ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে খোলা চিঠি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে খোলা চিঠি

জনাব শামসুজ্জামান খান মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি ঢাকা, বাংলাদেশ। খ্রিস্ট নববর্ষে (২০১৮) আন্তরিক শুভেচ্ছা বিনতি জানবেন। কুশল সমস্তই, আশা করি। মার্জনাপ্রার্থী, বিব্রত করছি। সম্ভবত আপনিই (ভুলও হতে পারে) বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে দীর্ঘ বছর আসীন। যোগ্য প্রশাসক, যোগ্য পরিচালনার বিচারে নিশ্চয়ই। বয়স হিসাব করা হয়নি। বয়স মূলত গৌণ। কার্যক্ষম এবং অভিজ্ঞতাই জরুরী, সঙ্গে দক্ষতাও। আচার্য যিনি, লক্ষ্য রাখতে হয় পারিপার্শ্বিক, ঘর সংসার, সমাজ, রাষ্ট্রের নানা খুঁটিনাটিও। আচার্যের কাজ কতটা সুচারু, নিপুণতাপূর্ণ, কতটা সেবামূলক, কতটা গ্রহণ-অগ্রণীয়, বিজ্ঞজন বলবেন। অধ্যাপনা করেছেন একদা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পরে বাংলা একাডেমির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কিত অর্থাৎ চাকরিজীবী। মূল কাজ গবেষণার। লেখক ও গবেষক হিসেবে বহুমান্য আপনি। আপনাকে নিয়ে ইংরেজী অভিনন্দিত বইও প্রকাশিত (Folklore in context, Essays in Honor of Shamsyyuaman Khan, সম্পাদক ফিরোজ মাহমদ, সহকারী সম্পাদক সারানি জামান, UPL থেকে প্রকাশিত ২০১০)। লিখেছেন দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান ৩১ জন লেখক। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪২৯, খুদে অক্ষরে ছাপা ঢাউস বই। মূল্য : ৯৯৫ টাকা। এ রকম সঙ্কলিত বই পেয়ে পাঠক খুশি, সুখী। এই সঙ্কলিত বইয়ে বহুমান্যদের লেখায় আপনাকে সম্যক জানার জন্য অপরিহার্য। আপনাকে নিয়ে আপনার গুণাগুণ নিয়ে বিশদ বলার কেউ নই, তো ভিন্ন প্রসঙ্গ। বহু বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে রত, অবসরের পরে কোন ক্ষেত্রে কৃত, অকৃত, সুনাম-অসুনাম আলোচ্য। যে কোন মানুষই চায় কৃতী সুনাম স্থায়ী করতে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বলাবলি করবে। সাধুবাদ দেবে। উদাহরণস্বরূপ বলবে ‘তিনিই পথ প্রদর্শক, তিনিই পয়লা উদ্যোগী, তিনিই করেছেন।’ ইউরোপসহ পৃথিবীর নানা দেশের বইমেলা দেখেছি, দেখতে হয়। সাংবাদিক ও লেখকের তকমায়। বক্তৃতা বা লেখা পাঠের আমন্ত্রণে। বইমেলা মানেই কেবল স্টলে স্টলে বই সাজানো, সাজিয়ে বিক্রি নয়। বইমেলার আয়োজকদের কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেয়া, পাঠককে বইয়ে শামিল করা। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি। শুনেছি, দেখিনি, ফেব্রুয়ারির মাসের গোড়া থেকে ‘বাংলাদেশে বইমেলা’ মাসব্যাপী। আয়োজক বাংলা একাডেমি। ছোট-বড় শতাধিক (সংখ্যা কত, বলতে অপারগ) স্টল, পুস্তক প্রকাশক হাজির। প্রকাশকের সমারোহ। ‘বাংলাদেশে বইমেলা’ শব্দবাক্যে সমূহ আপত্তি আছে। বাংলাদেশ বলতে কি ঢাকা শহর কেবল? দেশের অন্য শহর, গঞ্জ, মফস্বল? পাঠক নেই? বইপ্রেমী নেই? বইমেলা কেন ঢাকায় সীমাবদ্ধ? তাও আবার একই চৌহদ্দীতে? নয় কেন, ফেব্রুয়ারি মাসে (যেহেতু ভাষার মাস। ভাষার মাসেই বইমেলায় শত শত বই প্রকাশিত। গোটা বছরে সিকি ভাগও নয়। পাঠকও উন্মুখ ফেব্রুয়ারি মাসে। ফেব্রুয়ারি এখন বইমেলার কালচার।)? শুনেছি, (দেখিনি) জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাংলাদেশের জেলায় জেলায় বইমেলার আয়োজন করে। কোন্্ কিসিমের আয়োজন, অজানা। সরকারী আয়োজন হলে জৌলুস নেই। পাঠক-দর্শক, ক্রেতাও বিমুখ। প্রকাশক যোগদানেও অনুৎসাহী। চলতি বছরে (সেপ্টেম্বরে) ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হাজির। সরকারের উপসচিব। ভদ্রলোক (পরিচালক) বই সম্পর্কে কিচ্ছু জানেন না। তাঁকে বেছে বেছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক নির্বাচন করেছেন সরকার? কোন্ গরজে? কী দেখে, কোন্ গুণে? সরদার জয়েনউদ্দীন, রশীদ হায়দারের মতো লেখক, বই বিশেষজ্ঞ, পাঠক বিশেষজ্ঞ, গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞ, বইসংস্কৃতির উত্তরাধিকার ওই অশিক্ষিত সরকারী আমলা? ইংরেজীও সঠিক বলতে পারেন না (ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় একটি অনুষ্ঠানে ইংরেজী শুনে তাজ্জব)। শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি দেশে- বিশ্বে প্রচারে উন্মুখ, অর্থ ব্যয়ে অকুণ্ঠ, কিন্তু দেশেই যদি এই হয়, প্রশ্নবিদ্ধ। শেখ হাসিনা নিজে লেখক, গদ্য একেবারে অপাঠ্য নয়, মোটামুটি শুদ্ধ, নিশ্চয় চান, আশা করেন বাংলা ভাষা সাহিত্য দেশ ও দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিশ্বময় হোক। গ-মূর্খ সরকারী আমলা দিয়ে হয় কী? না। ছাপাখানার বিপ্লবের পরেই (তাও ৫০০ বছর হয়ে গেছে। বিপ্লব জার্মানিতেই), চার বছরও যায়নি, নানা সুদৃশ্য অক্ষর-টাইপে বই প্রকাশ। জার্মানিসহ গোটা ইউরোপে। বই নিয়ে প্রথম বইমেলা, ৫০০ বছর আগে লাইপজিগে। শুরুতে অবশ্যই ছোট। লাইপজিগের বইমেলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রমরমা ছিল। যুদ্ধ শুরুর পরে ভাটা। কারণ বিস্তর। ইতিহাসমাখা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানি বিভক্ত। পূর্ব জার্মানি আলাদা রাষ্ট্র। কিন্তু ঐতিহ্য ভোলেনি। কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে (লাইপজিগে) বইমেলা ছিল প্রাণবন্ত। দেখেছি, বইমেলা উপলক্ষে গোটা শহর উন্মাতাল। কমিউনিজম ধসের পরেও। একটি জায়গায় বইমেলা নয়, ছড়িয়ে দেয়া সর্বত্র। বিভিন্ন পাঠাগারে। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনে। এমন কী রেস্তরাঁয়। লেখক পড়েন বই থেকে। বই বিক্রির আয়োজন। বাংলাদেশের বইমেলায় (ঢাকায়), যার বাড়ি পাবনায়, রাজশাহী, সিলেটে, চট্টগ্রামে, নেত্রকোনায়, জামালপুরে, বরিশালে, ফরিদপুরে, খুলনায়, কুষ্টিয়ায়, রংপুরে, দিনাজপুরে, বগুড়ায় বা অন্যত্র নিশ্চয় আসতে পারেন না। এমন কী ঢাকার মিরপুর-উত্তরা-সূত্রাপুর-পল্লবীর মানুষ। আসতেই দুই ঘণ্টা যানজট। রাতে ফিরতে আরও বিড়ম্বনা। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই গুম। সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতা। কী করণীয় তাহলে? শামসুজ্জামান খান, মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ভেবে দেখতে পারেন, বইমেলা কত সহজেই ছড়িয়ে দেয়া যায় বাড়ির কাছে আরশিনগরে। তার জন্য কিছু করণীয় আছে বৈকি। প্রয়োজনে কঠোর হওয়া। বাংলা একাডেমিই উদ্যোগ নিতে পারে, নির্দেশও দিতে পারে (নির্দেশ অসাংবিধানিক, আইনগত নয়)। বাংলা একাডেমিতে স্টল পেতে হলে ঢাকার বাইরেও, ফেব্রুয়ারি মাসে, বইমেলার মাসে বাংলাদেশের নানা জেলায়, ছোট পরিসরে বইমেলার আয়োজন। বাংলা একাডেমির অনুরোধে প্রকাশকদের আর্থিক সাহায্য। কায়রো বইমেলা, চীনের বইমেলা ইদানীং করছে। বাংলা একাডেমির দায় কেবল ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় বইমেলার আয়োজন নয় সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া। কী ভাবে, কোন্ প্রক্রিয়া ও মহিমায়, শামসুজ্জামান খান, মহাপরিচলক বাংলা একাডেমি, জানেন। প্রয়োজন উদ্যোগ ও কর্ম। এই কর্মের গুণপনাই আপনার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত। ইতি। নিত্যস্নেহার্থী। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ বার্লিন, জার্মানি
×