ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যার কালে জাতিগত নিধন -জাফর ওয়াজেদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১ জানুয়ারি ২০১৮

গণহত্যার কালে জাতিগত নিধন -জাফর ওয়াজেদ

স্বাগত ২০১৮ সাল। শুভ খ্রীষ্টীয় নববর্ষ। নতুনের আবাহন নিয়ে এলো আরেক বছর। ২০১৭ চলে গেল কালের অস্তাচলে। বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে ইতিহাসের ভয়াবহ নারকীয় অধ্যায়ের শিকার এক মানবগোষ্ঠীকে। রোহিঙ্গানামক জাতিকে নিমূল করতে নেমেছে বর্বররা। বাঁচার জন্য ওরা এসেছে এদেশে। মানুষ মানুষকেই হত্যা করে ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, ভাষার নামে, জাতিসত্তার নামে। মানুষই হরণ করে মানুষের প্রাণ। কেড়ে নেয় ধনসম্পদ। পরস্বাপহরণের এ মানসিকতার অভ্যন্তরে থাকে লোভ, লালসা, বিবিধ বিকৃতি। নিষ্কৃতি মেলে না দুর্ব‍ৃত্তপনায় লিপ্তদের হাত থেকে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের। জাতিগত নিধন এর মতো অমানবিক, নৃশংস বর্বরতার নিদর্শন এ বাংলার মানুষকে আবার দেখতে হচ্ছে। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল। বলেছিল, বাংলার মানুষ না, তারা চায় বাংলার মাটি। তাই জাতিগত নিধনযজ্ঞে নেমে বাঙালীদের দেশত্যাগেও বাধ্য করে। নির্বিচারে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ ধ্বংস সবই চালিয়েছে। পাকিস্তানী হানাদারদের অন্ধ অনুকরণে মিয়ানমারের বর্বর সেনারাও সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ নির্যাতনের মাধ্যমে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে যাছে। নির্বিচারে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এমনকি আগুনে পুড়িয়ে মারছে রোহিঙ্গাদের। রাষ্ট্র আগ্রাসী হয়ে যে হত্যাকা- অব্যাহত রেখেছে, তা বর্ণবাদী গণহত্যা। চরিত্র যার ফ্যাসীবাদীর চেয়েও নিকৃষ্ট। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করে তাদের ভৌত সম্পদ, জায়গাজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ি, সবকিছু দখল করে নিয়েছে। এসব লুণ্ঠনকারী সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাখাইন ও মগরা। দুর্বলের ওপর আঘাত হানা যে কত সহজ, তা এই বর্বররা প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ করে আসছে। রোহিঙ্গারা ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে মিয়ানমারের জান্তারা বারবার বলে আসছে। যেমনটা একাত্তরে পাকিস্তানী জান্তা শাসকরা মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী হিসেবে অভিহিত করত। মিয়ানমারে যা হচ্ছে, তা এক শব্দে বলা যায় গণহত্যা। প্রাণভয়ে তারা যেমন আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, তেমনি বাংলাদেশের এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল শরণার্থী হিসেবে। শরণার্থীরা শখ করে যায়নি। তাদের যেতে বাধ্য করা হয়েছে। শরণার্থীর এই বিপুল বোঝা বহন করা মোটেই ভারতের পক্ষে বহন করা সহজসাধ্য ছিল না। তারপরও এদের আশ্রয়, খাবার, চিকিৎসাও দিয়েছে। বাঙালীরা যাতে নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারে, ভারত সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। আজকের বাংলাদেশও চায় রোহিঙ্গারা নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যাবে এবং শান্তিতে বসবাস করবে। এমনিতে রোহিঙ্গারা ভাগ্যের ফেরে বিপদাপন্ন। তাদের জন্য বিশ্ব পাশে এসে দাঁড়ায় না। জাতিসংঘের কোন প্রচেষ্টাই আর কার্যকর করা যাচ্ছে না। তবু আশাবাদ জাগে,বাঙালীরা যেমন ফিরে যেতে পেরেছে নিজ বাসভূমে, যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশে, তেমনি রোহিঙ্গারাও ফিরে যেতে পারবে নিজ দেশে, জন্মভূমিতে। মিয়ানমার নামক দেশটি পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সামরিক বাহিনীর অধীনে থাকার পর সাম্প্রতিক সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সামরিক শাসকরা রাষ্ট্রের দখলদারি থেকে পশ্চাৎপসারণ করেছে বলা যাবে না। ক্ষমতায় নির্বাচিত শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত গণতন্ত্রের মানবকন্যা ‘অংসান সুচি’ থাকলেও সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেনাদের অঙ্গুলি হেলনে। তাই তারা সংখ্যালঘু নিরস্ত্র অসহায়, দুর্বল রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা, গণহত্যা চালাতে পারছে। তাদের তাড়িয়ে সেখানে বাণিজ্যিক স্থাপনা, নিজেদের লোকজনকে বসানোর জন্য অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বৈধ, নির্যাতিত সরকারের শাসনামলে এমনভাবে উচ্ছেদের শিকার হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবার কথা রোহিঙ্গারা কখনও ভাবেনি। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চরিত্র ধারণকারী মিয়ানমারের হানাদার সেনাদের মধ্যে কোন তফাত মেলে না, নামের পার্থক্য ছাড়া। জন্মভূমি থেকে উৎখাত করার জন্য যে গণহত্যা চালানো হচ্ছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। রাষ্ট্রকে রোহিঙ্গাশূন্য করার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছে, তা সভ্যতার বিপরীতে বর্বরতারই নামান্তর। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ বসবাস করে। তাদের মধ্যে সংঘাত বা সহিংসতা একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী আজ কেবলই বাস্তুচ্যুত নয়, তারা আজ ভয়াবহভাবে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত আর অসহায়। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আরাকান বা রাখাইনের খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য রোহিঙ্গাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সম্পদ লোপাট করার জন্য শক্তিশালী দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাশাসন, গণহত্যা, ধর্ষণ, রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার বিষয়ে নীরব এবং নির্বিকার। অথচ সামরিক অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন ও গণহত্যার এবং দেশত্যাগে বাধ্য করার পেছনে পুরো বিশ্বই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিশেষ ভূমিকা দেখছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে প্রদত্ত সব ধরনের ব্যবহারিক সহযোগিতা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার জায়েদ রাদ আল হুসেন সঙ্কটের গোড়াতেই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যা চলছে, তা জাতি নিধনের আদর্শ উদাহরণ। জঙ্গী দমনের নামে সে দেশের সেনাবাহিনী রাখাইনে যা করেছে বা করছে, তা সে দেশে কথিত সন্ত্রাসী হামলার তুলনায় ‘অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।’ আগস্ট মাসের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীরা ত্রিশটি পুলিশ চৌকি ও সেনা ছাউনিতে হামলা চালিয়ে দেড় শ’ জনকে হতাহত করে। তার জেরেই জঙ্গী দমনে অভিযানে নামে সেনা। আর শুরু হয় গণহত্যা তথা জাতিগত নিধন। এদিকে প্রথম দৃষ্টিপাত করেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট। যিনি এই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে মন্তব্য করেন। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন শেষে বলেছেন, সাম্প্রতিক বিশ্বের কোথাও এত দ্রুত শরণার্থী সঙ্কট এমন প্রকট হয়ে ওঠেনি। সে দেশে ব্যাপক গণহত্যা চালানোর কারণে এভাবে পালে পালে পালিয়ে আসছে। পোপ ফ্রান্সিস উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ‘বছরের পর বছর রোহিঙ্গারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তাদের নিপীড়ন ও হত্যা করা হচ্ছে কেবল এ কারণে যে, তারা নিজেদের ঐতিহ্য মতে চলতে চায় এবং তাদের মুসলিম ধর্মমত নিয়ে বাঁচতে চায়।’ পোপের এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি মিয়ানমার। বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা নিকৃষ্ট মানবজাতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন এমন একটি দেশে, যার শীর্ষনেতা শান্তির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব। ক্ষমতা পাওয়ার পর লোমহর্ষক এ গণহত্যায় তার সক্রিয় অংশগ্রহণে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ্ববাসী। তার স্পষ্ট নীতি হচ্ছে, রোহিঙ্গা নিশ্চিহ্নকরণ। ২০১৫ সালে হলোকাস্ট মিউজিয়াম মিয়ানমারকে সবচেয়ে বেশি গণহত্যার ঝুঁকির দেশের তালিকাভুক্ত করেছে। জাতিসংঘ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচও বলেছে, জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণকালে সুচি বলেছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত গৃহহীন আশাহীনমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলা, এমন একটি বিশ্ব যার প্রতিটি অংশ হবে সত্যিকারের পবিত্র স্থান, যেখানে প্রতিটি বাসিন্দার থাকবে স্বাধীনতা এবং শান্তিতে বসবাস করার সঙ্কুলান।’ আর ক্ষমতায় যাওয়ার পর তার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। মিথ্যাচারে সুচি বাংলাদেশের বিএনপি নেত্রীকেও ছাড়িয়ে যেতে চাইছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর সংসদে দাঁড়িয়ে বেগম জিয়া বলেছিলেন, ওরা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে এসেছিল। আর সুচি বলছেন, ‘বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুদের আতঙ্কিত করে তাদের বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।’ বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সুচি গণহত্যাকে অস্বীকার করছেন। অথচ তারা এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা- এই নীতির প্রয়োগে দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তাই ষাটের দশকে বর্মার সাময়িক জান্তা শাসকরা ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে একসঙ্গে ডেকে নিয়ে দেশ দুটির নাগরিকদের বর্মা ছাড়তে উপদেশ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে রেঙ্গুনে ভারতবর্ষীয়দের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। তাদের চাপে সব ফেলে এক বস্ত্রে চলে আসতে হয়েছিল। মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান আরও পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূতসহ রাখাইন প্রদেশে গিয়ে সম্প্রতি যা দেখেছেন, তার সামান্য বিবৃত করেছেন। অঞ্চলজুড়ে মাইলের পর মাইল ধরে পোড়া ঘরবাড়ি দেখেছেন, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এ জিনিস হঠাৎ করে হয়নি বলে তার মনে হয়েছে। মানবিক সঙ্কটের ব্যাপকতা দেখেছেন তিনি। গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সুচি ও দেশটির সামরিক বাহিনীকে। কুয়ালালামপুরে গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক গণআদালত প্রতীকী বিচারে এ রায় দেয়। রোহিঙ্গা, কারিন, কারেনসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর দু’শ’ লোকের জবানবন্দী শুনে এবং বিভিন্ন তথ্যচিত্র ও বিশেষজ্ঞ মতামত পর্যালোচনা করে রোমভিত্তিক সংগঠন। পার্লামেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের (পিপিটি) সাত বিচারকের প্যানেল এই প্রতীকী রায় ঘোষণা করে। পাঁচদিন ধরে এ গণআদালতে শুনানি চলে। বিচারকরা বলেন, তাদের বিচারে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। শুনানিতে বাংলাদেশও অংশ নেয়। আদালত এও বলেছে মিয়ানমার সরকারকে তাদের সংবিধান সংশোধন করে সব জাতিগোষ্ঠীকে নাগরিকত্বের অধিকার দেয়ার পাশাপাশি সব ধরনের উদ্দেশ্যমূলক আইন বাতিল করতে হবে। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন বর্মী নাগরিক উত্থান্ট। সেদিন গণহত্যা বন্ধ করতে পারেননি তিনি। তাই বাহাত্তর সালে কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, ‘জাতিসংঘ আমাকে নেবে না, মৃত্যু আমাকে নেবে।’ সেই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হলেও মিয়ানমার তাতে গড়িমসি করছে। অথচ সুচি তা কার্যকর করার অঙ্গীকার করেছিলেন। গণহত্যার অংশীদার সুচি তার পিতার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কারণ, দেশটির মূল সংবিধানে রোহিঙ্গাসহ সব গোষ্ঠীকেই নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সুচির বাবা অং সান। ১৯৪৮ সালে বর্মার স্বাধীনতার সহস্র আগে থেকেই রোহিঙ্গারা দেশটিতে বসবাস করে আসছিল। সুতরাং পিতার অনুসৃত নীতি থেকে তিনি ছিটকে বাইরে এসেছেন। এখনও নিপীড়ন চলছে। মনে হয়, যতক্ষণ না মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা থামবে না। আর সুচি বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী যা করছে তা ঠিকই করছে। রাখাইনে অচিরেই শান্তি নেমে আসবে।’ কিন্তু আসল চিত্র বলে ভিন্ন কথা। কবরের মতো নীরব নিথর অবস্থা বিরাজ করছে রাখাইনে। নারীদের ধর্ষিতা হয়ে নৌকায় ভেসে আশ্রয় খোঁজা, নদীতে শিশুদের ভাসমান লাশ, মৃত মায়ের ঠা-া স্তনে দুধ খুঁজছে অবুঝ শিশু এসব চিত্র এখন নির্মম বাস্তবতা। অথচ বিশ্ববাসী সুচিকে শান্তির দূত হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। দশকের পর দশক ধরে যে মিয়ানমারে সামরিক শাসন চলে এসেছে, সেই সেনাবাহিনীর ওপর ভর করেই চলছেন সুচি। পাশবিকতার অলঙ্কার যাদের ললাটের লিখন হয়ে আছে সেই বর্বর সেনাদের পক্ষ নিয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে যখন আগুন জ্বলছে, তখন সুচি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। মিয়ানমারের পালংগাঝিরির পঞ্চাশ বছর বয়সী বদর আলিম বলেছেন, সুচি যদি আমাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করেন, রাখাইনদের মতো নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন তবেই শুধু আমরা যাওয়ার চিন্তা করতে পারি। সুচি তার কাজ ঠিকমতো করলে পরিস্থিতি এমন হতো না। তিনি চুপ ছিলেন এবং সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল, যারা আমাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম সনদে মিয়ানমার সই করেনি। ফলে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যায় যুক্ত জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতাদের ওই আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে বিচারের সুযোগ নেই। তবে নিরাপত্তা পরিষদ তাদের বিচারে আইসিসিকে সুপারিশ করলে তা হতে পারে। এ ধরনের অনেক ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের রয়েছে। এসব কারণেই নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা নারীদের অবস্থা ভয়াবহ। সেনার অত্যাচারে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন ওই মহিলারা। তাদের জখম শরীরে যে ধরনের চিহ্ন পাওয়া গেছে তা থেকে জাতিসংঘ হতে আসা চিকিৎসকরা নিশ্চিত, ওই মহিলারা ভয়ঙ্কর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কাউকে যৌন-নিগ্রহ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ আবার গণধর্ষণের বিভীষিকার মুখোমুখি হয়েছেন। আক্রান্ত মহিলাদের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল, তা হয়ত বলা যাবে না। কিন্তু অত্যাচারের ধরনটা যেন একই রকম। লেদা নামক একটি শিবিরের চিকিৎসকরা বলেছেন এক শ’র বেশি মহিলার চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছেন তাদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যৌন নিগ্রহ করা হয়েছে। মহিলাদের ওপর আরও নির্যাতন করতে হবে- এমন একটা লক্ষ্য নিয়ে যেন চড়াও হয়েছিল অভিযুক্তরা। ২০ বছরের এক তরুণীর কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চুল ধরে হিঁচড়ে টেনে বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে মিয়ানমারের সেনারা তাকে ধর্ষণ করে বলে দাবি মেয়েটির। কারও ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া, কারও ক্ষেত্রে যোনিপথ কেটে দেয়া, চামড়ায় কামড়ের দাগ- এমন অমানবিক আঘাত শরীরজুড়ে। মিয়ানমার প্রশাসন অবশ্য নিজেদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগই উড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের পাল্টা দাবি, রোহিঙ্গাদের জঙ্গী সংগঠন সেনাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। সেনারা মিয়ানমারে নাগরিকদের সুরক্ষায় কাজ করছে। আউং সান সুচির মুখপাত্র বলেছেন, ‘যে মহিলারা ধর্ষণের শিকার, তারা আমাদের কাছে এসে অভিযোগ জানান। তদন্তে যা বেরোবে, সেই মতো ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সুচি অবশ্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে চুপ। অথচ এই সুচিই ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বলেছিলেন, ‘দেশের জাতি সংঘর্ষে অনেক সময়ই ধর্ষণ অস্ত্র হয়ে উঠছে।’ এ হচ্ছে মিয়ানমারের শাসককুলের বর্বরীয় কার্যক্রমের বৈপরীত্য ভাষ্য। নানা সমীকরণে এ অঞ্চলের বৃহৎ শক্তিগুলো এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সরাসরি চাপ না দিয়ে এক ধরনের ‘ব্যালান্সড’ কূটনীতিতে থাকতে চাইছে। কিন্তু তাদের এই কৌশল অদূর ভবিষ্যতে সবার জন্যই ব্যুমেরাং হয়ে যেতে পারে। এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে পুঁজি করে নতুন কোন অস্থিরতা তৈরি হয় যদি তাহলে তার থেকে চীন কিংবা ভারতসহ পূর্বমুখী অন্য প্রতিবেশী দেশগুলো রেহাই পাবে না। বৃহৎ শক্তিগুলো কি এই বাস্তবতা মাথায় রেখে আগামীর পথে হাঁটবে, নাকি ক্ষুদ্র স্বার্থে চোখ বুজে থাকবে, তার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যত ভূ-রাজনীতির অনেক কিছুই। কত দীর্ঘ হবে রোহিঙ্গাদের এই দুঃসময়, কেউ জানে না। তবে জানে মিয়ানমার সরকার। তথাগত গৌতম বুদ্ধ নিশ্চয়ই রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। উগ্রবাদীদের এই হত্যাযজ্ঞ তাকেও পীড়িত করে। ব্রিটিশরা ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত মিয়ানমারে শাসন করেছে। কিন্তু তারা পূর্বাপর না ভেবেই স্বাধীন রাজ্য আরাকানকে বর্মার সঙ্গে সংযুক্ত করে নিয়ে যে অপরাধ করেছে, তার মাশুল দিতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। গণহত্যার বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য নেতৃত্ব প্রদান করে এ অপরাধ খ-ন করতে পারত। কিন্তু তারা বেশি দূর যেতে চায় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে একাত্তর সালে যে গণহত্যা হয়েছে। তার নেতৃত্বদানকারী ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনার তালিকাও হয়েছিল। পাকিস্তান রাজি হয়েছিল তাদের বিচার করার জন্য। কিন্তু তারা তা করেনি। বাংলাদেশ পাাকিস্তানের সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ অব্যাহত রেখেছে। ১৯৫ জনের বিচারের দাবিতেও সোচ্চার আজও। রোহিঙ্গারা গণহত্যার বিচার একদিন পাবেই। বেশি দিন এই পাপ চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ঘাতকরা বেশি দিন পার পায় না। মানুষের আদালতে না হলেও প্রকৃতির আদালত ঠিকই বিচার করে। মিয়ানমারের গণহত্যার ঘটনা ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। তারই পথ ধরে বিচারের দরজা খুলে যাবে। স্বজন হারানো শ্মশানে খুনীদের চিত্র খুঁড়বেই রোহিঙ্গারা। তার আগে চাই তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও শান্তিতে বসবাস। নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা রোহিঙ্গারা নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারবে। ফিরে পাবে তাদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, বেঁচে থাকার অধিকার ও নাগরিকত্ব। বাংলাদেশ তাই-ই চায়।
×