ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গত ৭ বছরে সর্বনিম্ন আইপিও অনুমোদন

আইপিও কমে যাওয়ায় জিডিপিতে শেয়ারবাজারের অবদান হ্রাস

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

আইপিও কমে যাওয়ায় জিডিপিতে শেয়ারবাজারের অবদান হ্রাস

অপূর্ব কুমার ॥ হু হু করে এগিয়ে চলছে দেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়াসহ আর্থিক সবগুলো সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আশা জাগানিয়া সাফল্য অর্জন করেছে। উদীয়মান টাইগার হিসেবেও দেশের অর্থনীতি বিকাশ লাভ করছে দ্রুতই। কিন্তু তাতে পুঁজিবাজারের অবদান ঠিক কতটুকু সেটি এখনও প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ দেশের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারবাজারের ভূমিকা কম বেড়েছে। পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর তুলনায় আরও পিছিয়েছে। এর পেছনের বাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তি কমাও বড় কারণ। বাজারের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন কোম্পানি আসেনি। তাই ভালমানের অধিক কোম্পানি বাজারে এনে তালিকাভুক্তি না বাড়াতে পারলে জনগণকে সম্পৃক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের জিডিপির তুলনায় পুঁজিবাজারের আকার ছোট বলে অনেকেই সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু সেটি থেকে বেরুতে হলে বাজারে বড় কোম্পানি আনতে হবে। কিন্তু এখন এসে ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছে। গত ২০১৭ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) রেকর্ড খুব খারাপ হয়েছে। কারণ বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন কোম্পানির আইপিওতে আবেদন হয়েছে। ফলে গত অর্থবছরে জিডিপিতে শেয়ারবাজারের মূলধন আরও কমেছে। এছাড়া আইপিও অনুমোদন কমে যাওয়া আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেখা গেছে, শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে ২০০৪ সালের পরে ২০১৭ সালে সবচেয়ে কম কোম্পানির আইপিওতে আবেদন (সাবস্ক্রিপশন) হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১৩ বছরের মধ্যে ২০১৭ সালে সবচেয়ে কম কোম্পানি আইপিওতে আবেদন সম্পন্ন করেছে। এ বছর মাত্র ৭টি কোম্পানির আইপিওতে আবেদন হয়েছে। ২০০৪ সালে মাত্র ২টি কোম্পানির টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে আইপিওতে আবেদন হয়েছিল। এরপরের ১৩ বছরের মধ্যে ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি ২০ কোম্পানির আইপিওতে আবেদন হয়েছে। আর ২০১৭ সালে সবচেয়ে কম ৭টি কোম্পানির আইপিওতে আবেদন হয়েছে। জানা গেছে, ২০০৫ সালে ১৫টি, ২০০৬ সালে ১১টি, ২০০৭ সালে ১৩টি, ২০০৮ সালে ১২টি, ২০০৯ সালে ১৭টি, ২০১০ সালে ১৭টি, ২০১১ সালে ১৩টি, ২০১২ সালে ১৭টি, ২০১৩ সালে ১২টি, ২০১৬ সালে ২০টি, ২০১৫ সালে ১২টি, ২০১৬ সালে ১১টি এবং ২০১৭ সালে ৭টি কোম্পানির আইপিওতে আবেদন হয়েছে। আইপিওতে ২০১৭ সালে সবচেয়ে কম টাকা উত্তোলন হয়েছে। যার পরিমাণ ২১৯ কোটি টাকা। যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একইসঙ্গে ২০১৭ সালের আবেদন বিগত ৮ বছরের (২০০৯-২০১৬) মধ্যে কোন বছরের ৩০ শতাংশ স্পর্শ করতে পারেনি। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে বাজার থেকে আইপিওয়ের মাধ্যমে উত্তোলিত টাকার পরিমাণ ১ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, ২০১০ সালে ১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা, ১২ সালে ১ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, ১৩ সালে ৮৩০ কোটি টাকা, ১৪ সালে ১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, ১৫ সালে ৮৩০ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ১৫ সালে ৮৮৯ কোটি টাকা ও ১৭ সালে ২২০ কোটি টাকা। এদিকে গত ৭ বছরে (২০১০-১৭) বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বড় হয়েছে। এ সময়ে জিডিপির আকার বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। অন্যদিকে একই সময়ে জিডিপির অনুপাতে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে। ২০১০ সালে জিডিপির অনুপাতে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৫০.৭০ শতাংশ। তবে গত ১০-১৬ সাল ধারাবাহিকভাবে কমেছে এ অনুপাত। তবে ১৭ সালে কিছুটা বেড়েছে। যা ২০১৭ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ২১.৬২ শতাংশে। সে হিসাবে ৭ বছরে জিডিপিতে শেয়ারবাজারের অনুপাত কমেছে ৬০ শতাংশ। ২০১০ সালে জিডিপির অনুপাতে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৫০.৭০ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ৩৩.২০ শতাংশ, ১২ সালে ছিল ২৬.৩০ শতাংশ, ১৩ সালে ২৫.৫০ শতাংশ, ১৪ সালে ২৪.১০ শতাংশ, ১৫ সালে ২০.১০ শতাংশ, ১৬ সালে ১৯.৭০ শতাংশ ও ১৭ সালে ২১.৬২ শতাংশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শীর্ষস্থানীয় মার্চেন্ট ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বিএসইসি মাত্র ৩-৪ জনের উপর নির্ভরশীল। তাদের অনুমতি ছাড়া কাজ হয় না। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তারা নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণে থাকেন। যে কারণে আইপিও অনুমোদন কমে গেছে। এছাড়া আইপিও অনুমোদন দেয়া নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যথা নাই।তিনি আরও জানান, আইপিও অনুমোদনের জন্য প্রযোজ্য শর্তের বাহিরেও বিএসইসি অহেতুক অনেক বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। এতে করে আইপিও অনুমোদনে অনেক জট বেঁধে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএসইসির কি লাভ, তা বোধগম্য নয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, একটি কোম্পানির আইপিও অনুমোদন পেতে ২-৩ বছর লাগা আমার কাছে বোধগম্য নয়। বিষয়টি নিয়ে বিএসইসি ভালো বলতে পারবে। এ ছাড়া এতো বেশি সময় লাগা ঠিক না বলে জানান। তাই এসব বিষয়গুলো বিএসইসির দেখা উচিত। তিনি আরও বলেন, বাজার এখন যে পরিস্থিতিতে রয়েছে তাতে আইপিও’র পরিমাণ বাড়ানো উচিত ছিল। আইপিও কমে আসার কারণে সার্বিক শেয়ারবাজারের যে গ্রোথ আমরা আশা করি, সেটা হচ্ছে না। আমাদের আরও বেশি কোম্পানির তালিকাভুক্তি দরকার। যাতে কোম্পানির বৈচিত্র্য থাকে। বেশি কোম্পানি বাজারে থাকলে মেনুপুলেশনের (কারসাজি) সুযোগ কম থাকে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি-উল মারুফ মতিন বলেন, আইপিও অনুমোদনের পরিমাণ বাড়ানোর পরিবর্তে ২০১৭ সালে কমানো হয়েছে। বিষয়টি খুব খারাপ হয়েছে। অবশ্যই আইপিও অনুমোদন বাড়ানো দরকার। না হলে সাপ্লাই ও ডিমান্ডের মধ্যে অসামঞ্জস্য তৈরি হবে। এতে বাজারে বাবল তৈরি হওয়ার সুযোগের সৃষ্টি হয়। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
×