ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুরলোকে বিনিদ্র রজনী

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

সুরলোকে বিনিদ্র রজনী

গৌতম পাণ্ডে ॥ তারার স্বর সুর হয়ে যেন মর্মে পৌঁছে গেল। আলাপ থেকে শুরু করে তান পর্যন্ত শুধুই সুরের খেলা। সুরলোকের রঙ্গীন ভুবনে একাই রাজত্ব করছেন। মনে হচ্ছিল, সুরদাত্রী উজাড় করে সবটুকুই দিয়ে দিয়েছেন ওস্তাদ রশিদ খানের কণ্ঠে। ওস্তাদের চোখ-মুখের ভাষা ক্ষণে ক্ষণে যেন বলে দিচ্ছে, হে সুরপ্রদায়িনী আমাকে আরও-আরও-আরও দাও। আমি তোমার সুরনৈবেদ্য দিয়ে তোমারই ভক্তদের পূজা করব। ধীরে ধীরে সত্যিই তাই ঘটল। বলছিলাম বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের চতুর্থ রজনীর কথা। রাজধানীর আবাহনী মাঠ শ্রোতার উপস্থিতিতে কানায় কানায় ভর্তি প্রায় মধ্যরাত। ওস্তাদ রশিদ খান গাইছেন ‘রাগ পুরিয়া’। আলাপ দিয়েই শুরু। কণ্ঠের কাজের পাশাপাশি মিড়ের ব্যবহার এত সুন্দর দিচ্ছেন, থেকে থেকে দর্শক উচ্ছ্বসিত হয়ে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার প্রবাদপ্রতীম এই শিল্পী পুরিয়া’র পরে নিজের সৃষ্টি ‘প্রিয়ারঞ্জনী’ রাগে খেয়াল পরিবেশন করেন। এ সময় তার সঙ্গে কণ্ঠ সহযোগী ছিলেন নাগনাথ আদগাঁওকার। তবলায় সঙ্গত করেন প-িত শুভঙ্কর ব্যানার্জি। হারমোনিয়ামে ছিলেন অজয় যোগলেকর এবং সারেঙ্গিতে ছিলেন ওস্তাদ সাবির খান। পরিবেশনা শেষে মহান এই শিল্পীর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এরপর মঞ্চে আসলেন সরোদ ও বেহালার দুই দিকপাল। প-িত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ। ‘রাগ সিমেন্দ্রমধ্যম’ দিয়েই শুরু তাদের যুগলবন্দী। দুজনের সুরতরঙ্গ যেন কোথায় গিয়ে একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সঙ্গীত হৃদয় দিয়ে অনুভবের বিষয় বলেই সুরতরঙ্গের বর্ণনা কঠিন। উভয়ের বাদন যখন ঘনিভূত হতে শুরু করেছে এরই ফাকে পণ্ঠিত যোগেশ শামসির তবলা আর অর্জুন কুমারের মৃদঙ্গ দেখাল ভানুমতির খেল। অসাধারণ লহড়া দুজনের। মুহুর্মুহু করতালিতে মাঠজুড়ে অন্যরকম আবহ তৈরি হলো। এ রাতের অন্যরকম আকর্ষণ প-িত যশরাজ। মঞ্চে এসেই বললেন, আমি কিছু সময়ের জন্য সবাইকে ধ্যানস্ত করতে চাই। সতিই তাই যেন করলেন। ‘যোগ’ রাগ দিয়েই শুরু হলো তার খেয়াল। গলায় রুদ্রাক্ষ মালা আর আর্দি পাঞ্জাবীতে মানিয়েছিলও বটে। ওস্তাদী ঢং যাকে বলে, তার কোনটারই ঘটতি নেই। তানের কারুকাজে থেকে থেকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে রত্তন মোহন শর্মার কণ্ঠ পুরো পরিবেশটাকে অন্যলোকে নিয়ে যায়। দর্শকদের ভিন্ন স্বাদ দেয়ার জন্য রামকুমার মিশ্রর তবলা ও শ্রীধার পার্থসারথীর মৃদঙ্গের লহড়া ছিল চোখে পড়ার মতো। শিল্পী যশরাজ যোগ রাগের পর দুর্গা রাগে ভজন পরিবেশন করেন। হারমোনিয়ামে ছিলেন প-িতা তৃপ্তি মুখার্জী। চেলো নামের বাদ্যযন্দ্র সম্পর্কে ধারণা অনেকেরই নেই। এই যন্ত্র দিয়ে যে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছনো যায় এটা দেখালেন শিল্পী সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে এই তার প্রথম আসা। মধ্যরাত অতিক্রম প্রায়। অসাধারণ নৈপুন্যে তিনি পরিবেশন করলেন ‘রাগ নন্দকোষ’। এ রাগের পর তার হাত দিয়ে বাজতে থাকে চিরচেনা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর। দর্শকের বুঝে নিতে একটুও বেগ পেতে হয়নি। তিনি যখন সুর তুললেন ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, তখন মাঠজুড়ে করতালিতে কম্পমান। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত যোগেশ শামসি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কু-ু ও টিংকু কুমার শীল। রাত গড়িয়ে ভোর। শেষ পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে এলেন ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী প-িত বুধাদিত্য মুখার্জী। সেতারের মুর্চ্ছনায় মুগ্ধ করে তুললেন সবাইকে। শুরুতে বিনয়ের সাথে বললেন, আমি ধন্য এখানে বাজানোর সুযোগ পেয়ে। আর আপনারা সারারাত জেগে বসে আছেন আমার বাজনার জন্য, আমি কীভাবে আপনাদের ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। বাজনা আরম্ভের আগে একটি ইউনিক কথা জানাতে চাই। আমার জন্মের অনেক আগে থেকে এই অপূর্ব দেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। কারণ ময়মনসিংহে আমার ঠাকুর দাদা মশাই সিভিল সার্জন ছিলেন। আমার গুরু আমার পিতা প-িত বিমলেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত শিক্ষাও সেই সময় ময়মনসিংহে আরম্ভ হয়। আমার জন্যে তাই অসাধারণ মুহূর্ত আজ। সেই সম্পর্কটা আবার উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি আপনাদের মাঝে এসে। কথার পর প্রভাতী রাগ ললিত দিয়েই শুরু করেন তার পরিবেশনা। তিনি এই রাগের বিস্তার, গৎ ও ঝালা পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সৌমেন নন্দী।
×