ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১২ মাসই দালালের দখলে

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

১২ মাসই দালালের দখলে

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটের লঞ্চের কেবিনের টিকেট দালাল ও অসাধু লঞ্চ কর্মচারীদের হাতে চলে যাওয়ায় টিকেট পেতে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের বারো মাসই চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। লঞ্চ মালিকরা ইচ্ছেমতো আত্মীয়স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেবিনের টিকেট দিলেও সাধারণ মানুষ জিম্মি এসব টিকেট কালোবাজারির হাতে। কেবিনের নির্ধারিত মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দিলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটে লঞ্চের কেবিনের টিকেট। একাধিক যাত্রী জানান, লঞ্চের কেবিনের টিকেট পেতে হলে যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা না থাকলে টিকেট মিলছে না। নগরীর প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা তার আত্মীয়, প্রশাসনের কর্মকর্তা হলে অনায়াসেই মিলছে লঞ্চের টিকেট। এ ব্যাপারে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের দাবি, যে সংখ্যায় যাত্রী রয়েছে, সে অনুযায়ী কেবিন না থাকায় সবাইকে টিকেট দেয়া যাচ্ছে না। যাত্রীদের দাবি মালিক পক্ষের অবৈধ রোটেশন প্রথার কারণেই লঞ্চের টিকেট নিয়ে দালাল ও লঞ্চ কর্মচারীরা যাত্রীদের জিম্মি করে রেখেছে। এছাড়া সরকারীভাবে কোন মনিটরিং না থাকায় লঞ্চের টিকেট যাচ্ছে দালালের হাতে। ফলে বৈধভাবে সাধারণ যাত্রী টিকেট পাচ্ছেন না।নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেবিনের টিকেট কালোবাজারে বিক্রি করা দালালরা জানান, লঞ্চ মালিক, প্রশাসন, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই তারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ ব্যবসা করে আসছেন। তবে দালালের বিরুদ্ধে সব সময় নীরব ভূমিকা পালন করছেন নৌ পুলিশ। তাদের (নৌ পুলিশ) সামনেই এসব দালাল বীরদর্পে তাদের ব্যবসা চালিয়ে এলেও বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই। সূত্রমতে, ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। বিশেষ করে অধিকাংশ অসুস্থ রোগী সড়কের পরিবর্তে নৌপথে বরিশাল থেকে ঢাকায় যাতায়াত করে থাকেন। এ কারণেই নৌপথের লঞ্চের টিকেট নিয়ে সক্রিয় একটি শক্তিশালী দালাল চক্র। ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে চলাচলকারী উল্লেখযোগ্য লঞ্চের মধ্যে অন্যতম মেসার্স রাবেয়া শিপিং কোম্পানির পারাবত। মেসার্স সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির সুন্দরবন। মেসার্স স্টার নেভিগেশন কোম্পানির সুরভী। টিপু কোম্পানির এমভি টিপু এবং কীর্তনখোলা। এসব লঞ্চের মধ্যে পারাবত লঞ্চের ৮০ ভাগ কেবিনই দালালের হাতে চলে যায় লঞ্চের কেরানি, বুকিং কাউন্টারের বুকিং ক্লার্ক, লঞ্চ ম্যানেজার ও সুপারভাইজারের মাধ্যমে। বাকি কেবিনগুলো প্রশাসন, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মালিক পক্ষের লোকজন পাচ্ছেন। টিপু, ফারহান লঞ্চের কেবিনও একইভাবে দালালদের হাতে চলে যাচ্ছে। এসব কেবিন দুই থেকে তিনগুণ দামে দালালের কাছ থেকে কিনে নিতে হয় সাধারণ যাত্রীকে। এছাড়া লঞ্চ স্টাফদের যোগসাজশে বিলাসবহুল সুন্দরবন, সুরভী ও কীর্তনখোলা লঞ্চের কেবিনও মিলছে দালালের কাছে। মাঝে মধ্যে সরকারী-বেসরকারী কোঠার কেবিনগুলোও কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কিনে নেয় দালালরা। দালালদের দাবি বর্ষা মৌসুম, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সময় লঞ্চের কেবিনের চাহিদা থাকে কম। ওই সময় তারা লঞ্চের কেবিন বিক্রি করে লঞ্চ মালিকদের সহায়তা করে থাকেন। এ কারণেই মূলত মালিক পক্ষ তাদের লঞ্চের কেবিন দিয়ে থাকেন। তবে তাদের এসব দাবি অস্বীকার করেছেন লঞ্চ মালিকরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, লঞ্চের টিকেট কালোবাজারিদের মধ্যে অন্যতম লেদু (দালাল)। তিনিই মূলত লঞ্চের টিকেট কালোবাজারি শুরু করেছেন। এরপর এ কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দালাল হাসেম, পারাবত লঞ্চের স্টাফ সাগর, কলম্যান জসিম, সেলিম, বসির, কলম্যান ফজলা, খোকন, কালামখান লঞ্চের কলম্যান আলাউদ্দিন, মোশাররফ, জাহাঙ্গীর ও ইমাম, টিপু লঞ্চের কলম্যান দুলাল, খালেক, সুন্দরবন লঞ্চের কলম্যান জাহিদ, কবির হোসেনসহ অনেকে। তবে লেদু, হাসেম, জসিম ও সেলিমই বর্তমানে চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। দালাল হাসেম জানান, তাদের কাছ থেকে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই টিকেট নিয়ে থাকেন। তারা সবাইকে খুশি করেই লঞ্চ ঘাটে এ ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লঞ্চ মালিক সমিতির একাধিক সদস্য জানান, রোটেশন পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিআইডব্লিউটিএর ব্যাপার। যদি তারা আমাদের ডাকে তবে অবশ্যই আমরা তাদের সঙ্গে বসে এ সমস্যা সমাধান করব। এ ব্যাপারে বিআইডবি¬উটিএর বরিশাল জোনের উপ-পরিচালক আজমল হোসেন মিঠু সরকার বলেন, কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বরিশাল নৌ পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোতালেব হোসেন বলেন, দালালের বিরুদ্ধে নৌ পুলিশ সোচ্চার। এ ব্যাপারে লিখিত কোন অভিযোগ পেলে অব্যশই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×