ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিখোঁজ, গুমের তালিকায় ৭৫- দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছেন ৩৫

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

নিখোঁজ, গুমের তালিকায় ৭৫- দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছেন ৩৫

শংকর কুমার দে ॥ বিদায়ী বছর ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত নিখোঁজ ও গুমের শিকার হয়েছেন এমন তালিকায় আছেন কমপক্ষে ৭৫ জন। এর মধ্যে ৩৫ জন দীর্ঘদিন নিখোঁজের পর ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে ১৬ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া নিখোঁজদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ৭ জনের। এখনও হদিস মেলেনি ৩৩ জনের। তবে পাঁচ মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ১৩ জন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ১০ জন ফিরেও এসেছেন। কিন্তু এখনও ফেরেননি কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও এবিএন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদাত আহমেদ এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে এই তথ্য জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, চলতি ডিসেম্বরে এক ব্যাংক কর্মকর্তা নিখোঁজ থাকার ঘটনায় আবারও যেন থামছে না গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনা। অতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ নির্মম ঘটনার শিকার হতেন সন্ত্রাসী বা রাজনীতিবিদরা। বর্তমানে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাষ্ট্রদূত, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণীর মানুষ। এসব ঘটনায় দীর্ঘদিন নিখোঁজের পর মিলেছে কারও লাশ। কেউ কেউ নিখোঁজ রয়েছেন বছরের পর বছর। আবার ফিরে এসেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও দেখানো হয়েছে। নিখোঁজ অবস্থা থেকে যাদের মুক্তি মিলছে তাদের ফিরে আসার ধরনও অভিন্ন। চোখ বেঁধে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়। পরে বাসায় ফেরেন। যারা ফিরেছেন তাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় না। কেউ কথা বলেন না। গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যান তারা। শুধু তাই নয়, নিখোঁজের পর স্বজনরা যেভাবে সরব থাকেন উদ্ধারের পর তারাই আবার রহস্যজনক কারণে অস্বাভাবিকভাবে হয়ে যান নীরব। তাই কারা তাদের অপহরণ করেছিল, নিখোঁজের দিনগুলোতে তারা কোথায় ছিলেন, কেনইবা অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে- এসব প্রশ্নের কোন উত্তর মিলছে না। ভুক্তভোগীদের পরিবার পরিজনের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিটি ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সংশ্লিষ্টদের তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনার সঙ্গে কোনভাবেই জড়িত নয় বলে দাবি করে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের পক্ষ থেকে বলা অব্যাহত আছে যে, বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের যে অপরহণ করা হয়েছে তাও প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে অপহরণকারীদেরও চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যারা ফিরে এসেছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা বের করার দায়িত্ব সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে পারলেই এ ধরনের অপরাধ কমবে বলে তারা মনে করেন। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, র‌্যাব-ডিবিসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সব ইউনিটকে আইন মেনে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কেউ যদি আইনবহির্ভূত কাজ করে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। কারও নিখোঁজের সংবাদ পেলে পুলিশ তাকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। যারা ফিরে আসেন তারা পুলিশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেন না। তাই গুম বা নিখোঁজের ক্লু মিলছে না। এ কারণে অপহরণকারীদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এখনও যারা নিখোঁজ আছেন তাদের উদ্ধারে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত আছে। পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষ চার মাসে অন্তত ২০টি চাঞ্চল্যকর নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। বিগত পাঁচ মাসে নিখোঁজের মধ্যে যারা ফিরে এসেছেন তারা হলেন ব্যাংক এশিয়ার এভিপি শামীম আহমেদ, বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী ও দলটির কেন্দ্রীয় নেতা অসিত ঘোষ অসিত, বেলারুশের অনারারি কনস্যুলার অনিরুদ্ধ কুমার রায়, দক্ষিণ বনশ্রীর নকিয়া-সিমেন্সের সাবেক প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আসাদ, এ্যাভেনটিস-স্যানোফির ফার্মাসিস্ট জামাল রহমান, শাজাহানপুরের ফল ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন, গুলশানের প্রকাশক তানভীর ইয়াসিন করিম, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মোবাশ্বীর সিজার ও সাংবাদিক উৎপল দাস। অপরদিকে, নিখোঁজ থাকার পর যারা ফিরেছেন তাদের কাছেও মিলছে না কোন তথ্য। অপরহরণকারীদের বিষয়ে তেমনভাবে মুখও খুলছেন না তারা। ফলে কারা তাদের অপহরণ করেছিল, নিখোঁজের দিনগুলোতে তারা কোথায় ছিলেন, কেনইবা আটকের পর আবার ছেড়ে দেয়া হচ্ছে এমন সব প্রশ্নের কোন উত্তর মিলছে না। সব কিছুই থাকছে রহস্যেঘেরা।
×