ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপেক্ষায় আরও ১৯টি

’১৭ সালে মানবতাবিরোধী কোন মামলা আপীলে নিষ্পত্তি হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১ জানুয়ারি ২০১৮

’১৭ সালে মানবতাবিরোধী কোন মামলা আপীলে নিষ্পত্তি হয়নি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে ২০১৭ সালে কোন মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। আপীল বিভাগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট মীর কাশেম আলীর মামলার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর নতুন মামলার শুনানি হয়নি। যদি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সুবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং জাতীয় পার্টি (জাপা) নেতা সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলা কার্যতালিকায় আসলেও শুনানি হয়নি। শুধুমাত্র ২০১৬ সালে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১৫ মে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদ- বহাল রাখেন আপীল বিভাগ। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালে মাত্র দুটি মামলার রায় হয়েছে। সব মিলিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কিছুটা হলেও ধীর গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে আপীল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর আটক অবস্থায় পাঁচ আসামির মৃত্যুর পর ট্রাইব্যুনালে ১৪১ আসামির বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা চলছে। রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে মৌলভীবাজারের সামছুল হোসেন তরফদারসহ পাঁচ আসামির। যে কোন দিন এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রসিকিউশন পক্ষ বলছে, বিচার প্রার্থী ও দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। আদালতের স্বল্পতা এবং ৯২ দিন কোর্ট কার্যকর না থাকার ফলে যেসব মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা ছিল, তা কাক্সিক্ষত মাত্রায় হয়নি। চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে আপীলে একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে। তা হলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বড়ুয়া জনকণ্ঠকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপীল শুনানি না হওয়া আর ট্রাইব্যুনালে তুলনামূলকভাবে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াতে আমরা হতাশ। ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের মৃত্যুর কারণে ট্রাইব্যুনালে প্রায় ৯২ দিন বিচারকাজ বন্ধ থাকে। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করার পর আবার বিচার পুরোদমে শুরু হয়েছে। আমি আশাকরি আগামী বছরে বেশ কয়েকটি রায় পাব। বিচারদ্রুত না হলে আসামি ও সাক্ষীরা বয়সের ভারে মারা যাবেন। বিচারকাজ ব্যাহত হবে। অন্যদিকে তদন্ত সংস্থার সিনিয়র কর্মকর্তা সানাউল হক জনকণ্ঠকে বলেন, বিচার প্রার্থী ও দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। আদালতের স্বল্পতা এবং ৯২ দিন কোর্ট কার্যকর না থাকার ফলে যেসব মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা ছিল, তা কাক্সিক্ষত মাত্রায় হয়নি। আর যে সমস্ত মামলা সুপ্রীমকোর্টে আপীলে পেন্ডিং আছে সেসব মামলার আপীল নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভিকটিম, অত্যাচারিত, নির্যাতিত বা বিচার প্রার্থীদের এক ধরনের অতৃপ্তি আছে। এ নিয়ে তদন্ত সংস্থারও এক ধরনের অস্বস্তি আছে জানিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে আপীলের একটি বিশেষ বেঞ্চ করা যেতে পারে। সুপ্রীমকোর্টের এ্যাটর্নি কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলো দেখবেন বলে আমি মনে করি। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাসুদ রানা জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে আপীল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের ১৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর আটক অবস্থায় পাঁচ আসামির মৃত্যুর পর ট্রাইব্যুনালে ১৪১ আসামির বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা চলছে। রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে একটি মামলা। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। মামলার সংখ্যা বাড়াতে এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ নামে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। দীর্ঘ ৯২ দিন পর ২০১৭ সালে ১০ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, ২২ নবেম্বর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গাইবান্ধার সাবেক সাংসদ জামায়াত নেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়া (৬৫) ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয় আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। এর আগে ১৯ এপ্রিল তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ কিশোরগঞ্জের দুই রাজাকার মোঃ মোসলেম প্রধান ও পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান ওরফে হুসাইনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আরও ৩৩টি মামলায় ১৩৯ জন রাজাকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে একটি রায় ঘোষণার অপেক্ষায় ও অন্যগুলো সাক্ষ্য গ্রহণ ও চার্জ গঠনের জন্য রয়েছে। তদন্ত সংস্থা প্রথম থেকে এ পর্যন্ত (তদন্তাধীন ২৭টিসহ) ৭৬টি মামলায় ২১০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এখন পর্যন্ত ৪৯টি মামলার তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ৬৪৩টি অভিযোগে মোট ৩৫০২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত মুলতবি রয়েছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এই ৬৪৩টি অভিযোগ থেকে পর্যায়ক্রমে মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদ- প্রাপ্ত তারা ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করেছেন। আপীল বিভাগে ৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। আর আপীলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ১৯টি মামলা। এর সাতটি রায়ের মধ্যে ৬টিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই পক্ষেই রিভিউ আবেদন করেছেন। শুনানি চলার মধ্যেই জামায়াত নেতা গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। অন্যদিকে আপীল বিভাগে আরও ১৯ জনের মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোঃ মোবারক হোসেন (মৃত্যুদন্ড), হবিগঞ্জের সৈয়দ মোঃ কায়সার (মৃত্যুদন্ড), রংপুরের এটিএম আজহারুল ইসলাম (মৃত্যুদন্ড-), পিরোজপুরের আব্দুল জব্বার (আমৃত্যু কারাদন্ড), পাবনার আবদুস সুবহান (মৃত্যুদন্ড), চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান (আমৃত্যু কারাদ-), পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক (মৃত্যুদ-), বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার (মৃত্যুদন্ড-) ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান এবং ওবায়দুল হক তাহের (মৃত্যুদন্ড), কিশোরগঞ্জের এ্যাডভোকেট সামসুদ্দিন আহম্মেদ (মৃত্যুদন্ড), হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া (মৃত্যুদ-) ও মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া (আমৃত্যু কারাদন্ড-), জামালপুরের মোঃ সামসুল হক ওরফে বদরভাই ও এসএম ইউসুফ আলী (আমৃত্যু কারাদ-) এবং যশোরের সাখাওয়াত হোসেন (মৃত্যুদন্ড-)।
×