ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজাউল করিম খোকন

ক্ষুদ্র বীমার বিকাশ ॥ দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

ক্ষুদ্র বীমার বিকাশ ॥ দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা

এখন দারিদ্র্য বিমোচনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গৃহীত কর্মসূচী ইতোমধ্যে সুফল বয়ে আনছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচী, উদ্যোগ প্রচেষ্টার কারণে দারিদ্র্যের হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। এসব দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। যার ফলশ্রুতিতে জীবনমানের বেশ উন্নতি ঘটেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এসব দেশের অবহেলিত, অনুন্নত জনপদের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে ক্রমেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। যে কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য এখন অনেকটা কম সময়ে সহজভাবে বাজারজাত করতে পারছে দরিদ্র কৃষক। অতীতে তারা তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য সঠিকভাবে যথাসময়ে বাজারজাত করতে না পারায় উপযুক্ত মূল্য পেত না। তারা কঠোর পরিশ্রম করে কৃষি পণ্য উৎপাদন করলেও তার সঠিক মূল্য না পাওয়ায় দারিদ্রের কঠিন বেড়াজালে বন্দী হয়ে কাটিয়েছে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা দীর্ঘদিনেও। এখন দারিদ্র্য দূরীকরণে গৃহীত নানা উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা বলতে পারি, ক্ষুদ্র ঋণ ও পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর নানা উদ্যোগ এখানকার দারিদ্র্য বিমোচনে অভাবনীয় সাফল্যের নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনের বিশ^ব্যাপী রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন গ্রামীণ ব্যাংকের অনুসরণে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই ক্ষুদ্র ঋণের নানা উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কৃষিখাত থেকে শুরু করে গবাদীপশু পালন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন, হাঁসমুরগির খামার প্রতিষ্ঠা মৎস্য চাষ, গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা স্থাপন এবং অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত হচ্ছেন দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। তারা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সরকারী এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, এনজিও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা, ঋণ গ্রহন করে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগে সম্পৃক্ত করছেন নিজেদের। যে কোন ধরনের উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং ব্যবসায় কম বেশি ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য গৃহীত উদ্যোগ ও পদক্ষেপগুলোতে ঝুঁকির মাত্রাটা থাকে বেশি। ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, পাহাড়ধস, অগ্নিকা- নানা প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, প্রভৃতির কারণে তাদের গৃহীত নানা উদ্যোগ ঝুঁঁিকর মধ্যে পড়ে যায়। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকা-গুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আবার অতিমাত্রায় ঝুঁকির কারণে অনেকে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে কোনরকম উদ্যোগ গ্রহণে সাহসী হয় না। বরং তা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখতে চায়। এভাবে তারা সময়ের সঙ্গে সামনে এগিয়ে থাকার বদলে ক্রমেই পিছিয়ে থাকছে। যদি তাদের গৃহীত উদ্যোগগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য নিরাপত্তামূলক কোন ব্যবস্থা থাকে তাহলে তারা অনায়াসেই সমৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। এ জন্য বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে পারে সহায়ক ক্ষুদ্র বীমা পণ্য নিয়ে। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষক, গ্রামের সাধারণ দরিদ্র গৃহবধূর ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্যোগগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় ক্ষুদ্র বীমা (গরপৎড় ওহংঁৎধহপব) বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। দক্ষিন এশিয়া অঞ্চলে শহরের দরিদ্র শ্রেণী এবং গ্রামের সাধারণ কৃষক নি¤œ আয়ের মানুষ, ভূমিহীন মানুষ তাদের ভাগ্য বদলে বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও কিংবা অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ সহায়তা নিতে আগ্রহী হলেও বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারনে তাদের গৃহীত উদ্যোগ মাঝপথে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় তারা বিদ্যমান বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারে না। গৃহীত ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের জীবনে নেমে আসে নানা হয়রানি। তাদের প্রতিটি উদ্যোগে যদি বীমার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তা ঝুঁকিমুক্ত হয়ে উঠতে পারত। বড় বড় ঋণের বিপরীতে বীমা করা থাকায় তা ঝুঁকিমুক্ত হয়ে ওঠে। ঠিক সেভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণে গৃহীত ক্ষুদ্র বিনিয়োগ উদ্যোগগুলোতে ক্ষুদ্র বীমা (গরপৎড় ওহংঁৎধহপব) এর প্রচলন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিতে পারে। বিষয়টি উপলব্ধি করে ভারত সহ দক্ষিন এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে সাধারণ নি¤œবিত্ত দরিদ্র, কৃষক শ্রেণীর গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় বীমা কোম্পানিগুলো সহায়ক বীমা পণ্য প্রচলন করেছে যেগুলো ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছেও। অথচ বাংলাদেশে তেমনভাবে ক্ষুদ্র বীমা ব্যবস্থার প্রচলন হয়নি এখনও। বীমা সুবিধা না থাকার কারণে দরিদ্র মানুষগুলোর গৃহীত নানা উদ্যোগ যেখানে বার বার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে তা দূরীভূত হবে ক্ষুদ্র বীমা (গরপৎড় ওহংঁৎধহপব) ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে। দরিদ্র দূরীকরণের মাধ্যমে যখন এ অঞ্চলের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, জীবনমানের উন্নয়ন ঘটছে সেখানে স্বাভাবিকভাবে ক্ষুদ্র বীমা বাজারের (গরপৎড় ওহংঁৎধহপব গধৎশবঃ) বিস্তৃতির সুযোগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, সাধারণ দরিদ্র কৃষক গ্রামীণ মানুষের গৃহীত ব্যবসা শিল্প কৃষি উদ্যোগের সহায়ক নতুন নতুন বীমা পণ্য (ওহংঁৎধহপব চৎড়ফঁপঃ) নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশে শস্য বীমা চালু হলেও এটা তেমন ব্যাপকতা লাভ করেনি বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে। কৃষকদের শস্য বীমার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য তেমন কার্যকর পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে শস্য বীমা ব্যাপকভাবে চালু হলে কৃষি খাতে এক ধরনের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তাবোধ সৃষ্টি হতো। কৃষি অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব সৃষ্টিতে শস্য বীমা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে, এটা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। দরিদ্রতাকে ‘নিয়তির লিখন, যাবে না খ-ন’ মনে করে অনেকেই ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে চায় না। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে যদি মাঝপথে ব্যর্থ হতে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, অগ্নিকা- কিংবা অনাকাক্সিক্ষত কোন পরিস্থিতির কারণে তেমন আশঙ্কা এ ক্ষেত্রে তাদেরকে পিছিয়ে দেয় বার বার। এ ক্ষেত্রে বীমা তাদের মনে সাহস যোগাতে পারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে। এর মাধ্যমে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি গোটা অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির নতুন গতি সঞ্চার হতে পারে। লেখক : ব্যাংকার
×