ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরি ছেড়ে দিন!

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

চাকরি ছেড়ে দিন!

গ্রামবাংলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আগ্রহ তেমন কারও নেই। তাদের ঘরে ঘরে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়ার বারতা আদতেই পরিণত হয়েছে প্রহসনে। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি মৌলিক অধিকার হলেও সেই অধিকার গ্রামীণ জনপদের অধিবাসীদের প্রাপ্তির খাতা কেবলই শূন্যতায় ভরা। বাস্তব যে, দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। না হবারই কথা। কারণ চিকিৎসকরা ভীষণভাবে গ্রামবিমুখ। গ্রাম থেকে উঠে আসা সেসব মানুষ, যারা চিকিৎসকে পরিণত হয়েছেন, তারাও গ্রামীণ জনপদের স্বাস্থ্য নিয়ে অনাগ্রহী। মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে থাকতেই চায় না চিকিৎসকরা। সবার আগ্রহ এবং লক্ষ্যই হচ্ছে রাজধানীতে অবস্থানের। সম্ভবত ঢাকায় পসার এবং পয়সার যোগান বেশি। রোজগারের সুযোগ-সুবিধা গ্রামের তুলনায় অধিক হবার কারণেই ঢাকায় থাকার সকল প্রচেষ্টা নেয়া হয়। ঢাকার বাইরে তৃণমূলে চিকিৎসক সঙ্কট থাকলেও ঢাকায় অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনের বেশি চিকিৎসক রয়েছেন, আর ঢাকার বাইরে চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকলেও কেউই ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকতে চান না। উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের সরকার নিয়োগ প্রদান করেন যথারীতি; কিন্তু অনেকেই কর্মক্ষেত্রে থাকতে চান না। উপায়ান্তরহীন হয়ে মাঝে মধ্যে যান এবং হাজিরা খাতায় সই করে ফিরে আসেন ঢাকাতেই। এমনটাও প্রচার রয়েছে। দলবাজির কারণেই চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না। সরকারী কর্মকর্তাদের অদক্ষতা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের গ্রামের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে একাধিকবার অনুরোধ ও নির্দেশ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও গ্রামে তিন বছর থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। হা হতোস্মি! বাস্তবে অধিকাংশ চিকিৎসকই তা অনুসরণ করে আসছে না। ফলে গ্রামে চিকিৎসক না থাকাসহ চিকিৎসকদের আচরণ নিয়ে জাতীয় সংসদে ইতোপূর্বে সংসদ সদস্যরা কয়েক দফা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সমস্যার আর সমাধান হয় না। চিকিৎসকদের নিয়োগ-বদলি নীতিমালায় একটানা তিন বছর গ্রামে থাকার বিধান রয়েছে। তবে তা পালন করে হাতে গোনা কয়েকজন। এমবিবিএস শেষ করার পর প্রায় সব চিকিৎসকই ঢাকায় থাকতে আগ্রহী। কারণ ঢাকায় ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার এবং বেসরকারী ক্লিনিকে কাজ করার এবং অর্থবাণিজ্যের সুযোগ বেশি। ফলে ঢাকা কিংবা আশপাশেই পদায়ন চান সবাই। অনেকে আবার নানা অজুহাত দেখিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। স্নাতকোত্তর শিক্ষার নামে চিকিৎসকদের ঢাকায় আসা এক রকম নিয়মে পরিণত হয়েছে। এমডি, এমএস, এফসিপিএস, এমফিল ও ডিপ্লোমা কোর্সে এসব চিকিৎসকরা প্রেষণে এসে ভর্তি হন। ঢাকা না ছাড়তে অনেকে একটি কোর্স শেষ করে অন্য কোর্সে ভর্তি হন। তাছাড়া সংযুক্তির মাধ্যমে অনেকে রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালে কাজ করেন। ঢাকার অধিকাংশ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে অনুমোদিত পদের চেয়ে বেশিসংখ্যক চিকিৎসক কাজ করছেন। দু’একজন নয়, অনেক চিকিৎসকই পাঁচ থেকে দশ বছর ধরে আছেন। কেউ কেউ আবার ১৩/১৫ বছর ধরে অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে তারা ঢাকায় থাকছেন। আবার কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলেরই নেতা বনে যাচ্ছেন। সমন্বিত সিন্ডিকেটের কারণে কোনভাবেই ওসব চিকিৎসকদের ঢাকার বাইরে বদলি করা যায় না। ঢাকার বাইরে বদলি করা না গেলেও তাদের অধিকাংশই বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার ঢাকার বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে যান। এজন্য গ্রামে যেতে পারলেও সরকারী চাকরি করতে যেতে আগ্রহী নন তারা। আবার জেলা ও উপজেলাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের বেশিরভাগ বেসরকারী ক্লিনিকে ঢাকার চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এসবই চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য সুখপ্রদ নয়। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, যারা মফস্বল ছেড়ে শহরে চলে আসে, তাদের চাকরি করার দরকার নেই। ঢাকায় বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলেই তো অনেক টাকা পাবে। দয়া করে তারা বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে যাক, আমরা নতুন নিয়োগ দেব। তিনি উপজেলা পর্যায়ে আবাসন সঙ্কট নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ, আরও মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথাও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তৃণমূলে চিকিৎসা সেবা প্রদানে অনাগ্রহীদের সরকার কেন পুষবে। সেই প্রশ্ন না এসে পারে না। স্বাস্থ্য খাতের এ সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রধানমন্ত্রীর মতো দেশবাসীরও কাম্য।
×