্মীরা ছোটখাটো বিরোধ ব্যতীত আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধু অনুগামী হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরও আজ তাঁরা আওয়ামী বিরোধী বলে পরিচিত। আর যারা লড়াইয়ের সময় এই যুদ্ধকে দুই কুকুকের লড়াই বা পরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর জায়গায় ছিলেন তারাই এখন মুখে ফেনা তুলছেন রাতদিন। এই কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বা ইতিহাস চাইলেও দানা বাঁধতে পারছে না। এই যে সরকারে থাকার সুবিধা এবং দীর্ঘ সময় সরকারী দলে থেকে সুবিধা নেয়ার নেতারা একবারও কি ভেবেছেন আমাদের ইতিহাসে এতবড় বিজয়ের পরও আমাদের সেই উদ্যানটির নাম কেন বঙ্গবন্ধু উদ্যান বা বিজয় উদ্যান রাখা হয়নি? হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান বা অতীত কেউ অস্বীকার করে না। তিনি বঙ্গবন্ধুর গুরুও বটে। কিন্তু তাঁর জীবন তো স্বাধীনতার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। রেসকোর্স আমাদের সেই উদ্যান যেকান থেকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। সেই ভাষণ আজ বিশ্বস্বীকৃত। সে আনন্দে মাতোয়ারা হবার নাম কি স্কুল কলেজ থেকে জোর করে মাস্টার আর ছাত্র-ছাত্রীদের ধরে নিয়ে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা? না আগামী দিনের নাগরিকদের কাছে সেই উদ্যান আর ইতিহাসকে প্রাঞ্জল করে বাস্তব করে রাখা? যদি তাই হয়, আমাদের নেতাদের মনে একবারের জন্যও কেন এই প্রশ্ন জাগে না যেÑ এই উদ্যানটির নাম কেন বঙ্গবন্ধুর নামে হলো না? বঙ্গবন্ধুর নামে মেডিক্যাল হাসপাতাল কি জরুরী? আমরা যদি কলকাতার দিকে তাকাই দেখব তাঁরা মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালের নামকরণ করেছে সুনামখ্যাত চিকিৎসকের নামে। এটাই তো হতে হবে। যিনি কালজয়ী একটি ভাষণে আমাদের দেশে বিদেশে গৌরবদীপ্ত করলেন তাঁর সেই স্মৃতিময় উদ্যানটির নাম কি হওয়া উচিত আওয়ামী লীগ? তারচেয়েও আর একটি বিষয় মনে জেগে থাকে। আর কি কোনদিন আমাদের কাছে কেউ এভাবে আত্মসমর্পণ করবে? না করার দরকার পড়বে? বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে বীরত্ব বড় কম। হিন্দু রাজারা না জানতো বীরের মতো আচরণ করতে না তাদের ছিল ভালবাসা। নারী শরীর আর মদ বা নেশানির্ভর রাজারা কর তুলে আনন্দ আয়েশ করতেন আর দুশমনে এলে কাছার কাপড় তুলে পালাতেন। সে থেকে আমাদের ইতিহাস পরাজয় আর ভীরুতার। প্রথমবারের মতো বাঙালী একাত্তরে প্রমাণ করে দিয়েছিল তারাও পারে। সে অসমযুদ্ধে পাকিস্তানের মতো একটি দেশ যার আগপাশতলা হচ্ছে সামরিক যার শক্তি আর বল ছাড়া মেধা শূন্যের কোঠায় তাদের আমরা হারিয়েছিলাম যুদ্ধে। ডিসেম্বরের এক হিমেল সন্ধ্যায় তখনকার রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করা পাকিদের চেহারা কি শুধু জাদুঘরে রাখলেই চলবে? যদি এই উদ্যানটির নাম বিঝব উদ্যান হতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতো কেন এর এই নাম? যারা সেখানে কোন বিকেলে বা কোন সময় ঘুরতে যেতেন তারাও জানতে চাইতেন, এর নাম বিজয় উদ্যান কেন? কিসের বা কোন বিজয় অর্জিত হয়েছিল এই মাঠে? সে সুযোগ আমরা দেইনি। অথচ দিনরাত টিভিতে বা যে কোন জায়গায় বিজয় স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক চলছে। আপনি দিল্লী গেলে দেখবেন তারা গান্ধীর সমাধির পাশে শক্তিস্হল নামে একটি জায়গা বানিয়ে নেহরু ও অন্যদের স্মৃতি ধরে রেখেছে? আমরা কি চার নেতা বা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ওসমানীর নামে এমন কিছু রেখেছি ঢাকায়? কেন আমরা রাখিনি? জানি এর কোন যোগ্য জবাব নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির এই আরেক রূপ। ঝগড়া আর হানাহানিতে বহু আগে পথ হারিয়েছে শুভবোধ। তাই কাজগুলো ঠিকমতো হয়নি। বলছিলাম স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বা বিজয়ের ঘটার কথা। এটা আরেক ফ্যাসান। মূলত সমাজের যে কি চিত্র তা আমরা সবাই জানি। খবরে দেখি আজ এখানে কাল ওখানে কোথা ও না কোথাও অপমানিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। সব চেয়ে অধিক অপমান আমাদের সমাজের বদলে যাওয়ায়। ধর্ম বা বিশ্বাস আদিকাল থেকে চলে আসছে। ধার্মিক মানুষেরা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় ও না। যারা ঘামায় তাদের আমরা চিনি। আজ সমাজ ও দেশজুড়ে তাদের দাপট কি অস্বীকার করার মতো? একদল মানুষ যারা মুখে বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশ জাগাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন তারা কি তাদের আচরণ ও ভালোবাসায় মানুষের মন জয় করতে পেরেছেন আসলে? বাস্তবে এরা মিডিয়া বা সমাজের এলিট অংশ বাদে এখন একেবারেই সংখ্যালঘু। যারা মূলত জনপ্রিয় তাদের আমি বলি ককটেল। এই ককটেলটা এমন এতে এক খাবলা মুক্তিযুদ্ধ আছে, এক চিমটি পাকিপ্রেম কিছুটা আমেরিকা বা পশ্চিমা ফ্লেভার আর অল্প-স্বল্প ভারত। ব্যস, এটাই হলো সেরা। বুঝে না বুঝে এর প্রিয়তা এতবেশি আসল বা অকৃত্রিম বিজয় কিংবা ইতিহাস এখন কংকলাসার। মানুষকে দোষ দেবেন না হে রাজনীতিবিদরা। মানুষ তাদের জীবন দিয়েও দেখেছে লাভ হয়নি। খুব বেশি দিনের কথা না। আমাদের চোখের সামনে মরলেন নূর হোসেন। তার মৃত্যুর কারণ যিনি বা যে রাজনীতি সে এখন রাজদূত। তাঁর দলকে নিবে পিংপং বলের মতো দোটানায় আছে বড় দুই দল। কারণ তাকে ছাড়া গদিতে যাওয়া যায় না। এরপর আমরা যদি মানুষকে আদর্শের সবক দেই তারা তা কেন মানবে? কোন দুঃখে তারা তা মানতে চাইবে? রাজনীতি আমাদের একসময় মুক্তির পথ দেখাতো। যখন এদেশের স্বাধীনতা আমাদের আরাধ্য আর পাকিদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা ছিল প্রবল তখন রাজনীতি ছিল প্রধান হাতিয়ার। সে সুবর্ণ সময় আজ বিগত। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় অভিভাবকের তিরোধানের পর আমাদের রাজনীতিতে জগাখিচুড়ি দল বিএনপির জন্ম হয়। যতদিন আমরা বাঁচব আমাদের বলে যেতেই হবে ইতিহাসে তার জন্ম বা দরকার যে কারণেই হোক আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো এই দলের হাতেই মূলত পাকিকরণের শুরু। আজ এমন এক জায়গায় তা পৌঁছে গেছে চাইলেও কিছু করা যায় না। এলেখা যখন লিখছি তখন সামাজিক মিডিয়ায় দেশের দুই প্রধান ক্রিকেটারের কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। যার মাধ্যম উর্দু। আরবী হলেও ধরে নিতাম এক ধরনের বিশ্বাসবশত তারা তা করেছেন। কিন্তু উর্দু কেন? তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। তাদের জাতীয় পরিচয় আমাদের গর্ব আর তারা প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশের। তাদের ভাষা কেন হবে উর্দু? এর জন্যে তারা থোড়াই দায়ী। পুরো সমাজ আর দেশের ভেতরে এক বাইরে আরেক। যার পেছনে আছে এই রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। যে প্রজন্ম আজ বিপিএল দেখছো যারা নিজেদের সাকিব তামিম সৌম্য বা তাসকিনের গর্বে আনন্দ করছো তোমরা ভাবতেও পারবে না কি কঠিন সময় আমরা পার করেছিলাম। আমরাও ক্রিকেট খেলতাম। তবে আমাদের না ছিল আসল বল বা ব্যাট কেনার সামর্থ্য। আমার এক কবিবন্ধু একবার ম্যাচের ওপেনিং করতে এসেছিল অদ্ভুত এক প্যান্ট পরে। না পাজামা না পাতলুন সে প্যান্টটি দেখে অনেকে মুখটিপে হাসলেও আমরা জানতাম এর পেছনে কারণ আছে। আমার সেই সরল মেধাবী কবি বন্ধুটি অকপটে বলেছিল তাদের যৌথ বড় পরিবারে নতুন প্যান্ট কিনা বিলাসিতা তাই সে বাবার প্যান্ট কেটে এটা বানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সে সময় আমাদের ঐশ্বর্য ছিল ভালবাসা। আজ যে প্রজন্ম নিজেদের মাঠে দেশ বিদেশের সেরা খেলোয়াড়দের অনায়াসে দেখতে যাও তারা জান না আমরা এদের স্বপ্নছাড়া আর কোথাও দেখতে পেতাম না। আমাদের সবার বাড়িতে টিভি ছিল না। কোন এক বন্ধুর বাসায় সবাই মিলে একসঙ্গে ক্রিকেট বা ফুটবল দেখার আনন্দ আর নিজে নিজে কোন পপকর্ণ খেয়ে দেখার আনন্দ এক না। সেই সমবেত উদযাপন আজ কি আসলেই শেষ হয়ে গেছে? যে প্রজন্ম এই দেশকে সামনে নেবে তাদের বলি, তোমরা জান না আমাদের সম্পদ বা প্রাচুর্য কম থাকলেও দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিল না। যে কারণে পাকি ক্রিকেটাররা চট্টগ্রামে এসে দেশের পতাকা আর মানুষকে অসম্মান করার ফল পেয়েছিল হাতে হাতে। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। মেঘলা দুপুরে চট্টগ্রামের পুরনো সে স্টেডিয়ামে কিছু তরুণ জাতীয় পতাকা কাঁধে গ্যালারিময় ঘুরতেই জেগে উঠেছিল মানুষ। তখন চাইলেই পতাকা কেনা যেত না। হয়ত বানিয়েই এনেছিল তারা। আর সে পতাকা মুহূর্তে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল আর যাই যাক না কেন দেশের সম্মান ও পবিত্রতায় ছাড় দেয়া যাবে না। বাকিটা পাকিদের জন্য ইতিহাস। আর আজ তোমরা গালে উল্কি এঁকে মেরী মি আফ্রিদি বা পাকি পতাকা নিয়ে মাঠে যাও। এই কি দেশের প্রাপ্য? আজ এই ডিসেম্বরে নিজেদের সমালোচনা আর প্রকৃত কাজগুলো ছাড়া এগুনো যাবে না। কথা আর উৎসবে বিজয় উদযাপন হবে লালন হবে না। হবে না স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দেশ নির্মাণ। সাম্প্রদায়িকতা অন্ধত্ব সংকীর্ণতা পাশাপাশি দলবাজি এর বাইরে একটি মুক্তদেশ আমাদের স্বপ্নই থেকে গেল। জানি না আগামী প্রজন্ম এ থকে বের হয়ে নতুন কিছু দিতে পারবে কি-না? জয় হোক বাংলাদেশের। এই মাসে তার বুকে জেগে থাকা আনন্দ কেউ কেড়ে নিতে পারেনি, পারবেও না।
×