ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘসূত্রতায় ভাল কোম্পানির আগ্রহ কমছে

দুই বছরে বুক বিল্ডিংয়ে তিন কোম্পানির নিলাম

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১ জানুয়ারি ২০১৮

দুই বছরে বুক বিল্ডিংয়ে তিন কোম্পানির নিলাম

অপূর্ব কুমার ॥ শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলনে প্রিমিয়াম চাওয়া কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরে পাবলিক ইস্যু রুলস জারি করা হয়েছে। এরই মধ্যে এই রুলস জারি করার পরে প্রায় ২ বছর পার হয়ে গেলেও মাত্র ৩টি কোম্পানি নিলাম করার অনুমোদন পেয়েছে। তবে এর মধ্যে ১টি কোম্পানি নিলামের পর পরের ধাপে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন পেয়েছে। অর্থাৎ ২ বছরে মাত্র ১টি কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছে। এতে কোম্পানিগুলো ভোগান্তিতে পড়ে শেয়ারবাজারে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। যার কারণে বাজারে তালিকাভুক্তিতে অভিহিত মূল্যে আইপিও ছাড়তেই নাম সর্বস্ব কিছু কোম্পানি প্রাধান্য পাচ্ছে। অর্থাৎ নির্ধারিত মূল্যে কোম্পানিগুলো বেশি বাজারে আসছে। এর মধ্যে কিছু কিছু কোম্পানি তালিকাভুক্তির প্রথম দিনেই কয়েক শ’ গুণ দর বেড়েছে। ফলে লাভবান হয়েছে আইপিও শেয়ার বিজয়ীরা। বিপুল পরিমাণ টাকা প্রথম দিনেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। উল্টো দিকে প্রিমিয়ামে বা বুক বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে আসলে অন্তত প্রিমিয়ামের টাকাটা কোম্পানির কাজে আসত। কিন্তু বুক বিল্ডিংয়ের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। ফলে এক কথায় বলা যায় গত দুই বছর কিছু মৌল ভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি বাজারে আসার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার বছর। জানা গেছে, একটি কোম্পানিকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ‘রোড শো’ ও নিলামের দুইটি অতিরিক্ত ধাপ পার করতে হয়। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রথমে কোম্পানিগুলোর ‘রোড শো’ আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যাতে টাকা সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যাবতীয় বিষয়ে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা অবহিত হতে পারেন। এর পরবর্তীতে নিলামের জন্য নিলামের অনুমোদন পেতে হয়। প্রিমিয়ামসহ শেয়ারবাজারে আসতে চাইলে পাবলিক ইস্যু রুলস-২০১৫’তে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই পাবলিক ইস্যু রুলস জারি করা হয়েছে। এরই আলোকে বেশ কিছু কোম্পানি ‘রোড শো’ সম্পন্ন করেছে। তবে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ৩টি কোম্পানি নিলামের অনুমোদন পেয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রোড শো’ সম্পন্ন করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল এ্যাপোলো হাসপাতাল ‘রোড শো’ সম্পন্ন করেছে। এছাড়া একই বছরের ১২ এপ্রিল আমরা নেটওয়ার্ক, ৩০ জুন বসুন্ধরা পেপার মিল, ২৪ জুলাই আমান কটন ফাইবার্স, ৯ অক্টোবর বেঙ্গল পলি এ্যান্ড পেপার স্যাক লিমিটেড, ১৯ অক্টোবর রানার অটোমোবাইল, ২৪ অক্টোবর পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল, ৬ অক্টোবর ডেল্টা হসপিটাল, ১৮ অক্টোবর ইনডেক্স এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ‘রোড শো’ সম্পন্ন করেছে। এছাড়া ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল এস্কোয়ার নিট কোম্পোজিট, ১৯ এপ্রিল শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের, ১৫ অক্টোবর এনার্জিপ্যাক ইন্ডাস্ট্রিজ ও ৫ ডিসেম্বর লুব-রেফ বাংলাদেশ রোড শো সম্পন্ন করেছে। ‘রোড শো’ সম্পন্ন করা এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র আমরা নেটওয়ার্কের নিলাম শেষে বাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এছাড়া বসুন্ধরা পেপার মিল ও আমান কটন ফাইবার্সের বিডিং সম্পন্ন হয়েছে। জানা গেছে, আমরা নেটওয়ার্ক কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল ‘রোড শো’ সম্পন্ন করে। এতে ঋণ পরিশোধ, আধুনিকায়ন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে পুঁজিবাজার থেকে ৫৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করার কথা জানানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিডিংয়ের অনুমোদন পায় একই বছরের ২১ ডিসেম্বর এবং চলে চলতি বছরের ৫-৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর আইপিও অনুমোদন পায় ১৩ জুন। এরপরে ২ অক্টোবর কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরু করে। যাতে ওইদিন কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে টাকা ব্যবহারের জন্য সুযোগ পেয়েছে। এ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির রোড শো থেকে টাকা উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর সময় লেগেছে। বসুন্ধরা পেপার মিল ২০০ কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ৩০ জুন ‘রোড শো’ করে। কারখানার আধুনিকায়ন ও মেশিনারি আমদানি করার লক্ষ্যে এ টাকা সংগ্রহ করতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির ‘রোড শো’তে ২০১৬ সালের (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ের ব্যবসায়িক অবস্থা তুলে ধরা হয়। আর কোম্পানিটির নিলাম শুরু হয় ১৬ অক্টোবর। নিলামে কোম্পানিটির কাট অফ প্রাইস নির্ধারিত হয় ৮০ টাকা। আমান কটন শেয়ারবাজার থেকে ৮০ কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে চলতি বছরের ২৪ জুলাই রোড শো করে। কারখানায় আধুনিক মেশিনারি স্থাপন করবে কোম্পানিটি। যাতে ব্যয় করা হবে ৪৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। এছাড়া আইপিওতে উত্তোলিত অর্থ থেকে ১৭ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যবহার হবে ঋণ পরিশোধে, ওয়ার্কিং মূলধন হিসাবে ১০ কোটি টাকা ও আইপিওতে সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যবহার করা হবে। কোম্পানিটি এরই মধ্যে চলতি বছরের ৬ নবেম্বর বিডিং সম্পন্ন হয়েছে। কোম্পানিটির কাট অফ প্রাইস নির্ধারিত হয় ৪০ টাকা। ব্যবসায় সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ্যাপোলো হাসপাতাল শেয়ারবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে চায়। এক্ষেত্রে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল ‘রোড শো’ আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ২০১৫ সালের ব্যবসায়িক চিত্র তুলে ধরা হয়। ‘রোড শো’র পরে ২১ মাস পার হতে চললেও নিলামের অনুমোদন পায়নি। এএফসি ক্যাপিটালের সিইও মাহবুব এইচ মজুমদার বলেন, একটি কোম্পানির রোড শো করার পরেও এক বছরের বেশি সময় লেগে যায় নিলামের অনুমোদন পেতে। এরপরে আইপিও অনুমোদন পেতে আরও অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতে বুক বিল্ডিংসহ ফিক্সড পদ্ধতিতে আইপিও অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে উদ্যোক্তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটি কোম্পানিকে আইপিওতে নিয়ে আসতে যথেষ্ট সময় লাগে। একদিকে যেমন কোম্পানির প্রস্তুতি গ্রহণে সময় লাগে, অন্যদিকে ‘রোড শো’ করে তালিকাভুক্ত হতে যথেষ্ট সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের পদ্ধতিগুলো পর্যালোচনা করে যদি আমাদের আইপিও প্রক্রিয়াকে সহজ ও দ্রুত করা যায়, সেটা নতুন কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করবে। আরেকটি দিক হলো, ‘রোড শো’ এর অনেক পরে যখন নিলাম হলে, ওই সময়ের মধ্যে একটি কোম্পানির আর্থিক হিসাবসহ ব্যবসায় অনেক পরিবর্তন হয়। যাতে বিডিংয়ে ‘রোড শো’র কার্যকারিতা কমে যায়। এদিকে ‘রোড শো’ করার পরে বিডিং অনুমোদনে দীর্ঘ সময়ের ক্ষেত্রে কোম্পানির উদ্দেশ্য অনেক সময় ব্যাহত হয় বলে জানান মনিরুজ্জামান। একটি কোম্পানির টাকার দরকার এখন, কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে যদি এক বছর পরে পায় তাহলে তা কাজে লাগানো কঠিন। এছাড়া আগে আইপিও প্রক্রিয়া শুরু করে কোম্পানিগুলো ঋণ নিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে। যা আইপিওর টাকা দিয়ে পরিশোধ করা হতো। কিন্তু এখন আইপিওর টাকায় ঋণ পরিশোধে সীমাবদ্ধতা থাকায় তাও সম্ভব হচ্ছে না। আমরা নেটওয়ার্কের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মোঃ এনামুল হক বলেন, রোড শো এরপরে নিলামের অনুমোদন ও তা সম্পন্ন করতেই ১০ মাস সময় লেগে গেছে। এরপরে আইপিও অনুমোদন পেতে লেগেছে আরও ৫ মাস। এটা দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে একটি কোম্পানির অনেক পরিবর্তন হতে পারে। কোম্পানির মোটিভও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
×