ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বছরজুড়ে আলোচনায় ব্যাংক খাত

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

বছরজুড়ে আলোচনায় ব্যাংক খাত

রহিম শেখ ॥ বেসরকারী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক রদবদল আর চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর দুরবস্থা ছিল বছরজুড়ে আলোচিত বিষয়। চলতি বছরের শুরুতেই বেসরকারী ইসলামি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আসে পরিবর্তন। জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ লালিত পরিচালনা পর্ষদকে হটিয়ে নয়া পর্ষদ যাত্রা শুরু করে। এরপর মালিকানায় পরিবর্তন আসে সোস্যাল ইসলামী ও আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে। আর বছরের শেষ দিকে এসে ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করেন ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ পর্ষদের একাধিক সদস্য। পাশাপাশি চলতি বছরের জুনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবনায় ব্যাংক হিসেবের ওপর আবগারি শুল্কের ঘোষণায় ওঠে সমালোচনার ঝড়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মূলধন যোগানের দাবিতে আলোচনা-সমালোচনা ছিল বছরের মধ্য ভাগের আলোচিত ঘটনা। জানা গেছে, দেশে বর্তমানে সরকারী- বেসরকারী মিলে ব্যাংকের সংখ্যা ৫৭টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংকের অবস্থাই খারাপ। আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ১৪টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংক আটটি। এছাড়া বেসরকারী খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়েও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সেগুলো চালু রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যমান বেসরকারী চালু ব্যাংকগুলো যেখানে ভাল চলছে না, সেখানে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের তোড়জোড় চলছে। এদিকে নানা অনিয়মে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপী ঋণের পরিমাণ। সেই সঙ্গে প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিও বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর’১৬ শেষে ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। (জুন-সেপ্টেম্বর’১৭) তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী বেড়েছে ছয় হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপী ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। সরকারী ও বেসরকারী খাতের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ৪২১ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। বিদায়ী বছর কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আকস্মিক পরিবর্তন ও খেলাপী ঋণের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত ছিল আলোচনায়। ঘটেছে একের পর এক অস্বাভাবিক বড় বড় কেলেঙ্কারি। বছরের শুরুতেই বেসরকারী খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আসে পরিবর্তন। জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ লালিত পরিচালনা পর্ষদকে হটিয়ে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে। ওই সময় পদত্যাগ করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান। পরে ওই পদে দায়িত্ব নেন ইউনিয়ন ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হামিদ মিয়া। এরপর গত ৩০ অক্টোবর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন হয়। ওইদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)কে হঠাৎ পদত্যাগ করতে হয়। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পর পরিচালনা পর্ষদের সভায় এক সঙ্গে ৭ পরিচালক পদত্যাগ করেন। ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২৭ নবেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এছাড়া ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক মাহাবুবুল হক চিশতীকেও পদ ছাড়তে হয়। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি পদে রদবদল করে পরিচালনা পর্ষদ ঢেলে সাজানো হয়েছে। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে পরিবর্তন এসেছে। এরপর গত ২১ ডিসেম্বর আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হকসহ পরিচালনা পর্ষদের তিন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। পাশাপাশি চেয়ারম্যানসহ তিন পরিচালক নির্বাচন করা হয়। যার মধ্য দিয়ে ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খানের যুগ শেষ হয়। বিদায়ী বছরে ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তনের মাঝেই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারী আলোচনায় উঠে আসে। আদালতের নির্দেশে বছরের একেবারে শেষ ভাগে এসে গত ৪ ও ৬ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন দুই দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বেসরকারী খাতের ব্যাংকে মালিকানায় পরিবর্তন আসতেই পারে। তবে বর্তমানে যা হচ্ছে, তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে যেন ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থার ঘাটতি না হয়। এমনটি হলে দায়দায়িত্ব নতুন মালিকদের ওপরই বর্তাবে। তিনি আরও বলেন, যারা এভাবে ব্যাংক অধিগ্রহণ করছেন, তারা ইসলামি ব্যাংকগুলোর প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা আছে, বিষয়গুলো পরিষ্কারের দায়িত্ব তাদেরই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের মালিকানা ওই পরিবারগুলোর মধ্যে স্থায়ী করার উদ্যোগ এটি। এটা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক স্বার্থ ও স্বজনপ্রীতির কারণে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা বড় ধরনের রাজনৈতিক দুর্নীতি মনে করি। কারণ, ব্যাংকের আসল মালিক আমানতকারীরা। আমানতকারীদের টাকা অন্যদের কাছে ঋণ দিয়ে ব্যাংকের ব্যবসা পরিচালনা হয়। এসব মালিকদের অনেকেই কোন পুঁজি বিনিয়োগ না করে ব্যাংকের মালিক-পরিচালক হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম দুর্নীতি পাশাপাশি আলোচনায় ছিল ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্কহার। বিদায়ী বছরের ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মহিত ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্কহার বাড়ানোর সুপারিশ করেন। এ প্রস্তাবে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ ও সংসদ সদস্যদের তীব্র সমালোচার মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে সরকারও। ফলে শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাব থেকে সরে আসার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে নতুন হার নির্ধারণের সুপারিশ করেন প্রধানমন্ত্রী। আর সেই সুপারিশ আমলে নিয়ে কিছু সংশোধন করে সংসদে অর্থবিল পাস হয়।
×