ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

একুশ শতক ॥ জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ

এই কলামে ভাটির বীর শহীদ জগৎজ্যোতি দাসের শহীদ হবার কাহিনীটা লিখেছি। ইতিপূর্বে দুটি পর্বে এই বিষয়গুলো উপস্থাপিত হয়েছে। এটি এই পর্বের শেষ লেখা। ॥ তিন ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসকে নিয়ে লেখাটির পরের অংশ শুরু হয়েছে এভাবে, ‘নিষ্ঠুরের মতো ইলিয়াসের ঘোর ভাঙ্গেন হাসান মুর্শেদ।’ প্রশ্ন করেন, ‘তারপর কি হলো ইলিয়াস ভাই?’ ইলিয়াস বলেন, সেই অসম্ভব যন্ত্রণার গল্প। প্রিয় কমান্ডারের নিথর শরীর বিলের কাদাপানির ভেতর যতটা সম্ভব পুঁতে ফেলতে হয় তাকে, যেন শত্রুর হাতে এই বীরের কোন অবমাননা না হয়। নিজের এসএমজিটার সঙ্গে তুলে নেন দলনেতার এলএমজিটাও। বুকে বাঁধা গামছা থেকে চুইয়ে পড়তে থাকা রক্ত উপেক্ষা করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পেছনে ফিরতে থাকেন ইলিয়াস। ইলিয়াসের চেষ্টাটুকু সফল হয় না। পরদিন সকালে লাশ কাদা পানির ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে। রাজাকার তেলাপোকাগুলো বেরিয়ে আসে তখন, টেনে-হিঁচড়ে লাশটা নিয়ে আসে তাদের ঘাঁটিতে। তারপর জগতজ্যোতির মা-বাবাকে লাশের সামনে টেনে আনলো ওরা। পাথরের মতো পাষাণ হয়ে মা বললেন, এই লাশ তার জ্যোতির না, জ্যোতির বাম হাতে একটা আঙ্গুল বেশি। কেন জ্যোতির মা সন্তানের লাশকে অগ্রাহ্য করেছিলেন? মা হয়ে কিভাবে এ সাহস করলেন তিনি? তিনি কি তখন তার স্বামী আর বেঁচে থাকা অপর সন্তানের জীবন বাঁচানোর কথা ভাবছিলেন? জানা যাবে না আর কখনই। কারণ তিনি মারা গেছেন ক’বছর আগে। জ্যোতির মার সেই সিদ্ধান্তে খুব বেশি লাভ হলো না। বাড়ি ফিরে যেতে যেতে জ্যোতির মা-বাবা দেখলেন, তাদের ভিটায় আগুন, জ্বলছে সব। ওদিকে নর্দমার ময়লায় লুকিয়ে থাকা রাজাকার তেলাপোকাগুলো জ্যোতির লাশটা নৌকার সামনে বেঁধে নিল, আজমিরীগঞ্জ থেকে জলসুখা পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে উৎকট উৎসাহের সঙ্গে প্রদর্শন করল ‘গাদ্দার’ এর লাশ বলে পৈশাচিক উল্লাসে! তারপর আজমিরীগঞ্জ পৌঁছে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত লাশটা বেঁধে রাখল তারা, সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে জানাল, এই হচ্ছে সেই কুখ্যাত ভারতীয় দালাল, গাদ্দার ...’ হাসান মুর্শেদের দেয়া তথ্য থেকে আরও জানা যায় যে ‘১৬ নবেম্বর জগৎজ্যোতির মৃত্যুদিন। প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল জগৎজ্যোতি দাসের, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জগৎজ্যোতির মৃতু্যুর পর তাকে সর্বোচ্চ বীরত্বভূষণ দেবার কথা বলা হয়েছিল বারবার, কিন্তু অব্যাখ্যানীয় কোন কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি, বীরশ্রেষ্ঠ তো দূরে থাক, ভাটি অঞ্চলের কিংবদন্তি জগৎজ্যোতিকে আজ প্রায় কেউই চেনে না।’ জগৎজ্যোতিকে যে এখন কেউ চেনেই না তার প্রমাণ হচ্ছে যে তার মৃত্যুদিবসে কেউ একটু আহা উহুও করে না। রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চুপ। আমি কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই মহাবীরকে স্মরণ করতে শুনিনি। তিনি যে স্কুলে লেখাপড়া করেছেন যে এলাকায় তার বাড়ি এবং যে এলাকায় তিনি যুদ্ধ করেছেন তাদের কেউ তাকে স্মরণে রাখার মতো কোন কর্মকা- করেন না। কদিন আগে আজমিরীগঞ্জ থেকে একটি পাঠাগারের চিঠি আমার কাছে আসে যাতে পাঠাগারটির নাম জগৎজ্যোতি বলে উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার এতো সময় পরেও কেবলমাত্র বইয়ের পাতায় বা অনলাইনে একজন জাতীয় বীরের বিবরণ সীমিত থাকবে সেটি প্রত্যাশিত নয়। যে সময়ে দেশে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আছে সেই মুহূর্তে আমরা এই প্রত্যাশাটি করতেই পারি যে এই বীর জগৎ জ্যোতি তার প্রাপ্য সম্মান পাবে। আমি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ নীতি নির্ধারকদের সকলের কাছে আবেদন জানাই যেন এই বীর পুরুষটিকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। নিজে হাওড় এলাকার মানুষ হিসেবে আমি এটিও চাই যে এই এলাকার মানুষের কাছে জগৎজ্যোতি দাসের যুদ্ধ এবং তার বীরত্ব যেন তুলে ধরা হয়। তবে এই নিবন্ধের শেষ প্রান্তে একটি সান্ত¡নার কাহিনীর কথা আমি উল্লেখ করি। আমরা সবাই জানি, ১৬ নবেম্বর জগৎজ্যোতি শহীদ হবার এক মাসের মাঝেই দেশটি স্বাধীন হয়। পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ কররেও তারা এমনকি তাদের দালালদের দিকে নজরও দেয়নি। শাল্লা থানায় যেসব রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাকিস্তান বাহিনীর পদলেহন করেছিল তারা পরাজয়ের পর আত্মগোপন করে। শাল্লার পাশের থানা বলে ১৬০ জনের সেই রাজাকারবাহিনী আমাদের থানা খালিয়াজুরিতে বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়। শাল্লার সদর দফতর ঘুঙ্গিয়ার গাওয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে। তাই ভয়ে ওরা সেই থানায় যাবার কথা ভাবেনি। কিন্তু যখন টের পেলো যে পাকিস্তানের পতন হয়েছে তখন আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। আমি তখন আমার থানার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প লিপ্সায়। জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার গ্রামের বাড়ি কৃষ্ণপুর থেকে একজন লোক একটি টেলিগ্রাম ও আব্বার একটি নির্দেশ বহন করে আনেন। টেলিগ্রামটি ছিল আফতাব আহমদ নামক আমার এক বন্ধুর। সে লিখেছিল, কাম শার্প আফতাব। ঢাকা থেকে পাঠানো সেই টেলিগ্রামটি আমার ঢাকা ফেরার রাস্তা গড়ে তুলে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমরা দুই বন্ধু বিচ্ছিন্ন ছিলাম। বাবার আদেশটি ছিল গ্রামের বাড়ি যাবার। বাবার আদেশ মানতে গিয়ে বাড়ি এসে জানতে পারি যে, শাল্লা থানার রাজাকাররা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়। আমার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কাশেমকেও তারা আমার সঙ্গে দেখতে চায়। কাশেম যেহেতু শাল্লার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ছিল সেহেতু তাকেও খবর দিয়ে আনা হয়। কাশেমদের বাড়িতেই অস্ত্র সমর্পণ করার ব্যবস্থা করা হয়। কাশেমরা ওদের আত্মীয় ছিলো। তাই তারা অনেক ভরসা করে তাদের বাড়িটাকেই নিরাপদ মনে করে। রাজাকাররা দল বেধে কাশেমদের বাড়িতে আমার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে। ওদের অনুরোধ ছিলো আমি যেন তাদেরকে লিপ্সা নিয়ে যাই। কিন্তু ওদের আত্ম সমর্পণ এর পর আমি তাদেরকে এবং অস্ত্রগুলোকে শাল্লা পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আমি লিপ্সা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাঠাতে চাইনি। এর দুটি কারণ ছিলো। প্রথমত তারা শাল্লার রাজাকার তাই তাদেরকে শাল্লাই পাঠানোই সঠিক। দ্বিতীয়ত আমি ঢাকা আসবো-লিপ্সা যাবনা-তাই লিপ্সা নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শাল্লায় তখন ক্যাম্পের দায়িত্ব সুকুমার নামক আমার এক বন্ধুর হাতে। রাজাকাররা শাল্লা পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে। এরপর তাদেরকে সভার নামে একসঙ্গে জড়ো করা হয়। সেই সভা থেকেই তাদেরকে ভেরামোহনা নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। সেখানে থেকে কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচে। তবে মূল নেতা দুই চেয়ারম্যানসহ তাদের স্বজন ও বাকী নেতা সবই মারা যায়। ঘুঙিয়ারগাও ওরফে শাল্লা থানার হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘর বাড়ি ও সম্পদ ফিরে পায়নি এ কথা সত্য কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই সান্ত¦নার জায়গাটুকু নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে এর মধ্যদিয়ে তবে অত্যাচারের পতন কোন না কোনভাবে হয়ই। এটাই নিয়তির বিধান। আমার জানামতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমনি জগৎজ্যোতির মতো বীর আমরা খুব বেশি পাইনি, তেমনি রাজাকারদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তিও তেমনভাবে দেয়া যায়নি। এই ঘটনার বহু বছর পর আমি সুকুমারের খোঁজ করছিলাম। কিন্তু তার কোন খোঁজ আমি আর পাইনি। কাশেম মুক্তিযুদ্ধের পর ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করার পর টঙ্গীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে, এখন টঙ্গীতেই অবসর জীবন যাপন করে। আমি কাশেমের কাছে শাল্লার ঘটনার বিবরণ জানতে চেয়েও হতাশ হয়েছি। কোন বিষয়েই কাশেম কোন কথা বলে না। ঢাকা ॥ ২৮ ডিসেম্বর, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক [email protected],
×