ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হোসাইন ইমরান

শীতের আবহে রূপসী ক্যাম্পাস

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

শীতের আবহে রূপসী ক্যাম্পাস

অন্ধকারের বলয় অতিক্রম করে প্রকৃতি তখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। পরিচিত লোকটিও হঠাৎ করে সামনে পড়লে তখন ক্ষণিকের জন্য হয়ে ওঠে অপরিচিত। কুয়াশার এই ধূ¤্রজাল চিরে পূর্বাকাশে সূর্যের ঝিকিমিকি আলো ঘণ্টাধ্বনির মতো জানান দেয় সকাল হওয়ার খবর। কোমল সূর্যরশ্মিতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো মুক্তদানার মতো ঝলমল করে। গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ আর পাখিদের কলরব আন্দোলিত করে মন। কী স্নিগ্ধময় গ্রামবাংলার শীতের সকাল! প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যে ঘেরা গ্রামবংলার সকালের সঙ্গে শহরের নাগরিক জীবনের সকালের তফাৎটা যে কারওই চোখে পড়ার মতো। তবে এ দুয়ের মেলবন্ধন ঘটে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে। কেননা এখানে একদিকে যেমন রয়েছে প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে নাগরিক জীবনের মতো পিচঢালা রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা ইটের দালান। শীতের ¯িœগ্ধতা গ্রাম কিংবা শহরের মানুষের জীবনকে ভিন্ন দুই মেরুতে রেখে আন্দোলিত করলেও এ দুই মেরুকে অভিন্ন রেখায় মিলিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আর তা একমাত্র অনুভূত হয় ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মনে। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতের সময়ে ক্যাম্পাসের নানা আয়োজন, উৎসব ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শীতের আবহকে উপভোগ করার গল্প। শীতের সময় ক্যাম্পাসে প্রথমেই চোখে পড়বে পোশাকের পরিবর্তন। এ সময় গ্রীষ্মের হাফছাড়া দিনের মতো কাউকে টি-শার্ট পরে ঘুরতে দেখা যায় না। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবার পরনে দেখা যায় বাহারী রঙের সোয়েটার, ব্লেজার কিংবা জ্যাকেট। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের নামে তৈরি করা হুডিগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়াও বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন মিলে পছন্দের উক্তি বা লাইন জড়িয়ে দিয়ে তৈরি করেন নানান রঙের হুডি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আবু রাইহান বলেন, প্রতিবছরই আমরা বন্ধুরা মিলে হুডি তৈরি করি। শীতের সময় পোশাক হিসেবে নিজেদের ডিজাইনে তৈরি করা হুডি কিংবা সোয়েটারগুলোই পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকে। কনকনে শীতের পড়ন্ত বিকেলে ভারি কাপড় কিংবা চাদর গায়ে জড়িয়ে চায়ের টঙের আড্ডাগুলোও বেশ জমে ওঠে। চায়ের কাপের প্রতিটি চুমুকই যেন শীতের আমেজকে উপভোগ করার অন্যতম মাধ্যম। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিহা ইয়াসমিন বলেন, বন্ধুরা সবাই একসঙ্গে মিলে প্রতিদিন নিয়ম করে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় আড্ডা দেয়া হয়। গরমের অসহ্য দিনের মতো পালিয়ে বেড়াতে হয় না শীতের সময়ে। গল্পের আসরে সিঙ্গারা, পিয়াজু, বেগুনীর মতো হরেক রকমের ভাজাপোড়া খাবারের স্বাদটুকু বাড়তি আনন্দের খোরাক যোগায়। পৌষের হিমেল হাওয়া ছাড়া যেমন শীতকে কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি পিঠা ছাড়াও বাঙালির ঐতিহ্য ভাবা যায় না। তবে অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন পিঠা যেমন দেখা যায়, তেমনি ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসেও পিঠার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। একেকটি পিঠার বিভিন্ন নামের বাহার যেন পিঠা খাওয়ার আকাক্সক্ষা আরও বাড়িয়ে দেয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম ফয়সাল বলেন, নারকেলের পিঠা, পাকান পিঠা, বিউটি পাঁপড়ি, পুলিপিঠা, রসের পিঠা তাদের ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ পছন্দের। অনেকে আবার মায়ের হাতের পিঠা খেতে পাড়ি জমান গ্রামের বাড়িতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শ্রীবাস দাস বলেন, শীতের আমেজকে উপভোগ করতে গ্রামের বাড়িতে যেতেই হবে। মায়ের হাতের বানানো পিঠার লোভ হাঁড়কাঁপানো শীতের সকালে কম্বলের নিচের ওম থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে। বারবিকিউ কিংবা চড়ূইবাতির আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় প্রতিষ্ঠিত এতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাগের বন্ধু-বান্ধবী কিংবা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মীরা মিলে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। নিজ হাতে বানানো নান বা পরটার সঙ্গে পোড়ানো মুরগি চিবানোর মাধ্যমে শীতকে উপভোগ যেন এক ভিন্ন মাত্রার আনন্দ। কখনও কখনও এর সঙ্গে থাকে ফানুস উড্ডয়ন বা ফায়ারওয়ার্কিংয়ের মতো মজার খেলা। এই শীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য সংগঠন ‘দিক থিয়েটার’ আয়োজন করেছিল ‘বারবিকিউ’ এর। ঢোল আর কাহনের তালের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাওয়া চিরায়ত বাঙালী সংস্কৃতির কালজয়ী গানের মূর্ছনায় যেন শীতের রেশ কেটে যায়। সংগঠনের সভাপতি এহসান শুভ বলেন, প্রতিবারই শীতের সময়ে সকল সদস্যদের নিয়ে আয়োজন করা হয় এমন অনুষ্ঠানের। মূলত শীতের আবহকে সকলে মিলে উপভোগ করার লক্ষ্যেই এমন আয়োজন। প্রকৃতিতে বর্তমানে শীতের আগমন ঘটে ইংরেজী বছরের শেষের দিকে এবং এর ব্যাপ্তিকাল থাকে বছর শুরুর মাস দুয়েক পর্যন্ত। এ সময়ে ক্লাস-পরীক্ষার চাপ বছরের অন্য সময়ের তুলনায় কম থাকে। সারা বছরের ক্লাস-পরীক্ষার যাঁতাকালে সৃষ্ট গ্লানি মুছে দিয়ে ক্লান্ত মন ও শরীরকে নতুন উদ্দীপনায় তৈরি করতে সকলেই এ সময়টা বেছে নেয়। প্রকৃতিও তার অপার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হতে থাকে তখন। প্রকৃতির রূপের নব নব ঢেউ আকৃষ্ট করে ভ্রমণ পিপাসুদের। সবমিলিয়ে ক্যাম্পাস জীবনে ঘোরাঘুরি কিংবা ভ্রমণের উপযোগী সময় এটাই। তাই শীতের সময়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করতে বেরিয়ে পড়েন অনেকেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী তৃনা সরকার বলেন, শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ঘোরাঘুরি করাটা অন্য সময়ের তুলনায় সুবিধাজনক। এই সময় ঝড়-বৃষ্টির ঝামেলা পোহাতে হয় না। তাই পছন্দের যে কোন জায়গা থেকে সহজে ঘুরে আসা যায়। বিভাগ ভিত্তিক ট্যুরের আয়োজন শেষ করে ফেলা হয় সাধারণত শীতের সময়। ট্যুরের জন্য বেছে নেয়া হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, সিলেট কিংবা সেন্টমার্টিনের নৈঃসর্গিক সৌন্দর্যম-িত স্থানগুলো। একটু আলাদা করে বলতে হয় দেশের অন্যতম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরের কথা। এখানে যেন শীত একটু ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসে। শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসে আগমন ঘটে হাজারো অতিথি পাখি। তাদের কলকাকলি আর উড়া-উড়িতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের প্রায় ডজনখানেক স্বচ্ছ পানির লেকে ফুটে থাকা রক্তকমলের মাঝে জলকেলিতে মেতে উঠে ওরা। এই অতিথি পাখিদের দেখতে ক্যাম্পাসে ছুটে আসে ঢাকা শহর ও তার আশপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। হাজারো অতিথি পাখি আর তাদের দেখতে আসা অতিথিদের উৎসবমুখর পদচারণায় ক্যাম্পাসে তৈরি হয় অন্যরকম আনন্দময় আবহ। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে নাভিশ্বাস ওঠা দিনকে অতিক্রম করে শীতের ¯িœগ্ধ আবহাওয়া জীবনে নিয়ে আসে প্রশান্তির ছায়া। তবে এই শীতই অসহায়, দরিদ্র মানুষের জীবনে নিয়ে আসে দুঃখ, কষ্ট আর গ্লানি। সেই অসহায়, হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসে বিভিন্œ ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। গৃহহীন, ছিন্নমূল এসব মানুষদের সাহায্যের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এমনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বপ্নোত্থান’। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের রুমে গিয়ে অব্যবহৃত পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে তা শীত নিবারণের জন্য পৌঁছে দেয় অসহায় বস্ত্রহীন মানুষের কাছে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী কবির বলেন, সকল মানুষেরই কর্তব্য শীতের সময়ে অসহায় বস্ত্রহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সচ্ছল একজন মানুষের একটুখানি সহানুভূতি সম্বলহীন মানুষটির জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে দিতে পারে। শীত তখনই আনন্দের হবে, যখন আমরা এর প্রচ- প্রকোপ থেকে সকল মানুষকে রক্ষা করতে পারব। সকল মানুষের জন্য শীত নিবারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।
×