ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুনরুজ্জীবনের প্রত্যাশায় সমাপ্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুনরুজ্জীবনের প্রত্যাশায় সমাপ্তি

মনোয়ার হোসেন ॥ সুররসিকদের মন রাঙিয়ে কেটে গেল ঘোরলাগা পাঁচটি রাত। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চলা সেই সুরধারার সূচনা হয়েছিল মঙ্গলবার। ধ্রুপদী সঙ্গীতের সেই অমিত সুধা ছড়িয়ে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব শেষ হলো শনিবার। মাঝে ঘটে গেল ৫০ ঘণ্টার সুরভ্রমণ। প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে অনুষ্ঠিত হয়েছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাত গড়িয়ে ভোর পর্যন্ত ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠে উচ্চাঙ্গের নানা ঘরানার কণ্ঠ, যন্ত্রসঙ্গীত ও নৃত্যের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় আপ্লুত হয়েছে শহুরের সুররসিকরা। ভারতীয় উপমহাদেশের ওস্তাদ, পণ্ডিত, বিদুষী ও গুরুরা নানা পরিবেশনায় উজাড় করে উপস্থাপন করেছেন আপন শৈলী ও কারুকার্য। সেই সঙ্গে দেশের উদীয়মান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীরাও তাদের পরিবেশনায় জয় করেছে শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়। সেসব পরিবেশনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের হারানো গৌরর পুনরুজ্জীবনের বারতা। স্বদেশের শিল্পীদের মন রাঙ্গানো কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা মনে করিয়ে দিয়েছে আলাউদ্দিন খাঁ, আলী আকবর খাঁ, উদয় শঙ্কর ও রবিশঙ্করদের মতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপালদের জন্মভূমি ছিল বাংলাদেশ। শনিবার ছিল পঞ্চরজনীর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের সমাপনী দিন। ‘সঙ্গীত জাগায় প্রাণ‘ স্লোগানে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ও স্কয়ার নিবেদিত ষষ্ঠতম উৎসবটি উৎসর্গ করা হয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে। উৎসবে সহযোগিতা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। উৎসবের শেষ দিনে রাত বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শ্রোতার সংখ্যা। রাত দশটার পর সুরের স্রোতে ভেসে যাওয়া সঙ্গীতানুরাগীদের আগমনে লোকারণ্যে পরিণত হয় বিশাল প্রান্তর। খেয়ালের সঙ্গে মোহন বীণা, সেতার ও বাঁশির শব্দনিনাদে আলোড়িত হয়েছে সুররসিকদের শ্রবণ ইন্দ্রীয়। পঞ্চরজনীর উৎসবের সমাপনী দিনের প্রথম পরিবেশনা শুরু হয় ওড়িশি নাচের আশ্রয়ে। মঞ্চে আসেন বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র। মুদ্রার সঙ্গে অভিব্যক্তির অনন্য সম্মিলনে উপস্থাপন করেন দুই পর্বে বিভক্ত অর্ধনারীশ্বর ও রামায়ণ-লঙ শীর্ষক পরিবেশনা। রাগমল্লিকা ও তালমল্লিকাভিত্তিক প্রথম পর্ব অর্ধনারীশ্বরের নৃত্য পরিচালনা ও রচনা করেছিলেন প্রয়াত গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র। সঙ্গীতায়োজনে ছিলেন পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্রের। ওড়িশি রামায়ণ থেকে নেয়া দ্বিতীয় পর্ব রামায়ণ-লঙ-এর নৃত্য পরিচালনা করেছেন প্রয়াত পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের করা। সঙ্গীত করেছেন পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্রের। নৃত্যনাট্যটিতে সুজাতা মহাপাত্রের সহশিল্পী ছিলেন সৌম্য বোস, বাঁশিতে ছিলেন সৌম্যরঞ্জন যোশি, রূপক কে পারিদা, বেহালায় রমেশ চন্দ্র দাস, পাখোয়াজে একলব্য মুদুলি এবং আলোক সঞ্চালনায় জয়দেব দাস। নৃত্য পরিবেশনা শেষে ছিল সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন ছায়ানট সভাপতি সঙ্গীতজ্ঞ ড. সন্্জীদা খাতুন, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং আবাহনী লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী নাবিল আহমেদের পক্ষে তার মা আমিনা আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। দেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে নবজাগরণের কথা উঠে আসে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যে। বলেন, দেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা যখন মিয়¤্রাণ, তখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এই উৎসব উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চার প্রসার ঘটাচ্ছে। স্থান-কালের পরিবর্তন হলেও নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে আয়োজনের মাধ্যমে শ্রোতারা সঙ্গীত উপভোগ করতে পেরেছেন। এতদিন এই উৎসবে শুধু উপমহাদেশের শিল্পীরা অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এবার কাজাখস্তানের শিল্পীদের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে এ উৎসব নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। উৎসব উৎসর্গের বিষয়ে তিনি বলেন, উৎসবটি উৎসর্গ করায় আমার আনন্দের অন্ত নেই। জীবদ্দশায় এমন সম্মান পাওয়া প্রসঙ্গে রসিকতাও করেন তিনি। ফজলে হাসান আবেদ বলেন, শিল্প-সাহিত্যে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ। তাই অনেক আশঙ্কা কাটিয়ে এই উৎসব আয়োজন করতে পারা অনেক ইতিবাচক ব্যাপার। সন্্জীদা খাতুন বলেন, সংস্কৃতির নিহিত শক্তি নিয়ে, নাটক, গান, আবৃত্তি নিয়ে যতই মানুষের কাছে যাওয়া যায়, ততই মানুষকে সচেতন করা যাবে। তাতে মানুষের মনে আলো জ্বালানো যাবে। ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী এত বড় একজন সঙ্গীত অনুরাগী সেদেশের সঙ্গীত উৎসব পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎসব না হয়ে পারে না। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব এখন বিশ্বের বৃহত্তম সঙ্গীতের আসর। স্বাগত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আবুল খায়ের। বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা না থাকলে আমরা এ উৎসবের আয়োজন করতে পারতাম না। সমাপনী আনুষ্ঠানিকতার পর ছিল এ রাতের অন্যতম আকর্ষণ মোহন বীণার পরিবেশনা। মঞ্চে আসেন গ্র্যামিজয়ী শিল্পী প-িত বিশ^মোহন ভট্ট। বিশ তারের হাওয়াইন গিটার-সদৃশ বাদ্যযন্ত্রে তোলেন সুরের আলোড়ন। ঘণ্টা ব্যাপ্তির বাদনে সুরেলা শব্দের মোহময়তায় তন্ময় করে রাখেন শ্রোতাদের। শুরুতেই পরিবেশন করেন রাগ বেহাগী। ধুন পরিবেশনের মাধ্যমে শেষ হয় তার বাদন। আর বাদনের মাঝে গানের সুরেও রাঙ্গিয়েছেন শ্রোতাদের। মুগ্ধ হওয়া সেই শ্রোতাদের ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল, মুহিত, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও। এরপর কণ্ঠসঙ্গীতে শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করেন রাখেন ব্রজেশ্বর মুখার্জী। পরিবেশন করেন খেয়াল। বিঞ্চুপুর ঘরানার এ শিল্পীর পরিবেশনা শেষে মঞ্চে যৌথ সেতার-বাদনে অংশ নেন উত্তর ভারতের শিল্পী পণ্ডিত কুশল দাস এবং সেনিয়া মাইহার ঘরানার শিল্পী কল্যাণজিত দাস। এরপর সেতারে সুর ছড়িয়েছেন কিরানা ঘরানার তৃতীয় প্রজন্মের শিল্পী পণ্ডিত কৈবল্যকুমার। এবারের উৎসবের সব শেষে ছিল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশিবাদন। মধ্যরাতের পর মঞ্চে আসা এই বাঁশরিয়ার বাঁশির সুরে ভোরের পানে ধাবিত হয়েছে উৎসব। তুমুল ভাললাগায় সিক্ত হয়েছে শ্রোতার অন্তর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের পরিবেশনার পাশাপাশি উৎসব প্রাঙ্গণে আরও ছিল বাংলাদেশের সঙ্গীত সাধক ও তাদের জীবনী নিয়ে সচিত্র প্রদর্শনী। এছাড়াও বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস এ্যান্ড সেটেলমেন্ট আয়োজন করে ‘সাধারণের জায়গা’ শীর্ষক স্থাপত্য প্রদর্শনী। শুক্রবার মধ্যরাতের পরিবেশনা ॥ শুক্রবার মধ্যরাতে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খানের খেয়াল শেষে ছিল সরোদ এবং বেহালার যুগলবন্দী। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ একসঙ্গে পরিবেশন করেন রাগ সিমেন্দ্রমধ্যমম। এ সময় তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত যোগেশ শামসি এবং মৃদঙ্গমে ছিলেন অর্জুন কুমার। এরপর খেয়াল পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত যশরাজ। তিনি প্রথমে রাগ যোগ- এ খেয়াল পরিবেশন করেন এবং পরে দুর্গা রাগে ভজন পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন রামকুমার মিশ্র, হারমোনিয়ামে পণ্ডিতা তৃপ্তি মুখার্জী, কণ্ঠে রত্তন মোহন শর্মা এবং মৃদঙ্গমে শ্রীধার পার্থসারথী। খেয়াল শেষে প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবে চেলো’র পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। তিনি রাগ নন্দকোষ পরিবেশন করেন। এরপর তিনি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’- এ দু’টি রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত যোগেশ শামসি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুণ্ডু ও টিংকু কুমার শীল। উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জীর সেতার। তিনি রাগ ললিত বিস্তার গৎ ঝালা পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সৌমেন নন্দী। এবারের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের সম্প্রচার সহযোগী ছিল চ্যানেল আই, মেডিক্যাল পার্টনার স্কয়ার হাসপাতাল, ইভেন্ট ব্যবস্থাপক ব্লুজ কমিউনিকেশনস এবং আয়োজন সহযোগী ইনডেক্স গ্রুপ, বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল বই ও বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল সিঙ্গাপুরের পারফেক্ট হারমনি।
×