ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবীর বিকাশ সরকার

বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশে সংঘটিত একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। আমাদের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে বিপুল পরিবর্তন ও বিচ্ছেদ-বেদনাদায়ক ঘটনার জন্ম দিয়েছে এই যুদ্ধ। সামান্য এক যুদ্ধ একে কিছুতেই বলা যাবে না। জাপানের খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ, সমাজসেবী, আন্তর্জাতিক পতাকা বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফুকিউরা তাদামাসা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না বলে মনে করেন। কারণ, সব পরাশক্তি যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চীন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এই যুদ্ধে। আমেরিকা এবং চীন প্রত্যক্ষভাবেই পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যে বিপুলসংখ্যক নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যরা অযৌক্তিকভাবে তার নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন! শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের জের নিহিত আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-হত্যাকাণ্ড এবং জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের অন্ধকারে হত্যা করার মধ্যেও। এখনও রাজনৈতিকভাবে অস্থির করে রাখার চেষ্টা করছে পাকিস্তান তার এদেশীয় দালাল ও সমর্থকদের দিয়ে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলায় কোন উপন্যাস লিখিত হয়েছে বলে জানা নেই। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দ্রুত রাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা সামরিক সরকার প্রধান জিয়াউর রহমান, এইচএম এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে লক্ষ্য করেছি। সেসব ঘটনা খুব কমই উঠে এসেছে আমাদের সাহিত্যে। তবে জিয়া ও এরশাদের আমলে অসামান্য কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টিভি ও মঞ্চনাটকের জন্ম হয়েছে, যার ছেদ পড়েছে বিএনপির প্রথম ক্ষমতায় আসার পরপরই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়ার পর হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধের ঘুমন্ত চেতনা জেগে ওঠে। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। ততদিনে কয়েক প্রজন্ম মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস না জেনেই বেড়ে ওঠে, যারা মেজর জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদকেই মুক্তিযুদ্ধের ‘হিরো’ এবং স্বাধীনতার নেতা বলে জানে! দেশের প্রথম স্বৈরাচারী সামরিক সরকার থেকে বিএনপির আমল পর্যন্ত পাক আমলের আইয়ুবীয় (জেনারেল আইয়ুব খান) হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রসঙ্গক্রমে, আমরা জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা তুলনা চিত্রিত করতে পারি বলে মনে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়া মহাদেশে জাপান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ। কে যুদ্ধের সূচনা করেছিল সেটা বিতর্কিত এবং গবেষণাসাপেক্ষ। কিন্তু এই যুদ্ধে জাপান তার অস্তিত্ব বজায় রাখা এবং এশিয়া থেকে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দূরীভূত করার জন্য আপ্রাণ লড়াই করেছিল। অক্ষশক্তি হিসেবে তার বিপক্ষশত্রু ছিল মিত্রশক্তি তথা আমেরিকা, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস। যুদ্ধে জাপান চরমভাবে হেরে গিয়েছে চারটি বছর ক্রমাগত লড়াইয়ের পর (১৯৪১-৪৫)। কিন্তু বিপুল রক্তক্ষয়ী এই মহাযুদ্ধটি যে অবিস্মরণীয় জাপানী এবং বিদেশীদের জন্য এটা আজও আমরা সাহিত্যের মাধ্যমে অনুভব করতে পারি প্রজন্ম পরম্পরায়। কয়েকটি অসামান্য এবং বিশ্বমাপের উপন্যাস বা বড় গল্প রচিত হয়েছে যুদ্ধচলাকালীন এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে। যেমন ‘সাসামে ইউকি’ (ঝিরিঝিরি বরফ) জাপানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক তানিজাকি জুনইচিরোওর (১৮৮৬-১৯৬৫) একটি বিখ্যাত উপন্যাস। যার ইংরেজী অনুবাদ ঞযব গধশরড়শধ ঝরংঃবৎং. এই দীর্ঘ উপন্যাসটি তানিজাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪১-৪৫) সময় লিখেছিলেন এবং ‘চুউও কোওরোন’ (মধ্যবর্তী মতামত) নামক জনপ্রিয় সাহিত্য ও সমালোচনাভিত্তিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হচ্ছিল ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু ১৯৪৩ সালে সামরিক অধিদফতর থেকে বিশেষ ঘোষণা বলে এটার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয় যুদ্ধকালীন সময়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ অভিযোগ তুলে। তারপরও লেখক এটাকে নিজ খরচে সামান্য কিছু কপি ছাপিয়ে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের মাঝে প্রচারের চেষ্টা করলে সেটাও নিষিদ্ধ হয় সেনাবাহিনী দ্বারা। এরকম হতেই পারে পরিস্থিতির কারণে। উপন্যাসটির পটভূমি ওসাকা নগরের ছেনবা অঞ্চলের অভিজাত বণিকপাড়ার। যেখানে সেই সময় জাহাজ এবং বড় বড় স্টিমার জাতীয় জলযান নির্মাণ করা হতো। সেখানকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তথা উচ্চমধ্যবিত্ত মাকিওকা পরিবারের চার কন্যাকে নিয়েই গল্প। চার কন্যার মধ্যে তৃতীয় কন্যা ‘ইউকিকো’র বিয়ে নিয়ে গল্পের শুরু। চার কন্যা যথাক্রমে ৎসুরুকো, সাচিকো, ইউকিকো এবং তায়েকো। তিন বোন তিন রকম চরিত্রের। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে দ্রুত সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের শিকার হয়ে পড়ে। এতদিন পর্যন্ত প্রতিবেশী শ্বেতাঙ্গ বিদেশীদের সঙ্গে তাদের পাশ্চাত্য প্রভাবিত জীবনযাপন ছিল স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছল এবং আনন্দময়Ñ সেটা যুদ্ধের কারণে বিদেশীদের চলে যাওয়া এবং আর্থিক সঙ্কট-সমস্যার কারণে পারিবারিক স্বস্তি ও উজ্জ্বলতা হারিয়ে যেতে থাকে। আর এই পরিস্থিতিটাই লেখক তানিজাকি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এই উপন্যাসে। বস্তুত, এই চার কন্যার নাম আসলে গাল্পিক নাম বা ছদ্মনাম। প্রকৃতপক্ষে, ছেনবা অঞ্চলের ফুজিনাগাতা জোওছেনজো অর্থাৎ ফুজিনাগাতা জাহাজ নির্মাণ সংস্থা (শিপইয়ার্ড) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ফুজিনাগাতা সানজুরোওর রক্তের আত্মীয় একই প্রতিষ্ঠানের উচ্চ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরিতা ইয়াসুমাৎসুর (১৮৬৪-১৯২৮) পরিবারকে নিয়ে উপন্যাসটি লিখিত। উল্লেখ্য, এদো যুগ (১৬০৩-১৮৬৮) থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ যাত্রীবাহী জলযান থেকে শুরু করে সামরিক যুদ্ধজাহাজও তৈরি করার জন্য বিখ্যাত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সমাজে মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন মোরিতাÑ আর তার ফ্যাশনদুরস্ত চার কন্যাও। ঘটনাক্রমে এই চার কন্যার মধ্যে দ্বিতীয় কন্যা ‘সাচিকো’ই হচ্ছে লেখক তানিজাকির তৃতীয় স্ত্রী ‘মাৎসুকো’। যিনি মডেল হয়েছেন উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মোরিতার দ্বিতীয় কন্যা ‘সাচিকো’ হিসেবে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে চার কন্যা তথা চার বোনের জীবন অতিবাহিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়েও হঠাৎ উড়ে আসা উন্মাতাল, অস্থির মার্কিনী সংস্কৃতির সঙ্গে জাপানী সংস্কৃতির গ্রহণ-বর্জন-ত্যাগ-তিতিক্ষার বেড়াজালে জড়িয়ে গিয়ে। উপন্যাসটি মোট চার বার চলচ্চিত্রে রূপান্তরের পর টিভি-নাটকও হয়েছে। এখনও এই উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা অসামান্য। বিদেশী ভাষা যথাক্রমে স্লোভেনিয়া, ইতালি, চীন, স্পেন, পর্তুগিজ, ফরাসী, গ্রীক, ফিনিস, সেলভিয়া, রুশ, কোরিয়া, ওলন্দাজ, চেক, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। উপন্যাসটির প্রসঙ্গ তুলে ধরা এই কারণে যে, একটা বড় যুদ্ধ বিপুল পরিবর্তন ঘটায় সমাজে তার শুরুর প্রাক্কালে এবং পরবর্তীকালে। সূক্ষ্মধীসম্পন্ন ঔপন্যাসিক তানিজাকি জুনইচিরোওর ‘সাসামে ইউকি’ ছাড়া আরও একাধিক উপন্যাস আছে, যেগুলোতে যুদ্ধজনিত আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন অর্থাৎ রীতিনীতি-নৈতিক চরিত্র এবং আদর্শের ব্যাপক অদলবদলের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে মানবিক আর্তনাদের সুরও সুতীব্রভাবে ধ্বনিত হয়েছে সাহিত্যিক ইবুসে মাসুজির (১৮৯৮-১৯৯৩) অসামান্য সৃষ্টি ‘কুরোই আমে’ (কালো বৃষ্টি) উপন্যাসে যা আণবিক বোমা দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হিরোশিমাকে নিয়ে লিখিত। তেমনিভাবে মহিলা শিশুসাহিত্যিক তাকাগি তোশিকোর (১৯৩২) কালজয়ী ‘গারাসু নো উসাগি’ (কাঁচের খরগোশ) উপন্যাসে। বাস্তব ঘটনা নিয়ে লিখিত উপন্যাসটির কাহিনী হচ্ছে : প্রধান চরিত্র তোশিকোর বাবা একটি কাঁচের কারখানার মালিক ছিলেন। মহাযুদ্ধের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে মার্কিনী বোমারু বিমান টোকিওর ওপর চিরুনি বোমাবর্ষণ করে। সেই বোমার আঘাতে যেখানে তোশিকোর মা ও ছোটবোন মৃত্যুবরণ করেন, সেখানে বিকৃতভাবে কাঁচের খরগোশটি পড়েছিল যেটা তোশিকোর বাবা তাকে তৈরি করে দিয়েছিল। অবশেষে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পলায়মান অবস্থায় তোশিকোর বাবা আমেরিকার স্থল বাহিনীর অবিরাম গুলিবর্ষণের শিকার হয়ে তারই চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করেন। এতিম, অসহায় হয়ে যায় তোশিকো। এ রকম বহু ঘটনা জাপানে ঘটেছে। এই উপন্যাসটি ১৯৭৯ সালে চলচ্চিত্রে রূপ দেন চিত্র পরিচালক তাচিবানা ইউদেন (১৯৩২-২০১০)। এটা বাংলায় অনুবাদ করেছেন বেতার সাংবাদিক হাসান মীর (১৯৪১)। অনুরূপভাবে গল্পকার নোসাকা আকিইউকির (১৯৩০-২০১৫) ‘হোতারু নো হাকা’ (জোনাকির সমাধি) নামক গল্পে বর্ণিত হয়েছে সত্যিকার ঘটনা। আমেরিকার বোমাবর্ষণে পিতামাতা হারানো দুটি শিশুর দুঃসহ অনাথ জীবনের কাহিনী যা এ্যানিমেশনের বদৌলতে আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। এ রকম আরও গল্প, উপন্যাস এবং বাস্তব ইতিহাস জাপানে রয়েছে। এমনকি, আজও লিখিত হচ্ছে যুদ্ধের ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও! সেই সব সাহিত্যকর্মে এবং ইতিহাসে প্রিয়জন, স্বজন এবং একদা সম্পর্ক গড়ে ওঠা মানব-মানবীর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাসমূহ জানা যায়। বিচ্ছেদ-বেদনা পাঠককে আক্রান্ত করে, জলজ হয়ে ওঠে মন, অশ্রুপ্লাবিত হয় নয়নযুগল। একে অপরকে না পাওয়ার সেই বেদনায় একাত্ম হয়ে যাই আমরা পাঠকও। অনেকেই এসব গল্পের মধ্যে নিজের এবং পরিবারের প্রচ্ছায়া অনুভব করেন। ফলত যুদ্ধভিত্তিক গল্প, উপন্যাস এবং স্মৃতিকথা কালজয়ী হয়ে থাকে। আমাদের সাহিত্যে স্বাধীনতা আন্দোলন বা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে চটজলদি কোন উপন্যাসের নাম কি করতে পারি? বা কোন গল্পের চরিত্রকে আমরা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত করতে পারি আমাদের সাহিত্য আড্ডা বা আলোচনায়? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যত প্রবন্ধ বা ইতিহাস লিখিত হয়েছে তার এক ভাগও নেই উপন্যাস বা গল্পের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি প্রয়াত জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক এবং বাংলাভাষার পণ্ডিত অধ্যাপক কাজুও আজুমার (১৯৩১-২০১১) বাড়িতে নব্বই দশকের মাঝামাঝি আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলায় লিখিত প্রবন্ধ ও ইতিহাস গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০০ দেখে অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলাম একটি উপন্যাসও দেখতে না পেয়ে! স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমাদের অনেক লেখকই কোন না কোনভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে চলে গিয়েছেন। তারা যেমন যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি, তেমনি ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের মানবেতর জীবন নিয়ে সংবেদনশীল সাহিত্যও রচনা করেননি এবং যারা যুদ্ধের সময় দেশের ভেতরেই লুকিয়ে ছিলেন তাদের ক্ষেত্রেও আমরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মহৎ সাহিত্য রচনা করতে দেখিনি। স্মৃতিকথাও পাইনি। নির্র্র্মম পঁচাত্তরের পর তো বাংলাদেশটাই দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল! ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার হয়ে গেল পাকিস্তানী প্রেতাত্মার সাক্ষাত নির্লজ্জ প্রতিনিধিÑ রাতারাতি হুর হুর করে বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মতো লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, গবেষক, অধ্যাপক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ওই সরকারের সমর্থক হয়ে গেল স্বদেশ, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদাতা মহান নেতাদের পবিত্র স্মৃতিকে পদদলিত করে! এমন ঘটনা নজিরবিহীন বললে অত্যুক্তি হয় না। অন্যদিকে, যারা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ পক্ষাবলম্বীÑ তাদের মধ্যে লেখক, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিকও কম নন, কিন্তু কারও পক্ষেই বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বমাপের একজন মহান নেতা, একটি স্বাধীনচেতা চরিত্রকে নিয়ে একটি উচুঁমাপের স্মৃতিকথা বা মহৎ উপন্যাস লেখা সম্ভব হয়নি। ফিকশন না ননফিকশনও লেখা হয়নি বিগত ৪৫ বছরেও! অথচ রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, নেহরু, নেতাজীকে নিয়ে কম স্মৃতিকথা আমরা পড়িনি চতুরঙ্গ, শিলাদিত্য, জিজ্ঞাসা, দেশ, অমৃত, প্রতিক্ষণ, আনন্দবাজার, উল্টোরথ, প্রসাদ প্রভৃতি সাহিত্য সাময়িকী এবং পত্রিকায় এবং কম পড়িনি ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসও এগুলোর পূজোবার্ষিকীতেও আমাদের তরুণকালে। এমনকি, এখনও লিখিত হচ্ছে। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু, ভাসানী বা জাতীয় চার নেতার প্রসঙ্গ আমরা কজন লেখক বা সাংবাদিকের লেখায় পেয়েছি প্রশ্নটি করা যেতেই পারে। তবে, হয়ত মহৎ উপন্যাস বা স্মৃতিকথা লিখিত হতো যদি অনর্থক পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পরিবর্তনটি না ঘটত বাংলাদেশে। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে উৎখাত করার ফলে বাঙালী জাতির মনমানসিকতায় অপ্রত্যাশিত, অযাচিত একটা পরিবর্তন এনে দেয় যার প্রভাব কোনভাবেই সুফল বয়ে আনেনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, এমনকি সৃজনশীল ক্ষেত্রেও। অকস্মাৎ রাজনৈতিক উলটপালট, হঠকারিতা, ক্ষমতার অদলবদলজনিত সামাজিক অবক্ষয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই বিধ্বস্ত করেছে যা থেকে মুক্ত হয়নি এখনও বাংলাদেশ। এই বিধ্বস্ত চেতনাই আমাদের সাহিত্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বিরাট শূন্যতার জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। লেখক : জাপান প্রবাসী শিশুসাহিত্যিক কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
×