ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারী ও শিশুদের অনেক অগ্রগতি হলেও ছিল ধর্ষণ ও নির্যাতন

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১ জানুয়ারি ২০১৮

নারী ও শিশুদের অনেক অগ্রগতি হলেও ছিল ধর্ষণ ও নির্যাতন

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, খেলাধুলা ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও অধিকার বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন নারীরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ২০১৭ সালেও অব্যাহত ছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাবমতে ২০১৭ সালে মোট ১৬৭৫ শিশু হত্যা ও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয় ৩৩৯ শিশু, আত্মহত্যা করে ১১৭ জন এবং রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে ৩৭ শিশুর। এ ছাড়া শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, উত্ত্যক্তকরণসহ মোট ৫৬৫টি ঘটনা ঘটে। ২৫ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের গৌরিপুরে চুরির অভিযোগে খুঁটিতে বেঁধে বর্বর নির্যাতনসহ পিটিয়ে হত্যা করা হয় শিশু সাগরকে। ২৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ার কাহালুতে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় রাসেল নামে এক কিশোর শ্রমিককে। আসকের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার চলমান দৃশ্য- যৌন হয়রানি ও নির্যাতন ॥ ২০১৭ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটে দ্বারা উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরে বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সহিংস ঘটনার শিকার হয়েছেন মোট ২৫৫ জন। এর মধ্যে ১২ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারীসহ খুন হয়েছেন ১৩ জন, বখাটেদের প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছেন ১৬৮ জন এবং স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে ৪ জন মেয়ের। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন মোট ২৪৪ জন। ২৮ মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১২ নারী শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার ও ধামরাই থানা হেফাজতে পুলিশ কর্তৃক তাদের নানাভাবে হয়রানি করার ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘প্রেমের প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিজয় দিবসের রাতে ঘরে ঢুকে হুমায়রা আক্তার মুন্নী নামে এক স্কুলছাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে বখাটে ইয়াহিয়া। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মারা যান মুন্নী। ১৫ জুলাই মেয়েকে উত্ত্যক্তের বিষয়ে থানায় অভিযোগ করায় গোপালগঞ্জ শহরে কাজী মাহবুব নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে বখাটে আকাশ ও তার সহযোগীরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান কাজী মাহবুব। ধর্ষণ ॥ ২০১৭ সালে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি এর ধরনে নিষ্ঠুরতা এবং ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে ধনবান, ক্ষমতাশালী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, পরিবহন শ্রমিকদের যুক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। শিশু কিংবা বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি এ পাশবিকতার হাত থেকে। এ বছর সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী। উল্লেখ্য, গত ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬৫৯। এ বছর ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ নারী এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১১ নারী। মেয়েকে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনায় বিচার না পেয়ে গত ২৯ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশনের কাছে চলন্ত ট্রেনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন হযরত আলী ও তার মেয়ে আয়েশা আক্তার। ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীতে রেইন ট্রি হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে আপন জুয়েলার্সের পরিচালকের পুত্র সাফাত আহমেদ ও তার সহযোগীরা। ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে পরিবহন শ্রমিকরা চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে আইডিয়াল ল’ কলেজের শিক্ষার্থী রূপা হককে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তাকে। ১৭ জুলাই এক শিক্ষার্থীকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার। এরপর ২৮ জুলাই ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে ওই শিক্ষার্থী ও তার মাকে বেধড়ক পেটানোর পর চুল কেটে দেয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পুলিশের এসআইসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চার সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। সালিশ ও ফতোয়া ॥ আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাবমতে, ২০১৭ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ১০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে গ্রামছাড়া, সমাজচ্যুত বা একঘরে করা হয় তিনটি ক্ষেত্রে, এছাড়া হিল্লা বিয়ে ও দোররার শিকার হন ৩ নারী। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৪ জন। গত ২০ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে পরকীয়ার অভিযোগ এনে মৌসুমী আক্তার নামে এক গৃহবধূকে গ্রাম্য সালিশে ১০১টি দোররা মারা হয়। অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মৌসুমী বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, কিন্তু জ্ঞান ফিরলে তাকে আবারও দোররা মারা হয়। এরপর অসুস্থ অবস্থায় ২১ ডিসেম্বর মারা যান মৌসুমী আক্তার। ৮ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে কল্যাণপুর জামে মসজিদের মাইক থেকে ‘ফসলের ক্ষতি’ ও ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’র অজুহাতে নারীদের মাঠে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়া হয়। ওই মসজিদের ইমামসহ মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দ একসঙ্গে বৈঠক করে নারীদের ফসলের মাঠে যাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়। যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন ॥ ২০১৭ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৩০৩ জন নারী এর মধ্যে ১৪৫ জনকে হত্যা করা হয় এবং আত্মহত্যা করেন ১০ জন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৮৮টি। অন্যদিকে এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৪৪১ জন নারী, এদের মধ্যে স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যদের কর্তৃক হত্যার শিকার হন ২৭০ নারী, নিজ পরিবার কর্তৃক হত্যার শিকার হন ৩৪ নারী এবং নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যা করেন ৫৭ নারী। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ২৩৮টি। গৃহকর্মী নির্যাতন ও এসিড নিক্ষেপ ॥ ২০১৭ সালে ৪৩ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এর মধ্যে নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে গৃহকর্তার বাড়িতে মারা যান ২৬ জন। এ বছরে এসিড নিক্ষেপের শিকার হন মোট ৩২ নারী এবং এসিড নিক্ষেপের কারণে একজন মারা যান। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে গৃহকর্মী নির্যাতনের অনেক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রাপ্তির ঘটনা পারিবারিক বলয়ের অন্যান্য নির্যাতনের তুলনায় কম হয়।
×