ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মসলিনের পুনরুদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১ জানুয়ারি ২০১৮

মসলিনের পুনরুদ্ধার

সরকারের সহায়তায় ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার’ প্রকল্পের আওতায় বাংলার আদি ও অকৃত্রিম মসলিনের ঐতিহ্য ফিরে আসার সংবাদটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে বাংলার ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ ফিরিয়ে আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এর জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দও করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক ইতোমধ্যে দেড় বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফুটি কার্পাস জাতীয় তুলা গাছের সন্ধান পেয়েছেন, যে গাছ থেকে আদিকালে তৈরি হতো মসলিন কাপড় বোনার উন্নতমানের সুতা। উল্লেখ্য, এই জাতীয় তুলা চাষের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল রাজধানীর সন্নিকটে সোনারগাঁওসহ প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন নদ-নদীর অববাহিকা। ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞরা তৎকালের বিবেচনায় বাংলার মসলিনকে অভিহিত করেছেন সর্বাধিক সূক্ষ্ম, হাল্কা, মনোরম ও আরামদায়ক বস্ত্র বলে। এটা বাস্তব সত্য যে, আদিকালে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী উন্নতমানের অতি সূক্ষ্ম বস্ত্রাদি প্রাচীন ঐতিহাসিক সিল্ক রুট ধরে রফতানি হতো মিসর, গ্রীস, ইউরোপ ও অন্যত্র। মিসরের মমিতে মসলিন ব্যবহারের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুঘলদের দরবারে সবিশেষ কদর ছিল মসলিনের। নানা কারণে সেই মসলিন হারিয়ে গেলেও আধুনিক গবেষণাকর্মের বদৌলতে তার আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল হয়েছে। মতান্তরে উন্নতমানের পাটের সূক্ষ্ম তন্তু থেকেও তৈরি হতো মসলিন, যাকে বলা হতো পট্টবস্ত্র। রেশম থেকেও মসলিন তৈরি হতো বলে মনে করা হয়। যাহোক, বাংলার ঐতিহ্যবাহী জামদানি ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী মেধাস্বত্ব সংরক্ষণসহ জিআই ইনডেক্সে ঠাঁই করে নিয়েছে। এসবের মধ্যে আরও রয়েছে শীতলপাটি, ইলিশ। পাটের জেনোম সিকোয়েন্স তৈরি করে বাংলাদেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বে। মসলিনের মতো অতি সূক্ষ্ম সুতাসহ পাটের বহুবিধ ব্যবহার সম্ভব হবে অচিরেই। সে অবস্থায় মসলিনের পুনরাবির্ভাব দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ করে তুলবে নিঃসন্দেহে। আমরা বিজ্ঞানীদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। ফুটি কার্পাসের অনুরূপ আরও একটি প্রাকৃতিক কৃষিপণ্য বাংলাদেশের রেশম শিল্প। রাজশাহী সিল্কের সুনাম এক সময় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিদেশেও। তবে দুঃখজনক হলো রেশম চাষের সেই স্বর্ণযুগ আজ আর নেই। রাজশাহী সিল্কের গৌরবও মৃতপ্রায়। প্রধানত আম চাষ ও আম বাগানের দৌরাত্ম্যে রেশমের গুটি পোকার প্রধান খাদ্য তুঁত গাছ প্রায় নির্বাসিত। বর্তমানে রেশম চাষের পরিমাণ খুবই সীমিত হয়ে আসছে বিধায় সিল্কের চাহিদা মেটাতে হয় উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে সুতা আমদানি করে। অথচ দেশে পতিত জমির অভাব নেই। অনাবাদি জমিও রয়েছে। সেসব অব্যবহৃত জমিতে পরিকল্পিত উপায়ে তুঁত ও লাক্ষা গাছ লাগানো হলে রেশমের গুটি উৎপাদন এবং লাক্ষা চাষ খুবই সম্ভব। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় এসব কৃষিজাত পণ্য আবাদের জন্য সবিশেষ উপযোগী। অপ্রচলিত কৃষিপণ্য বিধায় বর্তমান বিশ্বে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা, দামও চড়া। এর ফলে স্থানীয়ভাবে বেকারত্ব হ্রাসের পাশাপাশি বাড়তে পারে কর্মসংস্থান। সব সময় সবকিছু যে সরকারী উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় হতে হবে এমন কোন কথা নেই। এ ক্ষেত্রে বেসরকারী উদ্যোক্তা এবং এনজিওরা এগিয়ে আসতে পারে। সে অবস্থায় রাজশাহী সিল্ক ও লাক্ষা চাষের গৌরব পুনরুদ্ধার হবে বলেই প্রত্যাশা। পাশাপাশি পুনরুদ্ধার করতে হবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিনের সূক্ষ্ম সুতা ও কাপড়।
×